বক্সারের যুদ্ধের কারণ ও ফলাফল

বক্সারের যুদ্ধের কারণ ও ফলাফল

index 4
বক্সারের যুদ্ধের কারণ ও ফলাফল

মিরজাফরকে পদচ্যুত করে ইংরেজ কোম্পানি এক চুক্তি দ্বারা তার জামাতা মিরকাশিমকে বাংলার নবাব পদে বসায় ( ১৭৬০ খ্রিঃ ) । এইভাবে বাংলার রাজনৈতিক অন্তর্দ্বন্দ্বের সুযােগে নবাব পরিবর্তন ইংরেজের এক লাভজনক ব্যবসায়ে পরিণত হয় । যাই হােক , মিরকাশিম ছিলেন বিচক্ষণ , দূরদর্শী ও আত্মসচেতন । তাই ইংরেজের সাথে মিত্ৰতা করে মসনদ লাভ করলেও নবাবির মর্যাদাকে বিকিয়ে দিতে তিনি প্রস্তুত ছিলেন । তিনি উপলব্ধি করেছিলেন যে , মিরজাফর -এর পতনের অন্যতম কারণ ছিল আর্থিক দৈন্য , সামরিক দুর্বলতা । তাই প্রথম থেকে এই ত্রুটি দূর করতে তিনি যত্নবান হন । সিংহাসনে বসেই মিরকাশিম কোম্পানির সমস্ত প্রাপ্য মিটিয়ে দেন । চুক্তি অনুযায়ী 

( ১ ) বর্ধমান , মেদিনীপুর ও চট্টগ্রামের রাজস্ব আদায়ের ভার কোম্পানির হাতে অর্পণ করেন । 

( ২ ) কোম্পানির সেনাবাহিনীর ব্যয় নির্বাহের জন্য দশ লক্ষ টাকা প্রদান করেন । 

( ৩ ) ভ্যান্সিটার্টকে পঞ্চাশ হাজার পাউন্ড , হলওয়েলকে সাতাশ হাজার পাউন্ড এবং কাউন্সিলের অন্যান্য সদস্যদের প্রত্যেককে দশ থেকে পঁচিশ হাজার পাউন্ড প্রদান করেন । এইভাবে কোম্পানির সমস্ত প্রাপ্য মিটিয়ে দিয়ে তিনি স্বাধীন শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তনে উদ্যোগী হন । 

বিদ্রোহ দমন ও রাজস্ব নীতি

স্বার্থান্বেষী জমিদার ও প্রতিপত্তিশালী ব্যক্তিদের দমন করার জন্য মিরকাশিম কয়েকটি কঠোর ব্যবস্থা নেন । 

( ১ ) বিহারের শাসনকর্তা রামনারায়ণ রায়কে কঠোরতার দ্বারা নবাবের বশ্যতা স্বীকারে বাধ্য করেন । 

( ২ ) সরকারি অর্থ আত্মসাৎ করার অভিযােগে বহু উচ্চপদস্থ কর্মচারী ও অভিজাত ব্যক্তির সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করেন । 

( ৩ ) জগৎশেঠের পরিবারের কাছ থেকে বলপূর্বক ঋণ আদায় করেন । এবং 

( ৪ ) জমিদারদের উপর বেশ কয়েকটি নতুন কর বা আবওয়ার ধার্য করেন । এইভাবে তিনি অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহের সম্ভাবনা বিনষ্ট করেন এবং সরকারি অর্থাভাব দূর করেন । অবশ্য তার রাজস্বনীতি ঐতিহাসিকদের দ্বারা বহুল সমালােচিত হয়েছে । শাের ( Shore ) এর মতে , “ মিরকাশিম -এর রাজস্ব দাবি ছিল অযৌক্তিক ও শােষণের নামান্তর । ” নন্দলাল চ্যাটার্জীর  ভাষায় : “ মিরকাশিম -এর রাজস্বনীতি লুণ্ঠনের নামান্তর ছিল ” ( ” His ( Mirquasim ) revenue administration was no better than an organised plunder . ” ) ।

