ইতিহাস

মুঘল যুগের স্থাপত্য শিল্প ও চিত্রকলা

Contents

মুঘল যুগের স্থাপত্য শিল্প ও চিত্রকলা

index 4
মুঘল যুগের স্থাপত্য শিল্প ও চিত্রকলা

মুঘল শাসকেরা ভারতে বিশাল ও স্থায়ী সাম্রাজ্য গঠনের সঙ্গে সঙ্গে তাকে অপরূপ স্থাপত্য শিল্প গঠনের দ্বারা সুসজ্জিত ও সমৃদ্ধ করেছিলেন । তাদের অধিকাংশ সৃষ্টি আজও বর্তমান এবং এ যুগেও তা সৌন্দর্য রসিকদের বিস্ময় সৃষ্টি করে ।  

মুঘল যুগের স্থাপত্য শিল্প

বিশিষ্ট সমালােচক ফারগুসন ( Fergussion ) -এর মতে , মুঘল যুগের স্থাপত্য শিল্প পারসিক স্থাপত্যশৈলীর দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছিল । মুঘল যুগে নির্মিত থামযুক্ত প্রাসাদ বা গম্বুজ প্রভৃতির সাথে পারসিক স্থাপত্যের অনেক মিল খুঁজে পাওয়া যায় । কিন্তু হ্যাভেল ( Havell ) -এর মতে , মুঘল স্থাপত্যকর্মে হয়তাে কিছু কিছু পারসিক স্থাপত্যকর্মের সাদৃশ্য পরিলক্ষিত হয় । কিন্তু তাই বলে এক পারসিক ধারার পুনঃপ্রকাশ বলে অভিহিত করা ঠিক নয় । তার মতে , মুঘল যুগে ভারতীয় শিল্পী ও স্থপতিগণ যথেষ্ট উৎকর্ষ লাভ করেছিলেন । তাই মুঘল-স্থাপত্যের উৎস ছিল ভারতীয় ঐতিহ্য । আবার আধুনিক ঐতিহাসিকগণ মুঘল-স্থাপত্যরীতিকে ভারতীয় ও পারসিক রীতির সংমিশ্রণে উদ্ভূত এক স্বতন্ত্র শিল্পকর্ম বলে অভিহিত করার পক্ষপাতী । কারণ মুঘল স্থাপত্যকর্ম সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন ও নতুন কোনাে সৃষ্টি নয় । সুলতানি যুগের স্থাপত্যশৈলী আরও পরিমার্জিত হয়ে মুঘল যুগে বিকশিত হয়েছিল । সম্রাটদের ব্যক্তিগত চিন্তাভাবনা ও উৎসাহ-উদ্দীপনার পরিপ্রেক্ষিতে তা নতুন থেকে নতুনতর রূপে বিকশিত হয়েছিল । যেমন আকবরের রাজত্বের শেষভাগ পর্যন্ত সময়ে ভারতীয় শিল্পে পারসিক প্রভাবের বাহুল্য ছিল , কিন্তু পরবর্তীকালে তা হ্রাস পেতে থাকে । জন্ মার্শালের  মতে , এই বিশাল ভারতবর্ষে একটিমাত্র রীতি অনুসৃত হত — একথা ভাবা ঠিক নয় । কারণ আঞ্চলিক বিভিন্নতাহেতু বিভিন্ন অঞ্চলের স্থাপত্যকর্মে বৈচিত্র্য থাকা ছিল অবশ্যম্ভাবী । 

বাবর :

বাবর ভারতীয় স্থাপত্য সম্পর্কে খুব বেশি উৎসাহী ছিলেন না । তাই তিনি কনস্টান্টিনােপল থেকে শিল্পী এনে এদেশে প্রাসাদ নির্মাণের উদ্যোগ নেন । তাঁর আমলে নির্মিত সৌধগুলির মধ্যে পানিপথের কাবুল-বাগ-মসজিদ এবং সম্বলের জামা মসজিদ উল্লেখযােগ্য । 

