আকবরের শাসন ব্যবস্থার মূল বৈশিষ্ট্য

Contents

আকবরের শাসন ব্যবস্থার মূল বৈশিষ্ট্য

কেবল সমর বিজয়ী নেতা নয় , সুদক্ষ প্রশাসক হিসেবেও সম্রাট আকবরের নাম ভারত-ইতিহাসে উজ্জ্বল হয়ে আছে । আবুল ফজল  তাঁর ‘ আইনআকবরী ’ তে ‘ প্রজাদের সার্বিক উন্নয়ন , রাজ্যের নিরাপত্তা বিধান , আর্থিক শৃঙ্খলা স্থাপন ’ প্রভৃতিকে ‘ শাসন ’ -এর প্রকৃত উদ্দেশ্য বলে বর্ণনা করেছেন । 

images 2
আকবরের শাসন ব্যবস্থার মূল বৈশিষ্ট্য

আকবরের শাসন কাঠামােকে একটি ‘ কেন্দ্রীভূত রাজতন্ত্র ’ বলা যেতে পারে । শাসন ব্যবস্থার সর্বোচ্চে ছিলেন সম্রাট । তার ক্ষমতা ছিল অবাধ ও সীমাহীন । রাজা ‘ দৈব অধিকারী ’ বলে তিনি দাবি করতেন । তবে স্বৈরাচারী হলেও আকবর কখনও স্বেচ্ছাচারী ছিলেন না । তাঁর মতে , রাজার প্রধান কর্তব্য ছিল রাজ্যের নিরাপত্তা বিধান ও সার্বিক উন্নয়ন সাধন । তিনি ছিলেন প্রজাহিতৈষী স্বৈরাচারী রাজা । শাসন ব্যবস্থাকে সচল ও কার্যকরী রাখার জন্য তিনি অক্লান্ত পরিশ্রম করতেন । প্রত্যহ প্রাতে তিনি জনগণকে ‘ ঝরােখা দর্শন ’ দিতেন । এখানে তিনি ব্যক্তিগতভাবে জনগণের অভাব-অভিযােগ শুনতেন । তারপর ‘ দেওয়ান-ই-আমে ’ অনুষ্ঠিত প্রকাশ্য দরবারে উপস্থিত থেকে সম্রাট বিভিন্ন অভিযােগের নিষ্পত্তি করতেন । এর মাঝে বসত মন্ত্রীদের সাথে একান্ত আলােচনা আসর । এখানে তিনি উচ্চপদস্থ মন্ত্রী ও কর্মীদের সাথে প্রশাসনিক বিষয় আলােচনা করতেন । এ ছাড়া বিভিন্ন ধর্মাচার্যদের সাথেও তিনি বিভিন্ন ধর্মতত্ত্ব আলােচনা করতেন । এসব ঘটনা প্রমাণ করে যে , অপ্রতিহত ক্ষমতার অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও আকবর ‘ যৌথ-দায়িত্ব সম্পন্ন শাসন ব্যবস্থা ’ প্রবর্তন করেছিলেন । কেন্দ্রীয় শাসন ও কেন্দ্রীয় শাসনে সম্রাটকে সাহায্য করত কয়েকটি বিভাগ । এইসব বিভাগের দায়িত্বে থাকতেন মন্ত্রীগণ । সম্রাটের পরেই ছিল ‘ ভকিল ‘ বা প্রধান মন্ত্রীর স্থান । তবে ভকিল বৈরাম খাঁ’র বিদ্রোহজনিত অভিজ্ঞতা থেকে আকবর ভকিলের ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণে রাখার বিষয়ে সচেতন ছিলেন । ভকিল ছাড়া চারটি প্রধান দপ্তরের দায়িত্বে ছিলেন চার জন মন্ত্রী । এঁরা হলেন , 