মিরকাশিমের সামরিক সংস্কার 

আর্থিক সমস্যা সমাধানের পর মিরকাশিম তার সামরিক শক্তিকে সংহত করতে প্রয়াসী হন । অতীতের যুদ্ধগুলি থেকে তিনি বুঝেছিলেন যে , প্রাচীন যুদ্ধকৌশলই ভারতীয় বাহিনীর প্রধান দুর্বলতা । তাই সামরিক বাহিনীর আমূল সংস্কার সাধনের জন্য এবং নবাব বাহিনীকে ইউরােপীয় আধুনিক পদ্ধতিতে শিক্ষিত করার জন্য তিনি মার্কার , সামরু ও জেন্টিল নামক তিনজন ইউরােপীয় সেনাপতি নিয়ােগ করেন । কিছু সংখ্যক আর্মেনিয়ানকেও তিনি সৈনিক হিসেবে নিযুক্ত করেন । উত্তর-পশ্চিম সীমান্তের শক্তিশালী , পরিশ্রমী ও দুর্ধর্ষ তাতার , আফগান ও পারসিকদের সেনাবাহিনীর অন্তর্ভুক্ত করেন । এমনকি আগ্নেয়াস্ত্র তৈরির জন্য তিনি মুঙ্গেরে একটি অস্ত্র নির্মাণ কারখানা করেন । ব্রিটিশ প্রভাব মুক্ত হয়ে শাসন পরিচালনার জন্য তিনি বাংলার রাজধানী মুর্শিদাবাদ থেকে মুঙ্গের স্থানান্তরিত করেন । পি. জে. মার্শাল -এর মতে , মিরকাশিমের লক্ষ্য ছিল হুগলি-ভাগীরথী নদীর অববাহিকা অঞ্চল থেকে দূরে ও নিরাপদ স্থান থেকে রাজ্য পরিচালনা করা । কারণ নিম্নবঙ্গে নৌশক্তিধর কোম্পানির প্রভাবমুক্ত শাসন পরিচালনা সম্ভব ছিল না । 

ইংরেজদের সাথে বিরোধ

মিরকাশিমের এ হেন স্বাধীনতাপ্রিয়তা এবং আর্থিক ও সামরিক সাফল্য ইংরেজ কোম্পানিকে রুষ্ট করে । পলাশী পরবর্তী মানসিকতায় ইংরেজগণ ভেবেছিল যে , সমস্ত নবাবই তাদের কথামতাে চলতে বাধ্য । কিন্তু স্বাধীনচেতা মিরকাশিম নবাবের মর্যাদা সম্বন্ধে ছিলেন যথেষ্ট সচেতন । ফলে উভয়ের মধ্যে মতবিরােধ আসে অনিবার্যভাবে । 

অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য সংক্রান্ত সমস্যা 

অধিকাংশ ঐতিহাসিক মনে করেন , অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যে কোম্পানির কর্মচারীদের যথেচ্ছাচার নবাবের সাথে কোম্পানির কর্তৃপক্ষের সংঘর্ষের পথ তৈরি করে দিয়েছিল । ১৭১৭ খ্রিস্টাব্দের ফরমান অনুযায়ী কোম্পানি রপ্তানি বাণিজ্যে শুল্ক ছাড়ের সুবিধা ভােগ করত । কিন্তু পলাশীর যুদ্ধের পরবর্তীকালে কোম্পানির কর্মচারীরাও তাদের ব্যক্তিগত বাণিজ্যেও শুল্ক ছাড়ের সুবিধা ভােগ করতে শুরু করে । এজন্য তারা বেআইনিভাবে ‘ দস্তক ’ ব্যবহার করে চলে । এর ফলে 

( ১ ) শুল্ক দিয়ে ব্যবসারত বাঙালি ব্যবসায়ীরা প্রতিযােগিতায় পিছিয়ে পড়তে থাকে এবং 

( ২ ) সরকার প্রাপ্য শুল্ক থেকে বঞ্চিত হয় । সরকারি কোষাগারে বাৎসরিক প্রায় ২৫ লক্ষ টাকা কম আদায় হতে থাকে । মিরকাশিম দস্তকের অপব্যবহার বন্ধ করার জন্য বারবার কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন । গভর্নর ভ্যান্সিটার্ট বিষয়টির গুরুত্ব উপলব্ধি করে নবাবের সাথে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেন । মুঙ্গেরে স্বাক্ষরিত এই চুক্তি দ্বারা স্থির হয় যে , কোম্পানির কর্মচারীরা ব্যক্তিগত বাণিজ্যের জন্য শতকরা ৯ টাকা হারে শুল্ক দেবেন । কিন্তু কলিকাতা কাউন্সিল এই চুক্তি বাতিল করে দেয় । সাধারণ ইংরেজগণ এই ধরনের চুক্তি করার পেছনে ভ্যান্সিটার্টের অসৎ উদ্দেশ্য আছে বলে প্রচার করেন । ঘটনার অগ্রগতি মিরকাশিমকে ভীষণ ক্ষুব্ধ করে এবং তিনি চরম সিদ্ধান্ত গ্রহণে তৎপর হন । 

