ছিয়াত্তরের মন্বন্তর
Contents
ছিয়াত্তরের মন্বন্তর

রবার্ট ক্লাইভ দ্বিতীয়বারের জন্য ভারতবর্ষে এসে কোম্পানিকে ‘ দেওয়ানি ’ পাইয়ে দেবার সঙ্গে সঙ্গে কোম্পানির অভ্যন্তরীণ বিশৃঙ্খলা দমনেও যথেষ্ট তৎপর ছিলেন । তাঁর দৃঢ়তার ফলে ভারতের স্বার্থ ক্ষুন্ন হলেও কোম্পানির স্বার্থ রক্ষিত হচ্ছিল । তবে লােভ ও লালসার স্রোত প্রবাহিত হচ্ছিল ব্রিটিশ কর্মচারীদের মনের গভীরে । সেই লালসায় নতুন মাত্রা যুক্ত করেছিল এক শ্রেণির হীনমনা বঙ্গ সন্তান । এরা ইংরেজের পদলেহন করে গড়ে তুলতে চেয়েছিলে নিজেদের ঐশ্বর্য সম্পদ ।
ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের কারণ
বাংলার উপর দুর্ভিক্ষ ও মহামারীর অভিশাপের একাধিক কারণ ছিল । সরকারের লালসা , অনাচার , প্রকৃতির বিরূপতা ইত্যাদি একাধিক কারণের সমন্বয়ে মন্বন্তরের পদধ্বনি শােনা যায় ।
দ্বৈত শাসনের কুফল :
ক্লাইভের পরে ব্রিটিশ গভর্নর রূপে এসেছিলেন যথাক্রমে , ভেরেলস্ট ( ১৭৬৭-৬৯ খ্রিঃ ) এবং কার্টিয়ার ( ১৭৬৯ – ৭২ খ্রিঃ ) । প্রশাসক হিসেবে দুজনেই ছিলেন ব্যর্থ । তাই সময় অতিক্রান্ত হবার সঙ্গে সঙ্গে ইংরেজ কর্মচারীদের মধ্যে দুর্নীতি ও শােষণ এর মাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছিল । পার্সিভাল স্পিয়ার আলােচ্য সময়কে ব্রিটিশ কর্তৃক ‘ প্রকাশ্য ও নির্লজ্জ লুণ্ঠনের যুগ ’ বলে অভিহিত করেছেন । ক্লাইভ প্রবর্তিত ‘ হাঁস-জারু ’ শাসন ব্যবস্থা যা সাধারণভাবে ‘ দ্বৈত শাসন ’ নামে খ্যাত বা কুখ্যাত , তা ছিল অরাজকতা ও শােষণের মাধ্যম মাত্র । নবাব ছিলেন সম্পূর্ণ ক্ষমতাহীন । কোম্পানি ‘ দেওয়ান ’ হলেও দেওয়ানি কাজ ছিল চরিত্রহীন রেজা খাঁ ও সিতাব রায় প্রমুখের হস্তগত । তাদের না ছিল মানবিকতা , না ছিল নীতিবোধ ।
মাত্রাহীন শোষণ :
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি দেওয়ানি লাভ করার ফলে সমগ্র রাজস্ব ব্যবস্থায় অরাজকতা ও অনিশ্চয়তা দেখা দেয় । দ্রুত অবনতি ঘটে গ্রামীণ অর্থনৈতিক অবস্থার । বাংলা চিরদিনই কৃষিভিত্তিক অর্থনীতি নির্ভর । মুঘল যুগে কৃষকদের একটি নির্দিষ্ট হারে খাজনা দিতে হত । ঘন ঘন রাজস্বের হার পরিবর্তন ঘটত না বা রায়তকে উচ্ছেদ করা হত না । এই স্থিরতা কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির সহায়ক হয়েছিল । কিন্তু আলােচ্য সময়ে কৃষিক্ষেত্রে নেমে আসে সর্বগ্রাসী প্রলােভন । র্যামসে মূর – এর ভাষায় : “ কোম্পানির একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল কৃষিক্ষেত্রে যত বেশি সম্ভব রাজস্ব আদায় করা । ” রাজস্ব কর্মচারীদের স্থায়িত্ব নির্ভর করত কে কত বেশি রাজস্ব আদায় করতে পারে তার উপর । রাজস্বের কোনাে সর্বোচ্চ বা নির্দিষ্ট সীমা ছিল না । ফলে শােষণ ও অত্যাচার ছিল অনিয়ন্ত্রিত । আলিবর্দি খাঁ’র আমলে যে পুর্ণিয়া জেলা থেকে ৪ লক্ষ টাকা রাজস্ব আদায় হত , কোম্পানির দেওয়ানি লাভ করার ফলে তা বেড়ে দাঁড়ায় ২৫ লক্ষে । অথচ বাংলার নবাবের পক্ষে নীরব দর্শক হওয়া ছাড়া গত্যন্তর ছিল । ফলে কৃষকদের অনেকেই কৃষিকাজ ছেড়ে দিতে বাধ্য হয় । অনেকে ভিক্ষুকে পরিণত হয় । বহু ছােটো জমিদারও কপর্দকশূন্য হয়ে পড়েন ।
কৃষি বিপর্যয় :
