পাললিক শিলা
Contents
পাললিক শিলা

সাগর-মহাসাগরের তলদেশে দীর্ঘকাল ধরে পলি সঞ্চিত হলে নীচের পলিস্তর গুলি ধীরে ধীরে ওপরের ভারী জলভাগ ও পলিরাশির চাপ ও নীচের তাপে জমাট বেঁধে কঠিন শিলায় পরিণত হয় । পলি জমাট বেঁধে সৃষ্টি হয় বলে একে পাললিক শিলা বলে ।
পাললিক শিলার বৈশিষ্ট্য
( ১ ) বিভিন্ন ধরনের পলি সমুদ্রের তলদেশে স্তরে স্তরে সঞ্চিত হয়ে পাললিক শিলার সৃষ্টি হয় বলে এই শিলায় স্তরগুলি স্পষ্ট থাকে । একটি স্তর অন্য একটি স্তরের সঙ্গে যে তলে যুক্ত থাকে , তাকে বলে স্তরায়ণ তল ।
( ২ ) প্রচণ্ড চাপের জন্য স্তরায়ণ তলের সঙ্গে সমকোণে বা বিভিন্ন কোণে ফাটল সৃষ্টি হয় । এর নাম সন্ধিস্থল ।
( ৩ ) অন্যান্য শিলার তুলনায় নরম ও হালকা ।
( ৪ ) এই শিলা কেলাসিত হয় না ।
( ৫ ) এই শিলায় জীবাশ্ম থাকে ।
( ৬ ) সচ্ছিদ্রতা এই শিলার একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য ।
( ৭ ) অধিকাংশ পাললিক শিলা দ্রুত ক্ষয় হয় ।
( ৮ ) জৈব উপাদানে গঠিত হয় বলে একমাত্র এই শিলায় কয়লা , খনিজ তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাস সঞ্চিত থাকে ।
পাললিক শিলার শ্রেণীবিভাগ
পাললিক শিলাকে দু-ভাবে শ্রেণীবিভাগ করা যায় —
( ১ ) উৎপত্তি ও গঠন অনুসারে এবং
( ২ ) পলির উৎপত্তি অনুসারে ।
উৎপত্তি ও গঠন অনুসারে পাললিক শিলার শ্রেণীবিভাগ :
উৎপত্তি ও গঠনের পার্থক্য অনুসারে পাললিক শিলাকে তিনটি শ্রেণিতে ভাগ করা যায় —
( i ) সাধারণভাবে বা যান্ত্রিক উপায়ে উৎপন্ন পাললিক শিলা : ছােটো-বড়াে নানা আকারের শিলাচূর্ণ এবং সিলিকা , লােহা ও চুনজাতীয় পদার্থ জমাট বেঁধে এই ধরনের শিলা উৎপন্ন হয় । শিলাচূর্ণের আয়তন ও আকৃতি অনুসারে যান্ত্রিক উপায়ে সৃষ্ট পাললিক শিলাকে তিনটি উপবিভাগে ভাগ করা যায় —
( ক ) প্রস্তরময় পাললিক শিলা , যেমন — কংগ্লোমারেট ;
( খ ) বালিময় পাললিক শিলা , যেমন — বেলেপাথর এবং
( গ ) মৃন্ময় পাললিক শিলা , যেমন — কাদাপাথর ।
( ii ) জৈব পদার্থ থেকে উৎপন্ন পাললিক শিলা : উদ্ভিদ ও সামুদ্রিক প্রাণীর দেহাবশেষ জমাট বেঁধে এই ধরনের পাললিক শিলা উৎপন্ন হয় , যেমন — ( ক ) সামুদ্রিক জীবজন্তুর খোলস ও কঙ্কাল থেকে চুনাপাথর এবং ( খ ) গাছ থেকে কয়লা উৎপন্ন হয় ।
