লর্ড কর্নওয়ালিসের সংস্কার
Contents
লর্ড কর্নওয়ালিসের সংস্কার

কোম্পানির শাসনকালে ভারতে আগত গভর্নর জেনারেলদের মধ্যে লর্ড কর্নওয়ালিস ছিলেন অন্যতম শ্রেষ্ঠ । বস্তুত তিনিই ভারতে আধুনিক শাসনতন্ত্রের ভিত্তি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন । অবশ্য কর্নওয়ালিসের শাসন সংস্কারের প্রধান লক্ষ্য ছিল ইংল্যান্ডের অনুকরণে ভারতীয় প্রশাসনকে গড়ে তােলা । কারণ তিনি আন্তরিকভাবে বিশ্বাস করতেন যে , ইংল্যান্ডে প্রচলিত ব্যবস্থাদি সর্বশ্রেষ্ঠ ও আদর্শ স্থানীয় ।
লর্ড কর্নওয়ালিস এর শাসন সংস্কার
কর্নওয়ালিস যখন এদেশে আসেন তখন কোম্পানির কর্মচারীদের মধ্যে উঁচু নিচু সবস্তরেই দুর্নীতি , স্বজন পােষণ ইত্যাদি ব্যাপক ভাবে প্রচলিত ছিল । অধিকাংশ কর্মচারীই বেআইনি ব্যবসা বাণিজ্যে লিপ্ত থেকে অবৈধ উপায়ে বহু অর্থ উপার্জন করত । ইংল্যান্ডের কর্তৃপক্ষ এ সংবাদ জানলেও , তা দূরীকরণে আগ্রহী ছিলেন না । পরন্তু তাদের অনেকেই কী উপায়ে নিজ নিজ আত্মীয়দের ভারতে নিয়ােগ করা সম্ভব হয় , তার জন্য সুযােগের সন্ধানে ব্যস্ত ছিলেন । কর্মচারীরাই দুর্নীতিগ্রস্ত হবার ফলে সাধারণ প্রশাসন , রাজস্ব , বাণিজ্য , বিচার প্রভৃতি প্রতিটি ক্ষেত্রেই অগ্রগতি ব্যাহত হচ্ছিল । তিনি কোম্পানির সংকীর্ণ বণিক চরিত্র পরিবর্তন করে প্রকৃত প্রশাসকের আদর্শ কার্যকরী করতে সচেষ্ট ছিলেন । সৌভাগ্যবশত তিনি শাসন সংগঠনের কাজে কয়েকজন অভিজ্ঞ ইংরেজ কর্মচারীর সাহায্য পেয়েছিলেন । যেমন রাজস্ব বিভাগে জন শাের , জোনাথান ডানকান , বাণিজ্য সংক্রান্ত বিভাগে চার্লস গ্র্যান্ট , আইন সংক্রান্ত বিভাগে উইলিয়াম জোন প্রমুখ ।
সিভিল সার্ভিসের সূচনা
কর্নওয়ালিস একই কর্মচারীর একাধিক বিভাগে নিয়ােগ বন্ধ করে দেন । তিনি নির্দেশ দেন কর্মচারীদের বাণিজ্য বিভাগ অথবা রাজস্ব বিভাগের যে কোনাে একটিতে যুক্ত থাকার সিদ্ধান্ত নিতে হবে । পার্সিভ্যাল স্পিয়ার এর মতে , কর্নওয়ালিসের এই নীতির ফলেই ‘ ভারতীয় সিভিল সার্ভিস ’ ( Indian Civil Service ) -এর উদ্ভব ঘটে । কর্নওয়ালিসের সময় থেকেই সমস্ত প্রকার প্রশাসনিক দায়িত্ব এই শ্রেণির কর্মচারীদের উপর বর্তেছিল । তিনি সকল স্তরের কর্মচারীর বেতন বৃদ্ধি করে দিয়ে এবং বেআইনি উপার্জনের পথ বন্ধ করে দিয়ে কর্মচারীদের কর্মদক্ষতা বৃদ্ধির চেষ্টা করেন ।
লর্ড কর্নওয়ালিসের বাণিজ্য সংস্কার