আকবর :

মুঘল-স্থাপত্যকর্মের প্রকৃত বিকাশ শুরু হয় সম্রাট আকবরের সময় থেকে । অবশ্য আকবর ভারতীয় ও পারসিক রীতির সংমিশ্রণে স্থাপত্য-নির্মাণে বেশি উৎসাহী ছিলেন । বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী আকবর নিজেই সৌধ বা প্রাসাদের পরিকল্পনা রচনা করতেন । সম্রাটের সমন্বয়ী আদর্শ তার স্থাপত্য-পরিকল্পনার মধ্যেও পরিলক্ষিত হয়েছিল । তাঁর আমলে উল্লেখযােগ্য সৌধ হল হমায়ুনের সমাধি । এর চার কোণে চারটি চুড়া ও মাঝখানে গম্বুজ ছিল । এটিতে পারসিক প্রভাবের বাহুল্য পরিলক্ষিত হয় । 

ফতেপুর সিক্রি :

আকবর নির্মিত প্রাসাদ ও দুর্গগুলিতে ইন্দো -পারসিক রীতির সংমিশ্রণ দেখা যায় । আকবর নির্মিত প্রাসাদ ও সৌধগুলির মধ্যে ‘ ফতেপুর সিক্রি ’, ‘ যোধাবাঈ মহল ‘ , ‘ বুলন্দ দরওয়াজা ’, ‘ জামা মসজিদ ’ , ‘ দেওয়ান ই খাস ‘ বিশেষ উল্লেখযােগ্য । ফতেপুর সিক্রীর সৌধগুলি নির্মাণে গুজরাটি ও বাঙালি শিল্পরীতির সাথে পারসিক শিল্পরীতির অপূর্ব সমন্বয় দেখা যায় । আকবর গুজরাট বিজয়কে স্মরণীয় করে রাখার উদ্দেশ্যে ফতেপুরে ‘ বুলন্দ দরওয়াজা ‘ নামে ১৭৬ ফুট উচ্চতা বিশিষ্ট একটি ফটক নির্মাণ করেন । ফতেপুর সিক্রির স্থাপত্যশৈলীর বর্ণনা প্রসঙ্গে লেনপুল  বলেছেন , ” Nothing sadder or more beautiful exist in India than deserted city , the silent Witness of a vanished adream . ” ফতেপুরের স্থাপত্য সৌন্দর্যকে ফারগুসন  বলেছেন , “ মহৎপ্রাণের প্রতিবিম্ব ‘ এবং ভি. স্মিথ  বলেছেন , পাথরে নির্মিত ‘ কল্পনা ও স্বপ্ন ‘ । সেকেন্দ্রাবাদে নির্মিত আকবরের সমাধি সৌধটির নির্মাণশৈলীর সাথে বৌদ্ধ বিহারের সাদৃশ্য আছে । ফারগুসন  এর সঙ্গে মহাবলীপুরমের রথমন্দিরের সাদৃশ্যের উল্লেখ করেছেন ।  

জাহাঙ্গীর :

ব্যক্তিগত ভাবে জাহাঙ্গীরের স্থাপত্য প্রীতি ছিল না । তবে সেই সময়ে নূরজাহানের উদ্যোগে আগ্রায় নির্মিত ইতমাদ-উদ-দৌলার সমাধিসৌধটি বিশেষ দর্শনীয় । এই সৌধের দেওয়ালগুলির ‘ বারােখ ’ নীতি অনুসারে মূল্যবান শ্বেতপাথর দ্বারা আচ্ছাদিত করা ছিল । পারসি ব্রাউন -এর মতে , ” Itmad-ud-daulali express in every part of it the high aesthetic ideals that prevailed among the Mughals at that time . ”

শাহজাহান :

