ইতিহাস

শিখ সাম্রাজ্যের উত্থান

Contents

শিখ সাম্রাজ্যের উত্থান

index 6
শিখ সাম্রাজ্যের উত্থান

চতুর্দশ ও পঞ্চদশ শতকে ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে যে ধর্মসংস্কার আন্দোলন শুরু হয় , তারই সূত্র ধরে উত্তর-পশ্চিম ভারতে গুরু নানক তাঁর বাণী প্রচার শুরু করেন । গুরু নানকের শিক্ষা ও আদর্শকে ভিত্তি করেই শিখ ধর্মের উদ্ভব হয় এবং কালক্রমে এই শিখ সম্প্রদায় একটি শক্তিশালী , শৃঙ্খলাবদ্ধ বাহিনীতে পরিণত হয় । উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত পথ ধরে তুর্কি , আফগান , মােঙ্গল প্রভৃতি মুসলমান জাতি ভারতে প্রবেশ করেছে । ফলে ওই অঞ্চলে ইসলাম-সংস্কৃতি দ্রুত বিস্তার লাভ করে । পরন্তু হিন্দুধর্মের বাহ্যিক অনুষ্ঠানের কঠোরতা ও জাতিভেদ-প্রথা ওই অঞ্চলের পরিশ্রমী জাঠদের হিন্দুধর্মের প্রতি বীতশ্রদ্ধ করে তুলেছিল । এমতাবস্থায় গুরু নানকের উদার ধর্মমত খুব সহজেই পাঞ্জাববাসীদের আকৃষ্ট করে । 

শিখ গুরুগণ  

অবশ্য নানক স্বতন্ত্র কোনাে ধর্মমত প্রচারের উদ্দেশ্যেই তাঁর বাণী প্রচার করেছিলেন কিনা সে বিষয়ে পণ্ডিতদের মধ্যে মতভেদ আছে । কারও মতে , তিনি ছিলেন হিন্দুধর্মের সংস্কারক মাত্র । কারণ হিন্দুধর্মের আদর্শ বা ঐতিহ্যকে তিনি অস্বীকার করেননি । বেদ , পুরাণের দার্শনিক তত্ত্বের প্রতিও তিনি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন । তবে হিন্দুধর্মের বাহ্যিক আড়ম্বর , জাতিভেদ , অস্পৃশ্যতা প্রভৃতি কয়েকটি কুপ্রথার তিনি বিরােধিতা করেছিলেন । 

অঙ্গদ , অমর দাস , রামদাস :

গুরু নানকের মৃত্যুর পরে ( ১৫৩৮ খ্রিঃ ) যথাক্রমে গুরু অঙ্গদ ( ১৫৩৮ – ৫২ খ্রিঃ ) , গুরু অমর দাস ( ১৫৫২ – ৭৪ খ্রিঃ ) ও গুরু রামদাস ( ১৫৭৫-৮১ খ্রিঃ ) নানকের উত্তরাধিকারী মনােনীত হয় । তাদের সময়ে শিখগণ একটি বিশিষ্ট ধর্মীয় সম্প্রদায়ে পরিণত হয় । গুরু অঙ্গদের দুটি উল্লেখযােগ্য কৃতিত্ব হল গুরু নানকের বাণী ও উপদেশগুলিকে লিপিবদ্ধ করা এবং স্বতন্ত্র গুরুমুখী ভাষার প্রবর্তন করা । এ ছাড়া তিনি বিভিন্ন স্থানে একাধিক গুরু ‘ কালঙ্গর ’ ( গুরুদ্বার ) নির্মাণ করেন । গুরু অমরদাস -এর নেতৃত্বে শিখ-সংগঠন আরও শক্তিশালী হয়ে ওঠে । তিনি শিখ-পন্থ ( সম্প্রদায় ) -কে ২২ টি মঞ্জিতে ( Manjis ) বিভক্ত করে প্রতিটি মঞ্জির দায়িত্ব একজন করে ধর্মপ্রাণ শিখের উপর ন্যস্ত করেন । তিনি শিখদের সুরাপান নিষিদ্ধ করেন । গুরু রামদাস সম্রাট আকবরের কাছ থেকে প্রাপ্ত জমির উপর ‘ অমৃতসর ’ বা অমৃত সরােবর খনন করেন । এই সরােবরের তীরে শিখদের প্রধান মন্দির গড়ে ওঠে । এই শহর ‘ অমৃতসর ‘ নামে পরিচিত হয় । 