বাণিজ্য বিভাগকে দুর্নীতি মুক্ত করার জন্য কর্নওয়ালিস কয়েকটি পরিবর্তন সাধন করেন । তিনি কাজের গতিবৃদ্ধির জন্য বাণিজ্য পরিচালক সংস্থা ‘ বোর্ড অব ট্রেড ‘ – এর সদস্য সংখ্যা এগারাে থেকে কমিয়ে পাঁচ জন করেন । তখন কোম্পানি তার কর্মচারীদের মাধ্যমে ভারতীয় কাঁচামাল সংগ্রহ করত । কর্নওয়ালিস এই প্রথা রহিত করে সরাসরি কোম্পানি এবং দালালদের মধ্যে যােগাযােগ শুরু করেন । এটি ‘ এজেন্সী ’ প্রথা নামে খ্যাত । দুর্নীতিগ্রস্ত কন্ট্রাক্টরদের কঠোর শাস্তিদানের ব্যবস্থা করা হয় । কর্নওয়ালিস তন্তুবায়দের স্বার্থরক্ষার জন্য তৎপর হন এবং তারা যাতে কর্মচারীদের শােষণের শিকারে পরিণত না হয় তার জন্য উপযুক্ত ব্যবস্থা নেন ।
লর্ড কর্নওয়ালিস এর প্রশাসনিক সংস্কার
বাস্তব অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে তিনি শাসন বিভাগেও কিছু পরিবর্তন সাধন করেন । প্রথমে তিনি জেলা কালেক্টরদিগের রাজস্ব আদায়ের সঙ্গে সঙ্গে ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে বিচার ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষার ভার দিয়েছিলেন । রাজস্বের বিষয়ে এঁরা ‘ রাজস্ব বাের্ড ’ এবং আইনশৃঙ্খলার বিষয়ে গভর্নর জেনারেল -এর নিকট দায়িত্ববদ্ধ ছিলেন । কিন্তু এই ব্যবস্থা ক্রমশ জটিলতা বৃদ্ধি করতে থাকে । ১৭৯৩ খ্রিস্টাব্দে তিনি শাসনবিভাগ থেকে বিচারবিভাগকে আলাদা করে এই জটিলতা দূর করেন । তিনি ৩৫ টি জেলাকে পুনর্বিন্যাস করে ২৩ টি জেলায় পরিণত করেন ।
লর্ড কর্নওয়ালিসের পুলিশ ব্যবস্থা
পূর্বে গ্রামাঞ্চলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব ছিল গ্রামীণ জমিদারদের হাতে । কর্নওয়ালিস এই ব্যবস্থা বাতিল করে দেন এবং একটি সুবিন্যস্ত পুলিশ বাহিনীর উপর আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব দেন । কলকাতায় আইন শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য পুলিশ কমিশনার পদের সৃষ্টি করেন । জেলাগুলিতে কয়েকটি থানা প্রতিষ্ঠা করা হয় । প্রতি থানায় কনস্টেবলসহ দারােগা নিযুক্ত হত । শহরগুলিতে কয়েকটি পুলিশ সুপারিনটেনইডেন্ট পদের সৃষ্টি করে আইনশৃঙ্খলার দায়িত্ব দেওয়া হয় । এদের ব্যয়ভার সরকার বহন করতেন । তিনি কর্মচারীদের সততা ও নিয়মানুবর্তিতার উপর বিশেষ গুরুত্ব দিতেন । এজন্য তিনি অনেকগুলি আচরণবিধি তৈরি করেন । এগুলি কর্নওয়ালিস কোড ( Cornwallis Code ) নামে পরিচিত হয় । প্রসঙ্গত উল্লেখ্য , উচ্চ কর্মচারী পদে কর্নওয়ালিস ভারতীয়দের নিয়ােগের প্রচণ্ড বিরােধী ছিলেন । তিনি মনে করতেন , ভারতীয়গণ অযােগ্য এবং দুর্নীতিগ্রস্ত , আসলে তিনি ছিলেন অন্ধ জাতীয়তাবাদী ।
লর্ড কর্নওয়ালিস এর বিচার সংস্কার
ফৌজদারি বিচার ও কর্নওয়ালিসের বিচার সংস্কারও বিশেষ উল্লেখযােগ্য । তিনি ওয়ারেন হেস্টিংস প্রবর্তিত বিচার কাঠামাে মােটামুটি বজায় রেখেই তাকে আরও সুবিন্যস্ত করার জন্য কয়েকটি পরিবর্তন সাধন করেন ।