র্যামসে মূর বলেছেন , “ নির্মম ভাবে রাজস্ব আদায়ের চেষ্টা , কোম্পানির কর্মচারীদের সীমাহীন লাভের আকাঙক্ষা জনগণকে মৃত্যুমুখী করে তােলে ।” এমনকি স্বয়ং ক্লাইভও মন্তব্য করেছেন যে , “ পৃথিবীর অন্য কোনাে দেশে এ অরাজকতা , বিভ্রান্তি , দুর্নীতি ও শােষণ পীড়নের কথা কেউ শােনেনি , যার লীলাক্ষেত্র হয়ে উঠেছিল এই বাংলাদেশ । এত বিপুল সম্পদ আর কোনাে দেশ থেকে লুণ্ঠিত হয়নি । ” আগত বিপর্যয়ের কথা উপলব্ধি করে গভর্নর ভেরেলেস্ট ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষকে সতর্ক করে দিয়েছিলেন । তিনি ইংল্যান্ডে জানান যে , “ ব্যবসায় থেকে যতখুশি লাভ করা যায় , কিন্তু জমির উৎপাদন ক্ষমতা সীমিত । বাংলার কৃষি ধ্বংস হলে তা হবে ইংরেজদের পক্ষে বিপর্যয় স্বরূপ । ” কিন্তু এই সতর্কবাণী কর্তৃপক্ষের কাছে কোনাে গুরুত্বই পায়নি ।
অনাবৃষ্টি :
শােষণজনিত কৃষি বিপর্যয়ের সাথে বিধাতার অভিসম্পাত স্বরূপ অনাবৃষ্টি যুক্ত হলে বাংলার চাষির নাভিশ্বাস ওঠে । বিহার ও বাংলায় এই অনাবৃষ্টি শুরু হয় ১৭৬৮ খ্রিস্টাব্দ থেকে এবং তা অব্যাহত থাকে ১৭৬৯ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত । খাঁ খাঁ করতে থাকে বাংলার মাঠ-ঘাট । উপর্যুপরি শস্যহানির ফলে ১৭৭০ খ্রিস্টাব্দে ( বাংলায় ১১৭৬ সন ) দেশব্যাপী দুর্ভিক্ষের করাল ছায়া নেমে আসে । এটিই ‘ ছিয়াত্তরের মন্বন্তর ’ নামে খ্যাত ।
সরকারের ভুল সিদ্ধান্ত :
সরকারের অবিবেচক ও হঠকারী সিদ্ধান্তসমূহ এই দুর্ভিক্ষকে মহামারিতে রূপান্তরিত করে । এক শ্রেণির ব্যবসায়ী ও কর্মচারী কয়েকটি অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের একচেটিয়া কারবার শুরু করে দেয় । সরকার সেনাবাহিনীর জন্য লক্ষ লক্ষ মণ খাদ্যশস্য মজুত করতে থাকে । যে সামান্য খাদ্যদ্রব্য অবশিষ্ট ছিল , তাও মুহূর্তে উধাও হয়ে যায় । সরকার খাজনা মকুবের পরিবর্তে আরও কঠোরতার সাথে খাজনা আদায়ের সিদ্ধান্ত নেন । একদিকে খাদ্যাভাব এবং অন্যদিকে সরকারি নিপীড়ন বাংলাকে শ্মশানে পরিণত করে ।
ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের ফলাফল
প্রথমত , ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের ফলে বাংলার সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবন প্রচণ্ডভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে । প্রায় এক-তৃতীয়াংশ মানুষ খাদ্যাভাবে প্রাণ হারায় । বাংলায় গ্রামাঞ্চল জনশূন্য হয়ে পড়ে । বহু অঞ্চল জঙ্গলে পরিণত হয় । সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘ আনন্দমঠ ‘ উপন্যাস থেকে এই মন্বন্তরের ভয়াবহতার এক সকরুণ চিত্র পাওয়া যায় ।
দ্বিতীয়ত , কৃষক , তাঁতি , কামার , কুমাের প্রভৃতি শ্রমজীবী মানুষের ব্যাপক মৃত্যু ঘটার ফলে কৃষিকার্যে লােকাভাব প্রকট হয়ে ওঠে । একইভাবে বিভিন্ন শিল্পকাজের জন্যও লােকাভাব দেখা দেয় ।
তৃতীয়ত , লােকাভাবে বিভিন্ন ধরনের দ্রব্যের ব্যবসা বাণিজ্য প্রায় বন্ধ হয়ে যায় । বাংলার প্রসিদ্ধ বস্ত্রশিল্প প্রায় ভেঙে পড়ার উপক্রম হয় ।
চতুর্থত , অর্থাভাবে ও খাদ্যাভাবে জর্জরিত মানুষ তাদের নীতিবােধ হারিয়ে দুর্নীতিমূলক কাজে জড়িয়ে পড়তে বাধ্য হয় । সর্বত্র আইনশৃঙ্খলা ভেঙে পড়ে । শুরু হয় ডাকাতি ও লুঠতরাজ । দিনাজপুর , রংপুর , মালদা , রাজশাহি প্রভৃতি জেলায় এই ধরনের অপকর্ম ভীষণ আকার লাভ করে । উত্তর ভারত থেকে আগত লােকেরা ফকির ও সন্ন্যাসীর ছদ্মবেশে অবাধে লুণ্ঠন কাজ চালিয়ে যায় । দেশে আইনশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা বলে কিছুই ছিল না ।
পঞ্চমত , দুর্ভিক্ষপীড়িত গ্রামবাংলা থেকে দলে দলে মানুষ শহরে চলে যেতে শুরু করে । ফলে একদিকে শহরগুলির উপর প্রচণ্ড চাপ পড়ে আবার গ্রামগুলি জনহীন হয়ে পড়ায় শ্রীহীন হয়ে পড়ে । এইভাবে ছিয়াত্তরের মন্বন্তর বাংলার অর্থনৈতিক ও সামাজিক জীবনকে পঙ্গু করে দেয় ।