বক্সারের যুদ্ধ 

প্রকৃতপক্ষে বাংলার স্বাধীনচেতা নবাবের সাথে স্বার্থান্বেষী ইংরেজের সংঘাত ছিল ইতিহাসের অনিবার্য পরিণতি । তাই উভয়পক্ষই এই পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত ছিলেন । ফলে কোনাে প্রকার আপন রক্ষার পরিবর্তে উভয়েই বৃহত্তর যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নিতে থাকে । কিন্তু পরপর কাটোয়া , ঘেরিয়া ও উদয়নালার যুদ্ধে মিরকাশিম ইংরেজের হাতে পরাজিত হন । ইংরেজ বাহিনী মুঙ্গের দখল করে নিলে মিরকাশিম অযােধ্যায় পালিয়ে যান । অতঃপর তিনি অযোধ্যার নবাব সুজাউদ্দৌলা এবং দিল্লির নামমাত্র সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলম -এর সাথে চুক্তিবদ্ধ হয়ে পুনরায় বাংলায় প্রবেশ করেন । বক্সারের প্রান্তরে উভয়পক্ষের বাহিনীর মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয় । কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত মিরকাশিম , সুজা ও শাহ আলমের মিলিত বাহিনী ইংরেজের কাছে পরাজিত হয় । এটিই ‘ বক্সারের যুদ্ধ ’ ( ১৭৬৪ খ্রিঃ ) নামে খ্যাত । সুজা ও শাহ আলম ইংরেজের সাথে অপমানজনক সন্ধি স্বাক্ষর করতে বাধ্য হন । মিরকাশিম দেশত্যাগ করেন । পলাতক অবস্থায় তার মৃত্যু ঘটে । 

বক্সারের যুদ্ধের ফলাফল

পলাশীর যুদ্ধে যে ইংরেজ প্রাধান্যের সূচনা হয়েছিল , বক্সারের যুদ্ধে তার চূড়ান্ত পরিণতি লাভ করেছিল । 

( ১ ) বাংলাদেশে ইংরেজের ক্ষমতাকে প্রতিহত করার আর কোনাে সম্ভাবনাই ছিল না । প্যার্সিভ্যাল স্পীয়ার -এর ভাষায় ও ” Plassey marked the beginning of British expansion in Bengal . Buxar determined the success of the enterprise . ” পলাশীর যুদ্ধ ছিল আকস্মিক এবং তার ফলাফল ছিল অমীমাংসিত । কিন্তু বক্সারে তা চূড়ান্ত হয়েছিল । তাই স্মিথ ( V. Smith ) বলেছেন : “ Plassey was a connonade while Buxar was a decisive battle . ” 

( ২ ) বক্সারের বিপর্যয়ের পর বাংলার কোনাে নবাবই ইংরেজের প্রভাব মুক্ত হয়ে শাসন পরিচালনার চেষ্টা করেননি । পরবর্তী নবাবরা সবাই ছিলেন ‘ রাজপােশাকে সুসজ্জিত ইংরেজের হাতের পুতুল ’ ( Puppet with royal dress ‘ ) । বক্সারের যুদ্ধের পরবর্তীকালে আগত নবাবরা ব্রিটিশ কোম্পানির বেতনভুক কর্মচারীর অধিক কিছু ছিলেন না । তাই র‍্যামসে মুর ( Ramsey Moor ) বলেছেন , “ বক্সার বাংলার উপর কোম্পানির শাসনের শেকল চূড়ান্তভাবে স্থাপন করেছিল ” ( “ Bixar finally riveted the shackles of the company’s rule upon Bengal . ” ) ঐতিহাসিক ম্যালেসন ও ‘ বক্সারের যুদ্ধকে একটি চূড়ান্ত ফলনির্ণয়কারী যুদ্ধ ’ বলে অভিহিত করেছেন । অতঃপর বাংলায় ইংরেজের আধিপত্য ও কর্তৃত্ব স্থাপন ছিল সময়ের প্রশ্নমাত্র । এ সত্য দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল যে , ইংরেজ প্রভাবমুক্ত হয়ে নবাবি করা সম্ভব হবে না । তাই পরবর্তী নবাবের একমাত্র কর্তব্য ছিল ইংরেজের সুযােগ সুবিধা বৃদ্ধি করা । ‘ দেওয়ানি ’ নামক স্বর্ণখনির চাবিকাঠি লাভ করা যে দুরাশা নয় , তা ইংরেজগণ বুঝতে পেরেছিল । তাই বলা যেতে পারে , বক্সারের যুদ্ধ ছিল বাংলা তথা ভারত ইতিহাসের একটি নির্দিষ্ট মােড় ( Turning Point ) ।

Leave a Reply

Your email address will not be published.

x
error: Content is protected !!