ইতিহাস

পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধ

Contents

পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধ 

index 8
পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধ

মুঘল সাম্রাজ্যের অবক্ষয়ের যুগে নবজাগ্রত মারাঠা শক্তি কর্তৃক ভারতবর্ষে সাম্রাজ্য গঠনের সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল । কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাও স্বপ্নে পর্যবসিত হয় । যে পানিপথের প্রান্তরে ইতিপূর্বে দুবার ভারতের ভাগ্য নিয়ন্ত্রিত হয়েছে , তৃতীয়বারের জন্যও সেই পানিপথ ভারত ইতিহাসের গতিপথ নির্ধারণ করে দিল । 

দিল্লির উপর কর্তৃত্ব 

পেশােয়া বালাজী বাজীরাও তাঁর পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ করে চতুর্দিকে সাম্রাজ্যের সীমা প্রসারিত করেছিলেন । দক্ষিণ ভারত তখন মারাঠাদের কুক্ষিগত । অথচ উত্তর ভারতই ভারত সাম্রাজ্যের প্রাণকেন্দ্র । তাই উত্তর ভারত দখল করে মারাঠা সাম্রাজ্যের স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করতে উদ্যোগী হন বালাজী বাজীরাও । সুযােগও তার সামনে এসে যায় খুব তাড়াতাড়ি । দিল্লির ব্যক্তিত্বহীন মুঘল বাদশাহ তখন কোনােক্রমে নিজের অস্তিত্বটা টিকিয়ে রেখেছেন । তাই মারাঠা বাহিনী বিনা প্রতিরােধেই গঙ্গানদীর তীর ধরে রাজপুতানার মধ্য দিয়ে দিল্লি পৌছে যায় । বাদশাহ বিনা প্রতিবাদেই মেনে নেন মারাঠাদের কর্তৃত্ব । মারাঠাদের দাবিমতাে বাদশাহ জনৈক ইমাদ-উল- মুলক’কে উজিরৎ পদে নিয়ােগ করেন । ইমাদ ছিলেন সম্পূর্ণভাবেই মারাঠা নিয়ন্ত্রিত । ফলে দিল্লির মুঘল প্রশাসন বকলমে মারাঠা প্রশাসনে পরিণত হয় । 

পাঞ্জাবে আফগানদের বিতাড়ন 

দিল্লির সাফল্য মারাঠা নেতাদের সাম্রাজ্য ক্ষুধাকে অন্ধত্বের পর্যায়ে নিয়ে যায় । কূটনৈতিক সংযােগ বা ক্ষমতা সুদৃঢ়করণ জাতীয় কৌশল -এর গুরুত্বকে নস্যাৎ করে দিয়ে তারা ঝাপিয়ে পড়ে পাঞ্জাবের উপর । তখন পাঞ্জাবের শাসনকর্তা আফগান নেতা আহমদ শাহ আবদালির পুত্র তৈমুর শাহ । ১৫৫৮ খ্রিস্টাব্দে লাহাের মারাঠাদের দখলে চলে আসে । এমনকি আটক -এর সুরক্ষিত দুর্গও মারাঠাদের হস্তগত হয় । বিতাড়িত হন তৈমুর শাহ সহ আফগানগণ । আফগানদের এই বিপর্যয় সংবাদে ক্রুদ্ধ ও উত্তেজিত হয়ে আফগান সম্রাট আবদালি সসৈন্যে ভারত অভিমুখে রওনা হন । 

