ঔরঙ্গজেবের দাক্ষিণাত্য নীতি
Contents
ঔরঙ্গজেবের দাক্ষিণাত্য নীতি

ঔরঙ্গজেবের রাজত্বকালের অতি গুরুত্বপূর্ণ ও সুদূরপ্রসারী একটি বিষয় হল তাঁর দক্ষিণাত্য নীতি । মােট শাসনকালের প্রায় অর্ধেক সময় ( ১৬৮২-১৭০৭ খ্রিঃ ) তিনি দাক্ষিণাত্যে অতিবাহিত করেছিলেন । সম্রাট আকবর দাক্ষিণাত্যের উপর মুঘল আধিপত্যের সূচনা করেছিলেন । ঔরঙ্গজেব তাকে চূড়ান্ত রূপ দিয়ে সমগ্র দাক্ষিণাত্যকে মুঘলের অধীনে আনার পরিকল্পনা করেন ।
ঔরঙ্গজেবের দাক্ষিণাত্য নীতির দুটি মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল —
( ১ ) সাম্রাজ্যের সম্প্রসারণ এবং
( ২ ) অ-সুন্নি মুসলমান ও হিন্দুদের রাজনৈতিক কর্তৃত্ব বিনাশ করা । বিজাপুর ও গােলকুণ্ডার শিয়া সম্প্রদায়ভুক্ত শাসকদ্বয় এবং মহারাষ্ট্রের হিন্দু-মারাঠা সর্দার শিবাজীকে দমন করে নিজ লক্ষ্য পূরণ করতে সচেষ্ট হন । গোঁড়া সুন্নি মতে , বিশ্বাসী ঔরঙ্গজেব মনে করতেন যে , শিয়া রাজ্য বিজাপুর ও গােলকুণ্ডাকে ধ্বংস করা তার নৈতিক কর্তব্য । সংশােধনবাদী ঐ দুটি রাজ্যকে গ্রাস করা তিনি ইসলামের প্রতি দায়বদ্ধতা বলে বিশ্বাস করতেন ।
বিজাপুর ও গোলকুণ্ডা দখল
সম্রাট শাহজাহানের আমলে দাক্ষিণাত্যের সুবাদার হিসেবে ঔরঙ্গজেব বিজাপুর ও গোলকুণ্ডা রাজ্য দুটি দখল করার পরিকল্পনা করেছিলেন । কিন্তু শাহজাহান ও দারাশুকোহর বিরােধিতার জন্য তার ইচ্ছা পূরণ করতে পারেননি । সম্রাট হবার পর ঔরঙ্গজেব দাক্ষিণাত্যে স্বীয় সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত করতে উদ্যোগী হন । তবে ওই সময়ে দাক্ষিণাত্যে মারাঠাদের উত্থানের বিষয়ে তিনি সচেতন ছিলেন । তাই সম্রাট হবার অব্যবহিত পরবর্তী কয়েক বছর তিনি দাক্ষিণাত্যে আগ্রাসনের পরিবর্তে সমঝােতার নীতি অনুসরণ করেন । তা ছাড়া ওই সময়ে উত্তর ভারতে একাধিক সমস্যায় তিনি বিব্রত ছিলেন । তাই পূর্ণ উদ্যমে দাক্ষিণাত্যের সমস্যা সমাধানে অগ্রসর হতে পারেননি । কিন্তু কয়েক বছরে উত্তর ভারতের সমস্যা কিছুটা মিটলে তিনি দাক্ষিণাত্যের প্রতি নজর দেন । একই সময়ে শিবাজীর নেতৃত্বে মারাঠা জাতির অভ্যুত্থান তাকে দাক্ষিণাত্যের বিষয়ে কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণে বাধ্য করে ।
বিজাপুর আক্রমণ :
