আকবরের ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থা
Contents
আকবরের ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থা

দিল্লি সুলতানির যুগে ইলতুৎমিস বা আলাউদ্দিন খলজি দেশের ভূমি ব্যবস্থা সম্পর্কে কিছু কিছু সংস্কার কর্মসূচি গ্রহণ করলেও , ভূমি রাজস্ব সংক্রান্ত সমস্যার কোনাে সমাধান হয়নি । প্রাচীনকাল থেকেই ভারতের ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থা পরীক্ষা নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে অগ্রসর হয়েছে । সেই পরীক্ষা নিরীক্ষার ক্ষেত্রে প্রথম ইতিবাচক পদক্ষেপ নেন শের শাহ । পরবর্তীকালে শের শাহ -র ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থাকে পরিবর্তন ও পরিবর্ধন করে সম্রাট আকবর তাকে একটি কার্যকরী ও যুক্তিসম্মত রূপ দিতে চেষ্টা করেন । এ বিষয়ে তিনি সম্পূর্ণ সফল হয়েছিলেন তা হয়তাে নয় ; কিন্তু মধ্যযুগীয় সীমাবদ্ধতার মধ্যেও তিনি যেসব সংস্কারের মাধ্যমে এবং গুরুত্বের সাথে ভূমি রাজস্ব প্রশাসনকে সক্রিয় করতে উদ্যোগ নিয়েছিলেন , তা প্রশংসার দাবি রাখে । ব্যক্তিগত উদ্যোগ ও চিন্তাভাবনা ছাড়াও রাজস্বনীতি নির্ধারণে আকবর শাহ মনসুর , টোডরমল প্রমুখ একাধিক রাজস্ব বিশারদদের সহায়তা লাভ করেন । প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে , আকবরের আমলেও সারা দেশে একই ধরনের রাজস্বনীতি অনুসৃত হত না । স্থানীয় বৈশিষ্ট্যের তারতম্য হেতু তা সম্ভবও ছিল না । তাই সাম্রাজ্যের বিভিন্ন অংশে প্রয়ােজনভিত্তিক স্বতন্ত্র ভূমি রাজস্ব বিধি প্রচলিত ছিল ।
কানুনগো
আকবরের রাজস্ব সংস্কারের মূল ভিত্তি ছিল জনকল্যাণের আদর্শ । প্রজাদের স্বার্থকে যথাসম্ভব সুরক্ষিত রেখে তিনি রাজকোষকে সমৃদ্ধ করার পক্ষপাতী ছিলেন । এ কারণে তিনি প্রথমে বাৎসরিক রাজস্ব নিরূপণের নীতি প্রবর্তন করেন । এই কাজে তিনি ‘ কানুনগো ’ নামক একশ্রেণির কর্মচারী নিয়ােগ করেন । কানুনগাে’রা একাধারে জমিদার ও রাজস্ব আদায়কারী সরকারি কর্মচারী হিসেবে দায়িত্ব পালন করত । কিন্তু জমিদারি ও কর -সংগ্রহ এই পরস্পর স্বার্থ বিরােধী দুটি দায়িত্ব একই হাতে থাকার ফলে শেষ পর্যন্ত এই ব্যবস্থা সফল হয়নি । তা ছাড়া , এ কাজে যে সততা ও নিষ্ঠার প্রয়ােজন ছিল , তা কানুনগােদের মধ্যে ছিল না ।
ক্রোরি