তৃতীয় পানিপথের যুদ্ধ

চতুর আবদালি কখনােই মারাঠাদের শক্তিকে ছােটো করে দেখেননি । তাই মারাঠাদের সাথে সংঘর্ষে নামার পূর্বে তিনি প্রকৃত রাজনীতিজ্ঞ-এর মতাে অপরাপর ভারতীয় শক্তিগুলিকে মারাঠাদের থেকে বিচ্ছিন্ন করতে যত্নবান হন । রােহিলাখণ্ড ও অযােধ্যা মারাঠাদের আক্রমণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল । মারাঠাদের শক্তিবৃদ্ধি তাদের ক্রমশ আতঙ্কিত করেছিল । তাই আবদালির আমন্ত্রণে রােহিলা নবাব নাজিবউদদৌলা এবং অযােধ্যার নবাব সুজাউদদৌলা আনন্দের সাথেই তার সাথে চুক্তিবদ্ধ হয়েছিলেন । উত্তর ভারতের রাজ্যগুলির অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বারবার হস্তক্ষেপের ফলে এবং নজরানা আদায়ের ফলে তারাও মারাঠাদের প্রতি ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছিল । শিখ বা জাঠগণও মারাঠাদের প্রতি প্রসন্ন ছিল না । তাই এইসব শক্তি মারাঠা-আফগান সংঘর্ষে নিরপেক্ষতা অবলম্বন করে । মারাঠাদের সহায় বলতে ছিলেন একমাত্র দিল্লির উজির ইমাদ-উল-মুলক । অবশ্য তার শক্তি ছিল খুবই সামান্য । 

১৭৬১ খ্রিস্টাব্দের ১৪ ই জানুয়ারি পানিপথের প্রান্তরে আবদালির নেতৃত্বে আফগান বাহিনীর সাথে সদাশিব রাও ভাও -এর নেতৃত্বে মারাঠা বাহিনীর যুদ্ধ হয় । মারাঠা সৈন্য ছিল প্রায় ৪৫ হাজার এবং আফগান সৈন্য ছিল প্রায় ৬০ হাজার । তবুও প্রথমদিকে মারাঠাদেরই সাফল্যের সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছিল । কিন্তু আবদালি যুদ্ধের শেষ পর্যায়ে ১৩ হাজার নতুন সৈন্য নামিয়ে রণক্লান্ত মারাঠাদের বিধ্বস্ত করে দিলেন । শ্মশান শয্যা রচিত হল মারাঠা শক্তির । সদাশিব রাও , বিশ্বাস রাও -সহ নিহত হলেন অগণিত মারাঠাবীর । এই পরাজয় সংবাদে সম্পূর্ণভাবে ভেঙে পড়লেন অসুস্থ পেশােয়া বাজীরাও । পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধ আবার নতুন খাতে বইয়ে দিল ভারত ইতিহাসের গতিকে । 

পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধের ফলাফল

পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধের ফলাফল সম্পর্কে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতভেদ আছে । এই যুদ্ধের সদর্থক ফল উল্লেখযােগ্য না হলেও নঞর্থক ফল অবশ্যই ছিল । 

প্রথমত , মারাঠাদের পক্ষে এই যুদ্ধ অবশ্যই বিপর্যয়কর ছিল । কারণ পেশােয়াদের নেতৃত্বে ভারতব্যাপী মারাঠা সাম্রাজ্য স্থাপনের যে সম্ভাবনা উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল , অতঃপর তা আর ছিল না । মারাঠাগণ নেহাতই একটা আঞ্চলিক শক্তিতে পরিণত হয়েছিল । 

দ্বিতীয়ত , এই যুদ্ধের ফলে কে ভারত শাসন করবে — সে প্রশ্নের উত্তর হয়তাে পাওয়া যায়নি । তবে মুঘল বা মারাঠাগণ যে ভারত শাসন করবে না— এ সত্য প্রমাণিত হয়ে গিয়েছিল । অর্থাৎ ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসে ইংরেজ শক্তির উত্থান স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল । 

তৃতীয়ত , মারাঠা শক্তির ক্রমবিকাশ মহীশূরে হায়দার আলি বা পাঞ্জাবে শিখদের উত্থানের পথে প্রধান অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছিল । কিন্তু পানিপথের যুদ্ধে মারাঠাদের বিপর্যয়ের ফলে ওই দুটি আঞ্চলিক শক্তির অভ্যুত্থান সহজ হয় । 

চতুর্থত , পানিপথের বিপর্যয় মারাঠা জাতির ঐক্যবােধকে বিনষ্ট করেছিল । বিভিন্ন মারাঠা সর্দারের মধ্যে যে স্বাধীনতাকামিতা লুকিয়েছিল এখন তা প্রকাশ হয়ে পড়ে । অতঃপর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ক্ষমতালােভী ও স্বার্থান্বেষী মারাঠা সর্দারেরা মারাঠা স্বার্থকে ব্রিটিশের পায়ে জলাঞ্জলি দেয় ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!