ইতিহাস

দ্বিতীয় কর্ণাটকের যুদ্ধ

দ্বিতীয় কর্ণাটকের যুদ্ধ

index 6
দ্বিতীয় কর্ণাটকের যুদ্ধ

মুঘল সাম্রাজ্যের পতনােন্মুখতার সুযােগে দক্ষিণ ভারতও অষ্টাদশ শতকে প্রায় স্বাধীন হয়ে গিয়েছিল । দাক্ষিণাত্যের মুঘল সুবাদার নিজাম-উল-মুলক ছিলেন কার্যত স্বাধীন । আবার তার অধীনস্থ আঞ্চলিক শাসকরাও প্রায় স্বাধীনভাবে রাজ্য পরিচালনা করতেন । দাক্ষিণাত্যের এ হেন রাজনৈতিক বিচ্ছিন্নতার সুযােগে ফরাসি ও ইংরেজ বণিকেরা ওই অঞ্চলে স্ব স্ব বাণিজ্যকেন্দ্র স্থাপনে সমর্থ হয়েছিল । দাক্ষিণাত্যে ফরাসিদের প্রধান বাণিজ্য কেন্দ্র ছিল পণ্ডিচেরী এবং ইংরেজদের প্রধান ঘাঁটি ছিল মাদ্রাজের সেন্ট ডেভিড । স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের স্বাধীনতাকামিতা , বিচ্ছিন্নতা ও পারস্পরিক মতভেদের সুযােগ নিয়ে উভয় বণিক সম্প্রদায়ই ভারতীয় রাজনৈতিক ক্ষেত্রে অংশগ্রহণ করতে শুরু করে । অবশ্য তাদের প্রাথমিক উদ্দেশ্য ছিল স্ব স্ব বাণিজ্য বিস্তার করা । যাই হােক , ক্ষমতা দখলের জন্য এই অঞ্চলে ইংরেজ ও ফরাসি বণিকেরা তিনটি বড়াে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল । এগুলিই সাধারণভাবে ‘ কর্ণাটের যুদ্ধ ’ বা ‘ কর্ণাটকের যুদ্ধ ’ নামে খ্যাত । 

আই – লা – স্যাপেলের সন্ধির  সূত্রে ভারতে ইঙ্গ-ফরাসি দ্বন্দ্বের অবসান ঘটলেও উভয় পক্ষের মধ্যে তীব্র মতভেদ ছিল । ডুপ্লে ব্যক্তিগত ভাবে মাদ্রাজ ইংরেজদের প্রত্যর্পণে রাজি ছিলেন না । ভারতীয় শাসকদের দুর্বলতার সুযােগে তিনি ভারতে স্থায়ী সাম্রাজ্য গঠনের স্বপ্ন দেখেছিলেন । তাই তিনি চেয়েছিলেন দাক্ষিণাত্যে অস্থিরতা ও যুদ্ধ চলতে থাকুক । কিছুদিনের মধ্যেই তাঁর সামনে সেই সুযোগ উপস্থিত হয় । ১৭৪৮ খ্রিস্টাব্দে দাক্ষিণাত্যের সুবাদার আসফজা নিজাম-উল-মুলক মারা যান । অতঃপর সিংহাসন দখল করেন তাঁর পুত্র নাসির জং । কিন্তু বাদশাহের এক ফরমান অনুযায়ী তার পৌত্র মুজফ্ফর জং মসনদ দাবি করতে থাকেন । অন্যদিকে আর্কট ( কর্ণাট ) -এর প্রাক্তন নবাব দোস্ত আলির জামাতা চাঁদা সাহেব মারাঠাদের হাতে বন্দিদশা থেকে মুক্তি পেয়ে কর্ণাটে ফিরে আসেন এবং নবাবি দাবি করতে থাকেন । এই সুযােগ নেন ডুপ্লে । তিনি মুজফ্ফর জং এবং চাঁদা সাহেব’কে যথাক্রমে দাক্ষিণাত্যের সুবাদারি ও কর্ণাটের নবাবিপদে প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দিয়ে এক চুক্তিতে আবদ্ধ করেন । ১৭৪৯ খ্রিস্টাব্দে এই তিন শক্তি অম্বুরের যুদ্ধে আনােয়ারউদ্দিনকে পরাজিত ও নিহত করে । কর্ণাটকের মসনদ দখল করেন চাঁদা সাহেব । আনােয়ারউদ্দিনের পুত্র মহম্মদ আলি ত্রিচিনপল্লিতে ইংরেজের আশ্রয়ে পালিয়ে যান । পরের বছরই দাক্ষিণাত্যের নিজমা নাসির জং জনৈক আততায়ীর হাতে নিহত হন । সঙ্গে সঙ্গে মুজফফর জং নিজেকে ‘ দাক্ষিণাত্যের সুবেদার ’ বলে ঘােষণা করেন । ফরাসি সাহায্যের প্রতিবাদ স্বরূপ মুজফ্ফর জং ডুপ্লেকে কৃষ্ণানদীর দক্ষিণ তীরস্থ অঞ্চলের শাসক নিযুক্ত করেন । ফরাসি স্বার্থ তত্ত্বাবধান করার জন্য বুসি নামক জনৈক ফরাসি সেনাপতি নিজামের দরবারে অধিষ্ঠিত হলেন । এইভাবে ফরাসি অনুগত নিজাম ও নবাবের ক্ষমতা দখলের ফলে দক্ষিণ ভারতে ফরাসি প্রভাব বৃদ্ধি পেতে থাকল । 