( ১ ) তিনি মুর্শিদাবাদ থেকে সদর নিজামত আদালতটি কলকাতায় স্থানান্তরিত করেন এবং বিচারের ভার নবাবের পরিবর্তে গভর্নর জেনারেল ও তার পরিষদের হাতে ন্যস্ত করেন । দেশীয় আইনকানুন সম্বন্ধে তাদের অবহিত করার জন্য কাজি ও মুফতি নিয়ােগ করা হয় ।
( ২ ) সদর নিজামত আদালতের অধীনে চারটি ভ্রাম্যমাণ বিচারালয় ( Court of Circuit ) গঠন করা হয় । এগুলির প্রতিটিতে দুজন করে ইংরেজ বিচারপতি নিয়ােগ করা হয় । বিচারকেরা বছরে দুবার করে বিভিন্ন জেলায় গিয়ে বিচারকার্য সম্পন্ন করতেন । বিচারকদের সাহায্য করতেন কাজি ও মুফতি ।
( ৩ ) বিচার ব্যবস্থার সর্বনিম্ন স্তরে সদর আমিন ও মুনসেফি বিচারালয় স্থাপন করা হয় ।
( ৪ ) মুসলমান ও অমুসলমান সাক্ষীর মধ্যে পূর্বে যে তারতম্য ছিল , কর্নওয়ালিশ তার অবসান ঘটান । সাক্ষীকে একজন মুসলমান সাক্ষীর সমান বলে গণ্য করা হত । কর্নওয়ালিশ উভয় শ্রেণির সাক্ষীকে সমান মর্যাদা দান করেন ।
( ৫ ) পূর্বে নরহত্যা রাষ্ট্রীয় অপরাধ ( State Crime ) বলে গণ্য হত না । নিহত আত্মীয়দের ইচ্ছা অনিচ্ছার উপর হত্যাকারীর বিচার ও শাস্তি নির্ভর করত । কর্নওয়ালিশ আইন জারি করে হত্যাকাণ্ডকে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কৃত অপরাধ বলে ঘােষণা করেন এবং সমাজের হাতেই অপরাধীর শাস্তিবিধানের দায়িত্ব অর্পণ করেন ।
( ৬ ) কর্নওয়ালিস অঙ্গচ্ছেদ , বেত্রাঘাত জাতীয় নিষ্ঠুর ও অমানবিক দণ্ডদান রীতি তুলে দেন ।
দেওয়ানী বিচার ব্যবস্থা
কর্নওয়ালিশ দেওয়ানি বিচার ব্যবস্থাকে রাজস্ব থেকে বিচ্ছিন্ন করে নিম্ন থেকে উচ্চ পর্যায় পর্যন্ত দেওয়ানি বিচার ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজান ।
( ১ ) দেওয়ানি বিচারের সর্বনিম্নে ছিল সদর আমিন ও মুনসেফি আদালত ।
( ২ ) এদের উপরে প্রতি জেলায় ছিল একটি করে জেলা দেওয়ানি আদালত । এগুলি একজন করে ইংরেজ বিচারপতির অধীনে থাকত । ভারতীয় আইনবিদগণ জেলা-জজকে বিচারকার্যে সাহায্য করতেন ।
( ৩ ) জেলা বিচারালয়ের উপরে এটি প্রাদেশিক দেওয়ানি আপিল আদালত স্থাপিত ছিল । এগুলি কলকাতা , ঢাকা , পাটনা , মুর্শিদাবাদে অবস্থিত ছিল । এগুলির বিচার পরিচালনা করতেন ইংরেজ জজগণ ।
( ৪ ) সমগ্র দেওয়ানি বিচারের সর্বোচ্চে ছিল সদর দেওয়ানি আদালত । স-পরিষদ গভর্নর জেনারেল এই আদালতে বিচারকার্য পরিচালনা করতেন ।
যুক্তিপূর্ণ সুবিন্যস্তকরণের মধ্য দিয়ে কর্নওয়ালিশ ভারতীয় বিচার ব্যবস্থাকে জনমুখী করে তুললেও , তিনি জোরপূর্বক নবাবের বিচার ক্ষমতা হরণ করেছিলেন বলে সমালােচনার সম্মুখীন হয়েছিলেন । উচ্চপদে ভারতীয়দের নিয়ােগ বন্ধ করেও তিনি ভারতীয় প্রতিভা ও যােগ্যতার অমর্যাদা করেছিলেন । অবশ্য এসব ত্রুটি সত্ত্বেও তার নেতৃত্বে ভারতীয় শাসন ও বিচার ব্যবস্থা বহুলাংশে উন্নত হয়েছিল ।