মুঘল স্থাপত্যকর্মের চরমতম বিকাশ ঘটেছিল শাহজাহানের আমলে । আগ্রা , দিল্লি , কাশ্মীর , লাহাের প্রভৃতি বহু স্থানে তিনি অসংখ্য প্রাসাদ ও সৌধ নির্মাণ করেন । গঠন বৈশিষ্ট্য , কারুকার্য বা সামগ্রিক সৌন্দর্য — সব দিক থেকেই তার নির্মিত স্থাপত্যকর্মগুলি ছিল বিশিষ্ট ধরনের । শাহজাহান দিল্লিতে রাজধানী স্থানান্তরিত করে দিল্লিকে সুসজ্জিত করে তােলেন । লাল পাথরে নির্মিত সুবিশাল লাল কেল্লা শাহজাহানের অন্যতম প্রধান সৃষ্টি । এ ছাড়া ‘ দেওয়ান-ই-আম ’ , ‘ দেওয়ান-ই-খাস ‘ , ‘ জামা মসজিদ ’ , ‘ মতি মসজিদ ’ এবং ‘ আগ্রার তাজমহল ’ বিশেষ উল্লেখের দাবি রাখে । দেওয়ান – ই – খাসের কারুকার্য , জামি মসজিদের অলংকরণ , দেওয়ান – ই – আমের গঠন পরিকল্পনা আজও দর্শকের বিস্ময় সৃষ্টি করে । শিল্পদৃষ্টির বিচারে শাহজাহানের তাজমহল পৃথিবীর বিস্ময়রূপে চিহ্নিত । ফারগুসন -এর ভাষায় — “ এর ( তাজমহল ) তুলনা পৃথিবীতে নেই এবং এটি এমন এক সৃষ্টি , যা শিল্প সম্পর্কে উদাসীন ব্যক্তিকেও আকৃষ্ট করে । স্পেনীয় পর্যটক ফাদার মনরিখ  এর মতে , “ তাজের নকশা তৈরি করেছিলেন ভেরােনা নামক জনৈক ভেনেসীয় শিল্পী । ” কিন্তু এ মতের সমর্থন মেলে না । ফরাসি পর্যটক থেভেনট  – এর মতে , “ তাজমহল হল ভারতীয়দের সূক্ষ্ম শিল্পনৈপুণ্যের শ্রেষ্ঠ নিদর্শন । আব্দুল হামিদ লাহােরীর  মতে , “ তাজের গঠন পরিকল্পনা ও অভ্যন্তরীণ অলঙ্করণে প্রাচ্যদেশীয় ঐতিহ্য বিদ্যমান । তার মতে , ১২ বছর ধরে প্রায় ৫০ লক্ষ টাকা ব্যয়ে এই সৌধ নির্মিত হয়েছিল । কিন্তু অন্যান্যদের মতে , প্রায় ২২ বছর ধরে কয়েক শত শিল্পীর পরিশ্রমে এবং ৩ কোটি টাকা ব্যয়ে এই স্মৃতিসৌধ নির্মিত হয়েছিল ।

মুঘল স্থাপত্যের অবনতি  

ঔরঙ্গজেবের নিস্পৃহতার ফলে তার সময় থেকে স্থাপত্যকর্মের অবনতি ঘটতে থাকে । অবশ্য তিনিও কয়েকটি মসজিদ নির্মাণ করেছিলেন , তবে সেগুলি ছিল খুবই সাদামাটা ও অলঙ্কারবিহীন । 

মুঘল যুগের চিত্রকলা  

আকবরের আমলে মুঘল স্থাপত্য শিল্পের বিকাশ শুরু হলেও , চিত্রশিল্পের বিকাশ শুরু হয়েছিল বাবরের সময় থেকেই । মুঘল চিত্রশিল্পেও পারসিক , চৈনিক ও বাকি রীতির সাথে ভারতীয় রীতির অপূর্ব সমন্বয় সাধিত হয়েছিল । মুঘল চিত্রকলার বিষয় বৈচিত্র্য ছিল লক্ষণীয় । গাছ , জীবজন্তু , প্রাকৃতিক দৃশ্যাবলী , পৌরাণিক আখ্যানসমূহ ও ব্যক্তিগত প্রতিকৃতি প্রভৃতি নানান বিষয়ে মুঘলযুগে চিত্রাবলী অঙ্কিত হয়েছে । 