ডুপ্লের অপসারণ  

ডুপ্লে তথা ফরাসিদের মর্যাদা ও প্রভাব বৃদ্ধিতে ইংরেজগণ স্বভাবতই শঙ্কিত ও ঈর্ষান্বিত হয়ে উঠে । মহম্মদ আলি ত্রিচিনপল্লিতে আশ্রয় গ্রহণ করা থেকেই ফরাসিরা ত্রিচিনপল্লি অবরােধ করে রেখেছিল । ফরাসিদের সাফল্যে আতঙ্কিত হয়ে মহীশূর , মারাঠা শক্তি ও তাঞ্জোরের রাজা ইংরেজের পক্ষে যােগদান করেন । এই সময় বিচক্ষণ ও সাহসী ইংরেজ যুবক রবার্ট ক্লাইভ আর্কট আক্রমণ করে ফরাসিদের উপর চাপ সৃষ্টি করতে উদ্যোগী হন । দীর্ঘ সংগ্রামের পর ইংরেজবাহিনী জয়লাভ করে । চাঁদা সাহেব ইংরেজের হাতে বন্দি ও নিহত হন । মহম্মদ আলি কর্ণাটের নবাব পদে অধিষ্ঠিত হন । ইতিমধ্যে দাক্ষিণাত্যেও ডুপ্লের কার্যক্রম বিফল হতে থাকে । ফলে ফরাসি সরকার ডুপ্লের কর্মপদ্ধতিতে যথেষ্ট ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছিলেন । তাই ১৭৫৪ খ্রিস্টাব্দে ডুপ্লেকে ফ্রান্সে প্রত্যাবর্তনের আদেশ দেওয়া হয় । ডুপ্লের পদে যােগদান করেন গডেহু । গভর্নর গডেহু ইংরেজদের সাথে এক সন্ধি সাক্ষর করে ( ১৭৫৪ খ্রিঃ ) দ্বিতীয় কর্ণাটক যুদ্ধের অবসান ঘটান । সন্ধির শর্তানুযায়ী ㅡ

( ১ ) উভয়পক্ষ চুক্তি স্বাক্ষরের সময় নিজ নিজ অধিকৃত ভূখণ্ড বজায় রাখতে রাজি হয় । 

( ২ ) স্থির হয় , অতঃপর কেউ তাদের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে কোনাে হস্তক্ষেপ করবে না । 

( ৩ ) হায়দ্রাবাদে বুসির ক্ষমতা অপরিবর্তিত থাকে । 

দ্বিতীয় কর্ণাটকের যুদ্ধের ফলাফল  

আপাত দৃষ্টিতে কর্ণাটকের দ্বিতীয় যুদ্ধও ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসে কোনাে বিরাট পরিবর্তন ঘটায়নি , কিংবা দাক্ষিণাত্যে ইঙ্গ-ফরাসি আধিপত্যের ব্যাপারেও বিরাট হেরফের হয়নি । কিন্তু পরােক্ষভাবে এই যুদ্ধের পরিণতি ইংরেজ ও ফরাসিদের রাজনৈতিক ভাবমূর্তির পরিবর্তন সূচিত করেছিল । এতদিন পর্যন্ত ফরাসি শক্তি দাক্ষিণাত্যে যেভাবে প্রভাব-প্রতিপত্তি বৃদ্ধি করে যাচ্ছিল , দ্বিতীয় কর্ণাটক যুদ্ধের পর তা বিরাট ধাক্কা খায় । ফরাসিদের রাজনৈতিক গুরুত্ব ক্রমশ হ্রাস পেতে শুরু করে এবং সেই স্থানে উঠে আসে ইংরেজ । এতকাল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি স্বতঃপ্রণােদিত হয়ে দাক্ষিণাত্যের রাজনীতিতে অংশগ্রহণের ব্যাপারে দ্বিধান্বিত ছিল , কিন্তু এই যুদ্ধের পর তারা এ ব্যাপারে আগ্রহান্বিত বােধ করে । তা ছাড়া এই যুদ্ধ একটা করুণ সত্য প্রমাণ করে দেয় যে , ভারতীয় রাজনীতিতে ভারতীয় শক্তির ইচ্ছা-অনিচ্ছা ও আশা আকাঙক্ষা গুরুত্বহীন । অর্থাৎ রাজনীতি কীভাবে এগােবে তা নির্ভর করছে বিদেশি বণিকদের ইচ্ছার উপর ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!