( ১ ) দেওয়ান বা ওয়াজির

( ২ ) মীর বকশী

( ৩ ) মীর সামান এবং 

( ৪ ) সদর উসসুদূর । 

রাষ্ট্রের আয় ব্যয় , রাজস্বের হিসাব প্রভৃতি রাখার দায়িত্ব ছিল উজির বা দেওয়ান -এর । তিনি সম্রাটের সাথে পরামর্শক্রমে রাজ্যের অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণ করতেন । তবে আকবরের সময় উজিরের ক্ষমতা পূর্বের তুলনায় সংকুচিত হয়েছিল । অবশ্য উজির পদে কেবল সম্রাটের বিশ্বাসভাজন ও নিকটজনেরাই নিযুক্ত হতেন । ‘ মীর বকশী ’ ছিলেন সামরিক বিভাগের মন্ত্রী । পদমর্যাদায় তিনি ছিলেন দ্বিতীয় । তিনি সামরিক বাহিনীর নিয়ােগ , বাতিল , বেতন প্রদান প্রভৃতি বিষয়ে সম্রাটকে পরামর্শ দিতেন এবং সম্রাটের অনুমােদনক্রমে কাজ চালাতেন । সম্রাট কুচকাওয়াজ পরিদর্শনে গেলে তিনি তাকে সঙ্গ দিতেন । সাম্রাজ্যের সর্বত্র ছড়িয়ে থাকা গুপ্তচর বাহিনী যেসব খবরাখবর সংগ্রহ করতেন , মীর বকশী গুরুত্ব অনুযায়ী সেগুলি সম্রাটের গােচরে আনতেন । 

পদমর্যাদা অনুসারে তৃতীয় মন্ত্রী ছিলেন ‘ মীর সামান ’ । সম্রাট , তার পরিবার-পরিজন বা সরকার পরিচালনার জন্য নিত্য প্রয়ােজনীয় দ্রব্যাদির উৎপাদন ও বণ্টনে ভারপ্রাপ্ত ছিলেন মির সামান । 

চতুর্থ গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী ছিলেন সদর উসসুদূর । ইনি ছিলেন ইসলামধর্মীয় বিষয়াদি ও বিচার বিভাগের সর্বোচ্চ কর্মচারী । ইনি সম্রাটকে মুসলিম আইনের ব্যাখ্যা শােনাতেন । দাতব্য কর্ম পরিচালনা করতেন । ইনি প্রধান কাজি হিসেবে কার্যত বিচার পরিচালনা করতেন । ১৫৭৯ খ্রিস্টাব্দে ‘ মাহজার নামা ’ ঘােষণার পর এর কর্মদক্ষতা অনেক সংকুচিত হয়ে পড়ে । কারণ এই ঘােষণার দ্বারা সম্রাট স্বয়ং ইসলামি আইনের চূড়ান্ত ব্যাখ্যাকারীর ক্ষমতা বা সরকারি দানের ক্ষমতা অধিগ্রহণ করেন । প্রতিটি দপ্তরেই একাধিক সহকারী নিযুক্ত হতেন । উপরিলিখিত মন্ত্রীগণ ছাড়াও ‘ দারােগাগুসলখানা ’ , ‘ আরিজমুবারক ’ , ‘ মীর আরজ ‘ প্রভৃতি বহু কর্মী কেন্দ্রীয় শাসনে নিযুক্ত ছিলেন । 

প্রাদেশিক শাসন 

শাসনের সুবিধার্থে আকবর তার সাম্রাজ্যকে ১৫ টি সুবা বা প্রদেশে বিভক্ত করেন । প্রথম সুবার সংখ্যা ছিল বারাে , পরে তা বেড়ে দাঁড়ায় আঠারােতে । এ ছাড়া , তার অধীনে বহু স্বায়ত্তশাসিত সামন্ত রাজ্য ছিল । প্রতিটি সুবায় প্রশাসনিক প্রধান ছিলেন সুবাদার । প্রদেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষা এবং নিরাপত্তা বিধানের দায়িত্ব ছিল সুবাদারের । তিনি প্রাদেশিক সেনাবাহিনীর প্রধান ছিলেন । প্রতিটি সুবায় রাজস্ব-সংক্রান্ত বিষয়ে তত্ত্বাবধানের জন্য একজন করে দেওয়ান নিযুক্ত থাকতেন । দেওয়ান তার কাজের জন্য সরাসরি সম্রাটের কাছে দায়ী ছিলেন । দেওয়ান -এর উপর সুবাদারের কোনাে নিয়ন্ত্রণ ছিল না । দেওয়ান রাজস্ব আদায় করে কেন্দ্রে পাঠিয়ে দিতেন । আবার কেন্দ্র থেকে প্রদেশের খরচের অর্থ সুবারদের কাছে পাঠানাে হত । এর ফলে সুবাদার ও দেওয়ানের মধ্যে যেমন সংঘাতের সম্ভাবনা ছিল না , তেমনি এদের কারও পক্ষেই ক্ষমতাশালী হয়ে ওঠার সম্ভাবনাও ছিল না । রাজস্ব বিভাগে কর্মচারী নিয়ােগ এবং দেওয়ানি মামলার বিচারও  দেওয়ান নিষ্পত্তি করতেন ।