গুরু অর্জুন :

পঞ্চম গুরু অর্জুন ( ১৫৮১-১৬০৬ খ্রিঃ ) অমৃত সরােবরের মাঝে হরমন্দির তৈরি করেন এবং গুরু নানকের বাণী সংকলিত করে ‘ গ্রন্থসাহেব ’ রচনা করেন । তিনি অনুগামীদের স্বেচ্ছাদানের নির্দেশ দেন । যেসব শিখ এই অর্থ আদায় করতেন , তাঁদের উপাধি ছিল ‘ মসন্দ ‘ । এই অর্থাগমের ফলে শিখ-সংগঠনের আর্থিক ভিত সুদৃঢ় হয় । সেই সময় থেকেই শিখগণ রাজনীতির আবর্তে জড়িয়ে পড়তে বাধ্য হয় । গুরু অর্জুন জাহাঙ্গীরের বিদ্রোহী পুত্র খসরুকে আশ্রয় দান করেন । এই অপরাধে অর্জুনকে বন্দি করে আনা হয় ও অর্থদণ্ড করা হয় । কিন্তু তিনি অর্থ দিতে অস্বীকৃত হলে জাহাঙ্গীরের নির্দেশে হত্যা করা হয় । এই ঘটনা শিখপন্থকে মর্মাহত ও বিক্ষুব্ধ করে তােলে এবং তারা মুঘলের শত্রুতে পরিণত হয় । 

গুরু হরগোবিন্দ :

ষষ্ঠ গুরু হরগোবিন্দ ( ১৬০৬-৪৫ খ্রিঃ ) শিখদের সামরিক সংগঠনে পরিণত করতে উদ্যোগ নেন । তিনি নিজে ‘ সাচ্চা বাদশাহ ‘ উপাধি গ্রহণ করেন এবং শিষ্যদের কাছ থেকে অর্থের পরিবর্তে সামর্থ্য অনুযায়ী অশ্ব ও অস্ত্র সংগ্রহ করতে শুরু করেন । জাহাঙ্গীর হরগোবিন্দর সামরিক কার্যকলাপে শঙ্কিত হয়ে তাঁকে বন্দি করে গােয়ালিয়র দুর্গে আবদ্ধ করে রাখেন । কয়েক বছর পরে মুক্তি পেয়ে তিনি গােপনে শিখ-সংগঠনকে সংহত করতে থাকেন । শাহজাহানের রাজত্বকালে পুনরায় শিখ-মুঘল সংঘর্ষ শুরু হয় । কর্তারপুর ও অমৃতসর -এর যুদ্ধে শিখবাহিনী মুঘলের হাতে পরাজিত হয় । গুরু হরগোবিন্দ কাংড়ার পার্বত্য অঞ্চলে আত্মগােপন করে নিজেকে রক্ষা করেন । 

পরবর্তী গুরুদ্বয় যথাক্রমে হররায় ( ১৬৪৫-৬১ খ্রিঃ ) ও হরকিষেন ( ১৬৬১ – ৬৪ খ্রিঃ ) -এর সময়েও শিখ-মুঘল শত্রুতা অব্যহত থাকে ।

গুরু তেগ বাহাদুর :