পারসিক প্রভাব 

বাবর ছিলেন প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অনুরাগী । ওইসব দৃশ্যাবলী অঙ্কনের জন্য তিনি দরবারে শিল্পী নিযুক্ত করেছিলেন । হুমায়ুন পারস্যে নির্বাসিত থাকাকালীন সে দেশের চিত্রশিল্পের প্রতি আকৃষ্ট হন । ভারতে প্রত্যাবর্তনের সময় তিনি পারস্যের দুই চিত্রশিল্পী মির সৈয়দ আলী ও খাজা আবদুস সামাদকে এদেশে নিয়ে আসেন । এঁরা পারসিক রীতিতে দস্তান- আমির হাজমা শীর্ষক চিত্রগুলি অঙ্কন করেন । 

সমন্বয়ী ভাবনা 

চিত্রশিল্পের প্রসারের জন্য আকবর আবদুস সামাদের নেতৃত্বে একটি স্বতন্ত্র বিভাগ স্থাপন করেন । তাঁর আমলে চিত্রশিল্পে হিন্দু-মুসলিম সংস্কৃতির অপূর্ব সমন্বয় দেখা যায় । তার আমলে প্রথম ১৭ জন শিল্পীর মধ্যে ১৩ জনই ছিলেন হিন্দু । তখন মুসলিম শিল্পীদের মধ্যে সামাদ , সৈয়দ আলী , ফারুক বেগ ছিলেন বিখ্যাত । হিন্দু চিত্রশিল্পীদের মধ্য উল্লেখযােগ্য ছিলেন তারাচাঁদ , জগন্নাথ , বসাবন , সানওয়াল প্রমুখ । আবুল ফজল -এর বিবরণ থেকে জানা যায় , আকবর সপ্তাহে অন্তত একদিন শিল্পীদের আঁকা চিত্রাবলী দেখতেন এবং তাদের উৎসাহিত করতেন । 

চিত্রকলার চরম উন্নতি

জাহাঙ্গীর ছিলেন চিত্রকলার প্রকৃত সমঝদার । রাজনৈতিক ও ধর্মীয় গোঁড়ামি থেকে মুক্ত করে চিত্রকলাকে প্রকৃতি শিল্পের পর্যায়ে উন্নীত করার জন্য তাঁর অবদান স্মরণীয় । তার আমলের বিখ্যাত শিল্পী ছিলেন আখারিজা , মহম্মদ নাদির , ওস্তাদ মনসুর , বিষেন দাস , কেশব , তুলসী প্রমুখ । জাহাঙ্গীরের সময়ে ভারতীয় চিত্রকলা ইরানীয় প্রভাবমুক্ত হয়ে সম্পূর্ণরূপে ভারতীয় হয়ে ওঠে । 

চিত্রকলার অবনতি  

প্রকৃতপক্ষে জাহাঙ্গীরের পরেই মুঘল চিত্রশিল্পের অবনতি ঘটতে থাকে । পারসি ব্রাউন -এর ভাষায় ও “ with his ( Jahangir ) passing , the soul of Mughal Painting also departed . ” কারণ শাহজাহান স্থাপত্যশিল্পের অনুরাগী হওয়ার ফলে চিত্রশিল্পের প্রতি ছিলেন উদাসীন । শাহজাদা দারা সিকোহ কিছুটা চিত্ররসিক ছিলেন ঠিকই , কিন্তু রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার ফলে তা কার্যকরী হয়ে উঠেনি । আর ঔরঙ্গজেব তাে ছিলেন সব শিল্পেরই বিরােধী । স্বভাবতই তার আমলে চিত্রশিল্পীরাও চিত্রাঙ্কনের পরিবেশ খুঁজে পাননি । পরন্তু তাঁর নির্দেশে পূর্বে অঙ্কিত বহু অমূল্য চিত্র নষ্ট করে দেওয়া হয়েছিল ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!