সুবাদার এবং দেওয়ান ছাড়াও প্রদেশগুলিতে বহু কর্মচারী নিযুক্ত হতেন । যেমন— বকশি , সদর , কাজি , ওয়াকিনবিস প্রমুখ । বকশি সামরিক ও বেসামরিক কর্মীদের বেতন প্রদান করতেন এবং ওয়াকিনবিসদের প্রেরিত সংবাদ সংগ্রহ করে কেন্দ্রে পাঠাতেন । সদর -এর কাজ ছিল সদর-ই-সুদূর -এর কাছে দাতব্য ও ধর্মীয় বিষয়ে সুপারিশ পাঠানাে । তিনি কাজি বা বিচারকের কাজও করতেন । ওয়াকিনবিস সংবাদ সংগ্রহ করতেন এবং মীর বাহার সামুদ্রিক ক্রিয়াকলাপ ও নদীপথ তত্ত্বাবধান করতেন । কোতোয়াল নামক কর্মচারী পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা বিষয়ের ভারপ্রাপ্ত ছিলেন । এককথায় কেন্দ্রীয় বিভিন্ন দপ্তরের অধীনে থেকে প্রাদেশিক দপ্তরগুলি কেন্দ্রের প্রতিনিধি হিসেবে প্রদেশে কাজ করতেন । 

স্থানীয় শাসন 

প্রতিটি সুবা কতকগুলি সরকার বা জেলায় বিভক্ত ছিল । ফৌজদার , আমাল গুজার , বিতিকচি , খাজনাদার , কোতােয়াল , কাজি প্রমুখ ছিলেন জেলায় প্রশাসনিক প্রধান । আইনশৃঙ্খলার তত্ত্বাবধানের সঙ্গে সঙ্গে তিনি যুদ্ধের প্রয়ােজনে ফৌজদার সামরিক বাহিনী পরিচালনা করতেন । তিনি মূলত ছিলেন সামরিক কর্মচারী । আমাল গুজারের কাজ ছিল রাজস্ব আদায় করে কেন্দ্রে পাঠানাে । তা ছাড়া , কৃষকদের ঋণদান ও তা আদায় করার কাজও তিনি করতেন । তাকে সাহায্য করতেন বিতিকচি । জমি জরিপ ও কর সংক্রান্ত কাগজপত্র বিতিকচি তৈরি করতেন । খাজনাদার ছিলেন কোষাধ্যক্ষ । তিনি আয়ব্যয়ের হিসাব করতেন । 

প্রতিটি সরকার বা জেলা কতকগুলি পরগনা ও মহকুমায় বিভক্ত ছিল । শিকদার পরগনার শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষা করা , বিচার ও সাধারণ প্রশাসনের কাজ দেখতেন । আমিল পরগনার রাজস্ব নির্ধারণ , জরিপ , রাজস্ব আদায় প্রভৃতি কাজ দেখাশােনা করতেন । ফৌজদার ছিলেন পরগনার কোষাধ্যক্ষ । কানুনগাে এবং কারকুনও রাজস্ব -সংক্রান্ত বিভিন্ন বিভাগ দেখতেন । তবে জেলাস্তরের কর্মচারীদের প্রধান কাজ ছিল রাজস্ব আদায় । পার্সিভ্যাল স্পিয়ার  তাই মন্তব্য করেছেন , “ গ্রামবাসীর কাছে সরকার ছিল মাত্র একটি রাজস্ব আদায়কারী সংস্থা …। ” 