( iii ) রাসায়নিক পদ্ধতিতে গঠিত পাললিক শিলা : সমুদ্র , নদী ও হ্রদের জলে বিভিন্ন প্রকার লবণ দ্রবীভূত বা ভাসমান অবস্থায় থাকে । জল বাষ্পীভূত হলে ওইসব লবণ জমাট বেঁধে পাললিক শিলার সৃষ্টি হয় । এছাড়া ওইসব লবণ জলের তলায় থিতিয়ে পড়ে এবং তারপর জমাট বেঁধে পাললিক শিলা সৃষ্টি করে । সাধারণত এইভাবে তিন প্রকার লবণ যৌগ সমৃদ্ধ পাললিক শিলার সৃষ্টি হয় —
( ক ) কার্বনেট যৌগ সমন্বিত , যেমন— ডলোমাইট ;
( খ ) সালফেট যৌগ সমন্বিত , যেমন — জিপসাম এবং
( গ ) ক্লোরাইড যৌগ সমন্বিত , যেমন — লবণ শিলা ।
পলির উৎপত্তি অনুসারে পাললিক শিলার শ্রেণীবিভাগ :
পলির উৎপত্তি অনুসারে পাললিক শিলাকে দুটি শ্রেণীতে ভাগ করা যায় —
( i ) সংঘাত শিলা : আদি শিলা বা প্রাথমিক শিলা সংঘাতের ফলে ক্রমশ ভগ্ন বা চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে পলিতে পরিণত হয় এবং সেই পলি থেকে যে পাললিক শিলা উৎপন্ন হয় তার নাম সংঘাত শিলা । যেমন — বেলেপাথর , কাদাপাথর প্রভৃতি ।
( ii ) অসংঘাত শিলা : কিছু কিছু পাললিক শিলা সংঘাতের মাধ্যমে উৎপন্ন না হয়ে রাসায়নিক পদ্ধতিতে উৎপন্ন হয় , এদের বলে অসংঘাত শিলা । যেমন — চুনাপাথর , ডলােমাইট প্রভৃতি ।
পাললিক শিলাকে স্তরীভূত শিলা বলা হয় কেন
সাগর বা মহাসাগরের তলদেশে স্তরে স্তরে পলি সঞ্চিত হয়ে পাললিক শিলার সৃষ্টি হয় । স্তরে স্তরে গঠিত হয় বলে পাললিক শিলার আর এক নাম স্তরীভূত শিলা । এই শিলায় একটি স্তর অন্য একটি স্তরের সঙ্গে যে তল দ্বারা যুক্ত থাকে , তাকে বলা হয় স্তরায়ণ তল ।
পাললিক শিলায় জীবাশ্ম দেখা যায় কেন
পলির মধ্যে যখন উদ্ভিদ ও প্রাণীর দেহ প্রােথিত হয়ে ধীরে ধীরে প্রস্তরীভূত হয় এবং পাথরের মধ্যে তার ছাপ থেকে যায় , ছাপসহ সেই প্রস্তরকে বলে জীবাশ্ম । পাললিক শিলার মধ্যে এই ধরনের জীবাশ্ম দেখা যায় , কারণ — ( ১ ) সমুদ্র বা হ্রদের তলায় যখন স্তরে স্তরে পলি জমা হয়ে পাললিক শিলা সৃষ্টি হয় , তখন তার মধ্যে বিভিন্ন ধরনের সামুদ্রিক উদ্ভিদ ও মৃত প্রাণীর দেহও চাপা পড়ে এবং পলি জমাট বাঁধার সময় এগুলিও ধীরে ধীরে প্রস্তরীভূত হয়ে যায় । ( ২ ) প্রস্তরে পরিণত হওয়ায় শিলাস্তরের মধ্যে ওইসব উদ্ভিদ ও প্রাণীর দেহাকৃতির ছাপ পড়ে যায় । এজন্য পাললিক শিলার মধ্যে উদ্ভিদ ও প্রাণীদেহের ছাপযুক্ত জীবাশ্ম দেখা যায় । ( ৩ ) যেহেতু পাললিক শিলার গঠন প্রক্রিয়া দীর্ঘকাল ধরে চলে , তাই সুদূর অতীতে বিভিন্ন সময়ে আবির্ভূত বহু প্রাণীদেহের ছাপ এই পাললিক শিলাস্তরের জীবাশ্মের মাধ্যমে পাওয়া যায় , যা প্রাচীনকালের উদ্ভিদ ও প্রাণীজগৎ তথা জলবায়ু সম্পর্কে আমাদের জ্ঞানলাভে সাহায্য করে ।