শিখদের নবম গুরু ছিলেন তেগ বাহাদুর ( ১৬৬৪-৭৫ খ্রীঃ ) । তিনি শিখ-পন্থকে প্রচণ্ড শক্তিশালী করে গড়ে তােলেন এবং প্রকাশ্যে মুঘল বাদশাহ ঔরঙ্গজেবের হিন্দু বিদ্বেষী নীতির তীব্র সমালােচনা করেন । জিজিয়া করের বিরুদ্ধে তিনি আন্দোলন গড়ে তােলার ডাক দেন । ক্ষুব্ধ ঔরঙ্গজেব তেগবাহাদুরকে বন্দি করেন এবং ইসলামধর্ম গ্রহণ করতে আদেশ দেন । কিন্তু গুরু তেগবাহাদুর মৃত্যুবরণ করেও নিজধর্মের পবিত্রতা রক্ষা করেন । নবম গুরুর এই নির্মম হত্যা শিখদের মনে প্রবল প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে । 

গুরু গোবিন্দ সিংহ :

তেগবাহাদুরের মৃত্যুর পর শিখ-গুরু ( দশম ) হন তার পঞ্চদশবর্ষীয় পুত্র গােবিন্দ সিংহ ( ১৬৭৫-১৭০৮ খ্রিঃ ) । পিতার নৃশংস হত্যার জন্য মুঘলের উপর তার প্রচণ্ড ক্ষোভ ছিল । তিনি অনুভব করেন যে , সশস্ত্র প্রতিরােধ ছাড়া শিখজাতির অস্তিত্ব রক্ষা করা সম্ভব হবে না । তিনি এজন্য শিখপন্থকে নতুনভাবে সংগঠিত করেন । তিনি গুরু-পদের অবসান ঘােষণা করেন । তিনি জানান , খালসা’ই হবে গুরু এবং গুরু হল ‘ খালসা ’ , ‘ খালসা ’ কথার অর্থ পবিত্র । শিখজাতির এক সম্মেলন ডেকে তিনি ৫ জন শিখকে মনােনীত করেন । এঁদের নাম হয় ‘ পঞ্চপিয়ারে ’ । শিখধর্মে এঁরাই দীক্ষা দেবেন । দীক্ষাগ্রহণের পর প্রতিটি শিখই হবে ‘ খালসা’র সদস্য । 

মুঘলদের প্রতিহত করার জন্য তিনি আনন্দগড় , কেশগড় প্রভৃতি কয়েকটি দুর্গ নির্মাণ করেন এবং আনন্দপুর নামক স্থানকে সুরক্ষিত করে সেখানেই বসবাস শুরু করেন । আনন্দপুর শিখজাতির প্রধান কর্মকেন্দ্রে পরিণত হয় । 

আনন্দপুরের প্রথম যুদ্ধে ( ১৭০১ খ্রিঃ ) শিখবাহিনী জয়লাভ করে । কিন্তু দ্বিতীয় যুদ্ধে ( ১৭০৩ খ্রিঃ ) বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করেও শিখবাহিনী মুঘলের হাতে পরাজিত হয় । গােবিন্দ সিংহের দুই পুত্রকে হত্যা করা হয় । গুরু চক‌্মােতে তাঁর বাহিনীর সাথে মিলিত হন । মুঘলবাহিনী চক্‌মো আক্রমণ করে শিখবাহিনীকে আবার পরাজিত করে । এখানে গুরুর অপর দুই পুত্র নিহত হয় । গােবিন্দ সিংহ পাতিয়ালায় গিয়ে নতুন করে খালসাবাহিনী গঠন করেন । এখান থেকেই তিনি ঔরঙ্গজেবের উদ্দেশ্যে রচিত তার বিখ্যাত খােলা চিঠি ‘ জাফর-নামা ’ প্রকাশ করেন । পরে ঔরঙ্গজেব গুরু গােবিন্দ সিংহ বাহাদুর শাহের সাথে সাক্ষাৎ করেন । উভয়ের মধ্যে মিত্রতা স্থাপিত হয় । ১৭৮ খ্রিস্টাব্দে এক পাঠান আততায়ীর ছুরিকাঘাতে গােবিন্দ সিংহ নিহত হন । 

দশম গুরু গােবিন্দ সিংহের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে ‘ গুরু ’পদ বিলুপ্ত হলেও ‘ খালসা ’ ও শিখ-পন্থ শিখজাতিকে ঐক্যবদ্ধ করার কাজ চালাতে থাকে ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!