রাজস্ব শাসন  

আকবরের আমলে সরকারি আয়ের প্রধান উৎস ছিল ভূমি রাজস্ব । রাজস্ব সংস্কারক রূপে আকবরের নাম বিশেষ উল্লেখযােগ্য । রাজস্ব সংস্কারে তিনি টোডরমল , শাহ মনসুর প্রভৃতি রাজস্ববিদদের সহযােগিতা লাভ করেন । টোডরমলের সুপারিশের ভিত্তিতে ১৫৮২ খ্রিস্টাব্দে আকবরের রাজস্বশাসনের মূল নীতি নির্ধারিত হয়েছিল । এই ব্যবস্থা অনুসারে প্রথমে সমস্ত জমিকে জরিপের ব্যবস্থা করা হয় । অতঃপর উর্বরতা অনুসারে জমিগুলিকে চারভাগে বিভক্ত করা হয় । যেমন — পােলজ , পারাউতি , চাচর এবং ব্যঞ্জর । যে জমিতে প্রতি বছর ফসল উৎপাদন হত , তাকে বলা হত ‘ পোলজ ‘। ‘ পারাউতি ’ ছিল সেইসব জমি , যেগুলিকে উৎপাদনের পর দু-এক বছর পতিত রাখতে হত । তিন বা চার বছর অন্তর ফসল দেওয়া জমি ছিল ‘ চাচর ’ এবং পাঁচ বা আরও বেশি বছর অন্তর ফসল হত যে জমিতে তাকে বলা হত ব্যঞ্জর । প্রথম তিন শ্রেণির জমিকে আবার উৎকৃষ্ট , মাঝারি এবং নিকৃষ্ট — এই তিন শ্রেণিতে বিভক্ত করা হত । এই তিন শ্রেণির উৎপাদনের গড়ের এক-তৃতীয়াংশ রাজস্ব হিসেরে ধার্য করা হত । রাজস্ব উৎপন্ন ফসলে কিংবা নগদ অর্থে দেওয়া যেত । টোডরমলের এই ব্যবস্থা ‘ জাবত ’ পদ্ধতি নামে পরিচিত । মুলতান , গুজরাট , বিহার , মালব ও রাজপুতানার একাংশে এই রাজস্ব-পদ্ধতি প্রচলিত ছিল । 

জাবত ’ পদ্ধতি ছাড়াও ‘ গল্লাবকস ’ ও ‘ নস‌্ক ‘ পদ্ধতিতে রাজস্ব আদায় করা হত । গল্লাবকস ব্যবস্থায় শস্যের একটি নির্দিষ্ট অংশ রাজস্বরূপে গৃহীত হত । সিন্ধু , কাশ্মীর ও কাবুলে এই ব্যবস্থা চালু ছিল । গল্লাবকস তিন রকমের ছিল , যেমন — রসি বাটাই ( শস্য কাটা পর ভাগাভাগি ) , ক্ষেত বাটাই ( বীজ বপনের পর জমি ভাগ ) এবং ল্যাক্স বাটাই ( উৎপাদিত শস্যের এক তৃতীয়াংশ ) । ‘ নস‌্ক ’ পদ্ধতি অনেকটা জমিদারি ব্যবস্থার মতাে ছিল । মােটামুটি অনুমানের উপর নির্ভর করে একটা রাজস্ব নির্ধারণ করা হত । আধুনিক পণ্ডিতেরা ‘ নস‌্ক ’ পদ্ধতিকে কোনাে বিশেষ পদ্ধতি না বলে রাজস্বের পরিমাণ বলে অভিহিত করার পক্ষপাতী । এই ব্যবস্থা বাংলাদেশে চালু ছিল ।  

মনসবদার 

আকবরের শাসন ব্যবস্থার প্রধান স্তম্ভ ছিল মনসবদারগণ । আকবর জায়গির ব্যবস্থা তুলে দিয়ে নগদ অর্থে বেতনের ব্যবস্থা করেন । মনসবদারগণ পদমর্যাদা অনুযায়ী নির্দিষ্ট সংখ্যক অশ্বারােহী সৈন্য সরকারি খরচে রাখতেন এবং প্রয়ােজনে ওই বাহিনী নিয়ে সম্রাটকে সাহায্য করতেন । কেবল যােগ্যতার ভিত্তিতেই মনসবদার নিযুক্ত হতেন । মনসবদার ছাড়াও আকবরের আহদী নামক নিজস্ব সেনাবাহিনী ছিল । পদাতিক , গােলন্দাজ , নৌবাহিনী -সহ এক বিরাট এবং সুদক্ষ ও শক্তিশালী সেনাবাহিনী আকবরের হাতকে শক্ত করেছিল । 

নিরপেক্ষতা 

আকবরের শাসন নীতির মৌল বৈশিষ্ট্য ছিল সার্বিক নিরপেক্ষতা । ধর্ম বা জাতি বৈশিষ্ট্য প্রশাসনের ক্ষেত্রে ছিল গুরুত্বহীন । জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সকলের জন্য তিনি ন্যায়বিচার প্রণয়ন করেন । শাসনপদে নিয়ােগের ক্ষেত্রেও কঠোর নিরপেক্ষতা অনুসরণ করেন । এইভাবে আকবর এমন এক শাসনকাঠামাে গড়ে তুলেছিলেন , যা ছিল দক্ষ এবং সচল ও কার্যকরী । শের শাহ প্রবর্তিত শাসন ব্যবস্থা আকবরের পথপ্রদর্শক হলেও , স্বকীয় দক্ষতায় তিনি একে বৃহত্তর ও মহত্তর প্রতিষ্ঠানে উন্নীত করতে সক্ষম হয়েছিলেন ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!