অতঃপর ঔরঙ্গজেব দাক্ষিণাত্যে অগ্রসর নীতি অনুসরণ করার সিদ্ধান্ত নেন । ১৬৬৮ থেকে ১৬৭৬ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে দাক্ষিণাত্যে মুঘল বিরােধী জোট আরও সংহত হয় । গোলকুণ্ডার ব্রাহ্মণ-মন্ত্রী মদন্ন ও অকন্ন-র নেতৃত্বে বিজাপুর , গােলকুণ্ডা ও মারাঠাজাতি মুঘল বিরােধী জোট গঠন করে । বাহাদুর খাঁ ও দিলীর খাঁ পরপর সুবাদার নিযুক্ত হয়েও এই জোট ভাঙতে ব্যর্থ হন । এরপর ঔরঙ্গজেব নিজ পুত্র আজমকে বিজাপুর আক্রমণের নির্দেশ দেন ( ১৬৮০ খ্রিঃ ) । ১৬৮৫ খ্রিঃ বিদ্রোহী পুত্র মহম্মদ আকবরকে অনুসরণ করে স্বয়ং ঔরঙ্গজেবও দাক্ষিণাত্যে উপস্থিত হন । ইতিমধ্যে আজম বিজাপুরের বিভিন্ন অঞ্চল বিধ্বস্ত করে বিজাপুর অবরােধ করেন । সম্রাটের বাহিনী যােগদান করলে বিজাপুরের প্রতিরােধ ভেঙে পড়ে । বিজাপুরের সম্রাট আদিল শাহ আত্মসমর্পণ করেন । তাকে কারাগারে নিক্ষেপ করা হয় এবং বিজাপুরকে মুঘল সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করা হয় ( ১৬৮৬ খ্রিঃ ) ।
গোলকুণ্ডা আক্রমণ :
বিজাপুরের পর ঔরঙ্গজেব গােলকুণ্ডা দখল করতে উদ্যোগী হন । আসলে বিজাপুরের পতনের ফলে গােলকুণ্ডার পতনও অনিবার্য হয়ে পড়ে । গােলকুণ্ডার শাসক মুঘলদের নিয়মিত কর প্রদান করলেও এই শিয়া-রাজ্যটিকে গ্রাস করার ইচ্ছা ঔরঙ্গজেবের আগে থেকেই ছিল । আবার মদন্ন ও অকন্ন-র মতাে বিধর্মী হিন্দুর নেতৃত্বে গোলকুণ্ডা মুঘল বিরােধী জোট গঠন করলে ঔরঙ্গজেব এই রাজ্য গ্রাস করতে উদ্যোগী হন । বিজাপুরের পতন তাঁর এই কাজকে সহজতর করে দেয় । ১৬৮৬ খ্রিস্টাব্দে গোলকুণ্ডার কুতুব শাহি বংশের বিরুদ্ধে ঔরঙ্গজেব মুঘলবাহিনী প্রেরণ করেন । এক বছরের মধ্যেই গোলকুণ্ডার পতন ঘটে । গোলকুণ্ডার সুলতান আবুল হাসান মুঘলবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করেন । আবুল হাসান বন্দি হন এবং গোলকুণ্ডা মুঘল সাম্রাজ্য ভুক্ত হয় ।
ঔরঙ্গজেব-মারাঠা সংঘাত
বিজাপুর ও গোলকুণ্ডার পতন ঘটলেও দাক্ষিণাত্যে মুঘল কর্তৃত্বের পথে বড়াে বাধাস্বরূপ মারাঠারা তখনও বিদ্যমান । প্রসঙ্গত স্মরণ করা যেতে পারে যে , শিবাজী জাতীয়তাবােধ ও ধর্মীয় প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ করে বিচ্ছিন্ন মারাঠা জাতিকে একটি ঐক্যবদ্ধ শক্তিতে পরিণত করতে সক্ষম হয়েছিলেন । শিবাজীর হিন্দু রাষ্ট্রের আদর্শ ঔরঙ্গজেবের ক্রোধকে ভীষণভাবে