ভঙ্গিল পর্বত
Contents
ভঙ্গিল পর্বত

বিস্তৃত অঞ্চল জুড়ে ভূত্বকের শিলাস্তরে ঢেউ এর মতাে ভাঁজ পড়ে যে পর্বতের সৃষ্টি হয় , তাকে বলে ভঙ্গিল পর্বত ।
উদাহরণ — হিমালয় পর্বতমালা ভঙ্গিল পর্বতশ্রেণীর সর্বশ্রেষ্ঠ উদাহরণ । এছাড়াও পৃথিবীতে অনেক ভঙ্গিল পর্বতশ্রেণী আছে , যেমন — ইউরোপের আল্পস , উত্তর আমেরিকার রকি , দক্ষিণ আমেরিকার আন্দিজ প্রভৃতি ।
ভঙ্গিল পর্বত সৃষ্টি
ভঙ্গিল পর্বতের উৎপত্তি সম্পর্কে যেসব মতবাদ প্ৰচলিত আছে , তাদের মধ্যে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ দুটি মতবাদ । এখানে উল্লেখ করা হল —
জিওসিনক্লাইন বা মহীখাত তত্ত্ব ( Geosyncline Theory ) :
ভঙ্গিল পর্বতের উৎপত্তি সম্পর্কে এই তত্ত্বে বলা হয়েছে যে , বর্তমানে যেসব স্থানে আমরা ভঙ্গিল পর্বত দেখি , বহুযুগ আগে ওই স্থানগুলিতে ছিল অগভীর সমুদ্র । ভূতাত্ত্বিকগণ ওই অগভীর সমুদ্রগুলিকে বলেন জিওসিনক্লাইন বা মহীখাত ।
ভূতাত্ত্বিকদের মতে যুগ যুগ ধরে পলি সঞ্চিত হওয়ার ফলে ওই অগভীর সমুদ্র বা মহীখাতের তলদেশ ক্রমশ পলিতে ভরাট হয়ে যায় এবং পলি ধীরে ধীরে পাললিক শিলায় পরিণত হয় । এইভাবে ক্রমাগত পলি ও পাললিক শিলা জমা হওয়ার ফলে তার ভারে সাগর বা মহাসাগরের তলদেশ ধীরে ধীরে নীচের দিকে নামতে থাকে বা বসে যায় এবং এর টানে দু-পাশের ভূমি ( স্থলভাগ ) মাঝখানে অর্থাৎ মুখােমুখি সামনের দিকে আসতে শুরু করে । দু-পাশের ভূমির প্রবল পার্শ্বচাপে সাগরের পাললিক শিলাস্তর বড়াে বড়াে ভাজের আকারে উঁচু হয়ে উঠে ( মেঝেতে বিছানাে মাদুর দু-পাশ থেকে চেপে ধরলে মাদুরে যেমন ভাঁজ পড়ে ) পর্বতের সৃষ্টি করে । এইভাবে ভাঁজ পড়ে সৃষ্টি হয় বলে একে ভঙ্গিল পর্বত বলে ।
প্লেট টেকটনিক তত্ত্ব বা পাত সংস্থান তত্ত্ব ( Plate Tectonic Theory ) :
এই তত্ত্বানুসারে ভূত্বক প্রকৃতপক্ষে কতকগুলি পাত বা প্লেটের সমন্বয়ে গঠিত এবং ভূ-অভ্যন্তরের উত্তপ্ত গলিত পদার্থ সমূহের ওপর ওই পাত বা প্লেটগুলি ভেসে আছে । প্রচণ্ড উষ্ণতার জন্য ভূ-অভ্যন্তরে যে পরিচলন স্রোতের সৃষ্টি হয় তার ফলে প্লেটগুলি কিছুটা চলমান অবস্থায় আছে ( তবে গতি খুব কম , বছরে হয়ত ১০-২০ মিমি বা একটু কমবেশি ) । যেহেতু সব প্লেটের গতি সমান নয় তাই ভাসতে ভাসতে একটি প্লেট যখন অন্যটির খুব কাছাকাছি চলে আসে , তখন উভয়ের সংযােগস্থলে প্রচণ্ড চাপ পড়ে । এর ফলে ওই সংযােগ রেখা বরাবর ভূমিতে ভাঁজ পড়ে ভঙ্গিল পর্বতের সৃষ্টি হয় ।
ভঙ্গিল পর্বতের বৈশিষ্ট্য
ভূত্বকের শিলাস্তরে ভাঁজ পড়ে সৃষ্টি হয় ভঙ্গিল পর্বত । এই পর্বতের কতকগুলি উল্লেখযােগ্য বৈশিষ্ট্য লক্ষ করা যায় , যেমন —
( ১ ) ভাঁজ পড়ে এই পর্বতের সৃষ্টি এবং এজন্য এতে বিভিন্ন ধরনের অনেক ভাঁজ থাকে ।
( ২ ) দুটি ভাঁজের মাঝখানে যে নীচু অংশ থাকে তাকে বলে অধো ভঙ্গ বা সিনক্লাইন এবং ভাঁজের ওপরের উঁচু অংশকে বলে ঊর্ধ্ব ভঙ্গ বা অ্যান্টিক্লাইন ।
( ৩ ) ভাঁজের দু-দিকের বাহু যদি সমান ভাবে হেলানাে থাকে , তাকে প্রতিসম ভাঁজ বা সিমেট্রিক্যাল ফোল্ড বলে । কিন্তু একদিকের বাহু যদি একটু বেশি খাড়া থাকে , তখন তাকে বলে অসম বা অপ্রতিসম ভাঁজ বা অ্যাসিমেট্রিক্যাল ফোল্ড ।
( 8 ) ভাঁজের দুই বাহু যদি পরস্পর প্রায় সমান্তরাল থেকে একটি বিশেষ কোণে হেলানাে থাকে , তবে তাকে বলে অতিরিক্ত ভাঁজ বা ওভার ফোল্ড ।
( ৫ ) দুই বাহু ক্রমশ হেলতে হেলতে যদি এমন হয় যে , একটি বাহু আর একটি বাহুর ওপর শায়িত , তবে তাকে বলে রেকাম্বেন্ট ফোল্ড ।
( ৬ ) আবার , ওপরের বাহু তলার বাহু থেকে আলাদা হয়ে যদি কিছুটা এগিয়ে যায় , তাকে বলে ওভার থ্রাস্ট।
( ৭ ) চাপ অত্যন্ত বেশি হলে এক বাহু অন্য বাহু থেকে একেবারে আলাদা হয়ে স্থানচ্যুত হয় । একে বলে ন্যাপ ।
( ৮ ) ভাঁজ ছাড়াও ভঙ্গিল পর্বতে প্রবল ভূ-আলােড়নের জন্য অনেক চ্যুতি বা ফল্ট -এর সৃষ্টি হয় । হিমালয় পর্বতে এই ধরনের অনেক চ্যুতি আছে ।
( ৯ ) ভঙ্গিল পর্বত প্রধানত পাললিক শিলা দ্বারা গঠিত হয় । অবশ্য পাললিক শিলাস্তরের মধ্যে কিছু কিছু আগ্নেয় ও রূপান্তরিত শিলা দেখা যায় ।
( ১০ ) সমুদ্রগর্ভ থেকে ভঙ্গিল পর্বতের সৃষ্টি হয় বলে পর্বতের বিভিন্ন অংশে অনেক জীবাশ্ম দেখা যায় ।
( ১১ ) ভঙ্গিল পর্বতের অধিকাংশ শৃঙ্গ বা চূড়া শঙ্কু আকৃতির হয় ।