বাড়িয়ে দিয়েছিল । তাই শিবাজীকে দমন করার জন্য তিনি একে একে শায়েস্তা খাঁ ( ১৬৬৩ খ্রিঃ ) , জয়সিংহ ও দিলীর খাঁ কে ( ১৬৬৫ খ্রিঃ ) নিযুক্ত করেন । কিন্তু শিবাজীর কর্মদক্ষতা , সাহস ও কূটকৌশলের কাছে এরা সবাই পরাজিত হন । ঔরঙ্গজেব মিথ্যা কথা বলে শিবাজীকে মুঘলদুর্গে বন্দি করে রাখার যে পরিকল্পনা করেন , শিবাজীর তীক্ষ্ণবুদ্ধির ফলে তা-ও ব্যর্থ হয় । অতঃপর শিবাজী সৈন্য সংগ্রহ করে মুঘলবাহিনীর সাথে সংঘর্ষের জন্য প্রস্তুত হন । ১৬৭০ খ্রিস্টাব্দে পুনরায় শিবাজীর সাথে মুঘলের সংঘর্ষ শুরু হয় । শিবাজী পুরন্দরের সন্ধি দ্বারা ( ১৬৬৫ খ্রিঃ ) মুঘলদের যেসব স্থান ও দুর্গ ছেড়ে দিয়েছিলেন , সেগুলি দখল করতে শুরু করেন । তিনি একে একে পুরন্দর , মাদুরা ও কোঙ্কন অধিকার করেন এবং কোঙ্কন থেকে মুঘল সুবাদারকে বহিস্কৃত করেন । ১৬৭৪ খ্রিস্টাব্দে শিবাজী স্বাধীন রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করেন এবং নিজে ‘ ছত্রপতি ’ উপাধি নেন । শিবাজীর মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র শম্ভুজীর সাথে ঔরঙ্গজেবের যুদ্ধ হয় । তবে তিনি ঔরঙ্গজেবের হাতে বন্দি ও নিহত হন । শম্ভুজীর মৃত্যুর পর তাঁর ভ্রাতা রাজারামের নেতৃত্বে মারাঠা-মুঘল সংঘর্ষ চলতে থাকে । রাজারামের মৃত্যুর পর তাঁর স্ত্রী তারাবাঈ মুঘল বিরােধী অভিযান চালিয়ে যেতে থাকেন । এমন অবস্থায় ঔরঙ্গজেবের মৃত্যু হয় ( ১৭০৭ খ্রিঃ ) ।
ঔরঙ্গজেবের দাক্ষিণাত্য নীতি এর সমালোচনা
ঔরঙ্গজেবের দাক্ষিণাত্য নীতি ব্যর্থ হয়েছিল । স্মিথ , এলফিনস্টেন প্রমুখের মতে , বিজাপুর এবং গােলকুণ্ডার বিলুপ্তি সাধন করে ঔরঙ্গজেব অদূরদর্শিতার পরিচয় দেন । এঁদের মতে , বিজাপুর ও গােলকুণ্ডার সাথে মারাঠাদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল । ফলে এই দুটি রাজ্য স্বাধীন থাকলে এরাই দাক্ষিণাত্যে মারাঠাদের অগ্রগতি রােধ করত । কিন্তু এ দুটি রাজ্য বিলুপ্তি হবার ফলে মারাঠাদের সাথে মুঘলের প্রত্যক্ষ সংঘাত অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়ে । তা ছাড়া এ দুটি রাজ্যের বিলুপ্তির ফলে এদের কর্মচ্যুত সৈন্যগণ মারাঠা বাহিনীতে যােগদান করে মারাঠা শক্তি বৃদ্ধি করে । ঔরঙ্গজেবের উচিত ছিল এই দুটি মুসলিম রাজ্যের সহায়তায় মারাঠাদের দমন করা , বা এই দুটি রাজ্যের সাথে মারাঠাদের দ্বন্দ্ব লাগিয়ে দিয়ে উভয়ের শক্তি খর্ব করা । কিন্তু যদুনাথ সরকার উপরিলিখিত যুক্তির বিরােধিতা করেছেন । তাঁর মতে , দাক্ষিণাত্যে রাজ্যজয়ের সূচনা করেছিলেন আকবর । ঔরঙ্গজেব তাকে পূর্ণতা দিতে চেয়েছিলেন মাত্র । তা ছাড়া , ঔরঙ্গজেব রাজত্বের প্রথম পর্বে বিজাপুর ও গোলকুণ্ডার মিত্ৰতালাভের চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন । পরন্তু এই দুটি রাজ্য এত হীনবল ছিল যে , মারাঠাদের প্রতিহত করা এদের পক্ষে ছিল দুঃসাধ্য । এই অবস্থায় বিধর্মী ও মারাঠাদের সহযােগী রাজ্য দুটি গ্রাস করে ঔরঙ্গজেব নতুন কিছু ভুল করেননি ।
ঔরঙ্গজেবের দাক্ষিণাত্য নীতির ফলাফল
ঔরঙ্গজেবের দাক্ষিণাত্য নীতি যে সামগ্রিকভাবে ব্যর্থ হয়েছিল এবং মুঘল সাম্রাজ্যের পতনকে ত্বরান্বিত করেছিল , এ বিষয়ে সন্দেহ নেই ।
প্রথমত , দাক্ষিণাত্যে দীর্ঘকালীন যুদ্ধে ঔরঙ্গজেব বহু অর্থ ও সৈন্য ক্ষয় করেন । দীর্ঘকাল যুদ্ধের ফলে মুঘল রাজকোষের বহু অর্থব্যয় হয় । ফলে সেনাবাহিনীর বেতন বাকি পড়ে এবং তারা সরকারের প্রতি অসন্তুষ্ট হয়ে পড়ে ।
দ্বিতীয়ত , সুদীর্ঘ পঁচিশ বছর দাক্ষিণাত্যে অবস্থান করার ফলে উত্তর ও মধ্য ভারতে সম্রাটের শাসন কর্তৃত্ব শিথিল হয়ে পড়ে । বিভিন্ন প্রাদেশিক শাসক ফৌজদার , দেওয়ান প্রভৃতি বিভিন্ন স্তরের কর্মচারী দুর্নীতিপরায়ণ ও স্বাধীনতাকামী হয়ে পড়ে । প্রদেশ থেকে কেন্দ্রে আসা রাজস্বের পরিমাণ অনেক কমে যায় । ফলে শাসনযন্ত্র দুর্বল হয়ে পড়ে ।
তৃতীয়ত , কেন্দ্রে সম্রাটের দীর্ঘ অনুপস্থিতির সুযােগে জাঠ , শিখ প্রভৃতি মুঘল বিরােধী জাতির উত্থান সহজতর হয় । একে একে এরা স্বাধীনতা ঘােষণা করে । এইভাবে অনর্থক দাক্ষিণাত্যে ব্যস্ত থেকে ঔরঙ্গজেব নিজের ও রাজ্যের সর্বনাশ ডেকে আনেন । স্মিথের ভাষায় — “ দাক্ষিণাত্য একই সাথে সম্রাটের দেহ ও সাম্রাজ্যের সমাধিস্থলে পরিণত হয়েছিল । ( ” The Decean was the grave of his body as well as of his empire . ” )। এই কারণে বলা হয়ে থাকে , “ স্পেনের যুদ্ধজনিত ‘ ক্ষত ’ যেমন নেপােলিয়নের পতন ডেকে এনেছিল , তেমনি দাক্ষিণাত্যে যুদ্ধজনিত ‘ ক্ষত ’ ঔরঙ্গজেবের পতন ডেকে এনেছিল ” ( ” As Spanish ulcer ruined Napoleon , so Deccan ulcer ruined Aurangzeb .” )।