১৫৭৫-৭৬ খ্রিস্টাব্দে আকবর ‘ ক্রোরি ‘ নামক কর্মচারীদের উপর উত্তর ভারতে বিভিন্ন অংশের রাজস্ব নির্ধারণ ও আদায়ের দায়িত্ব দেন । প্রত্যেকের জন্য নির্দিষ্ট অঞ্চল থেকে ভূমি রাজস্ব হিসেবে এক কোটি দাম আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ধার্য ছিল বলে এদের ‘ এক কোটি দাম রাজস্ব-সংগ্রাহক ’ও বলা হত । ১৫৮০ খ্রিস্টাব্দে এই ব্যবস্থার পরিবর্তন করে তিনি ‘ দহশালা ’ বন্দোবস্ত ( আইন-ই-দহশালা ) ব্যবস্থা । প্রবর্তন করেন । এই ব্যবস্থায় জমির দশ বছরের উৎপাদনের গড়ের ভিত্তিতে বাৎসরিক রাজস্ব নির্ধারিত হত । আবার বাৎসরিক ফসলের পরিমাণ নির্ধারণ করার পর তার নগদ মূল্য নির্ধারণ করা হত । কারণ তখন নগদ মূল্যে রাজস্ব প্রদানের ব্যবস্থা ছিল । দশ বছরের মূল্যের গড় হিসাব করে নগদ রাজস্ব স্থির করা হত । এই ব্যবস্থার উৎপাদক ও সরকার উভয়ে দেয় রাজস্বের পরিমাণ ও প্রাপ্য রাজস্বের পরিমাণ পূর্বাহ্নে জানতে পারতেন বলে রাজস্ব প্রদানে বা আদায়ে খুব বেশি জটিলতা হত না । বন্যা , খরা ইত্যাদি কারণে রাজস্ব স্বাভাবিকভাবেই মকুব হত ।
জাবতি প্রথা
আকবরের ভূমি রাজস্ব নীতিনির্ধারণে উল্লেখযােগ্য ভূমিকা ছিল তার দেওয়ান টোডরমলের । গুজরাট বিজয়ের পর আকবর টোডরমলকে সেখানকার ভূমি ব্যবস্থা পুনর্গঠনের জন্য প্রেরণ করেন । তিনি সেখানকার প্রচলিত ভূমি ব্যবস্থার দোষগুণ পর্যালােচনা করে ১৫৮২ খ্রিস্টাব্দে এক সংশােধিত নীতি প্রবর্তন করেন ( দস্তুর অল-অমল ) । এই ব্যবস্থাই সাধারণভাবে ‘ টোডরমল বন্দোবস্ত ’ নামে পরিচিত । টোডরমলের রাজস্বব্য বস্থার কয়েকটি বৈশিষ্ট্য হল —
( ১ ) আবাদি জমির যথাযথ জরিপ করা ,
( ২ ) প্রতি জমির উৎপাদন ক্ষমতা স্থির করা এবং
( ৩ ) প্রতি বিঘা জমির রাজস্ব নির্ধারণ করা । জমি জরিপ করার জন্য তিনি ‘ ইলাহি গজ ’ নামক চেন প্রবর্তন করেন । তাঁর দ্বিতীয় সুপারিশ অনুসারে দেশের সমস্ত জমিকে উৎপাদিকা শক্তি অনুসারে চার ভাগে ভাগ করা হয় , যথা — পােলজ , পারাউতি , চাচর এবং ব্যঞ্জর । প্রতি বছর উৎপাদনক্ষম জমিকে বলা হত ‘ পােলজ ‘ । ‘ পারাউতি ‘ হল সেইসব জমি যা কয়েক বছর চাষের পর দু -এক বছর পতিত রাখতে হত । যেসব জমি তিন-চার বছর পতিত রাখতে হত , তাকে বলা হত ‘ চাচর ’। পাঁচ বছর বা তার থেকেও বেশি কাল পতিত পড়ে থাকা জমিকে বলা হত ‘ ব্যঞ্জর ’। প্রথম তিন শ্রেণির জমিকে উৎপাদিকা শক্তি অনুসারে উৎকৃষ্ট , মাঝারি ও নিকৃষ্ট — এই তিন শ্রেণিতে ভাগ করা হত । উৎপাদনের আনুমানিক গড় নির্ণয় করে শস্যের এক-তৃতীয়াংশ রাজস্ব হিসাবে ধার্য হত । ফসলের বাজারদরের সাথে সামঞ্জস্য রেখে নগদ অর্থেও রাজস্ব প্রদান করা যেত । জমির উৎপাদিকা শক্তি বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে রাজস্বের হারও বৃদ্ধি পেত । টোডরমলের এই ভূমি ব্যবস্থা ‘ জাবত ‘ ( Zabat ) প্রথা নামে পরিচিত ।
‘ জাবত ’ -প্রথায় কৃষকদের সাথে সরকারের সরাসরি বন্দোবস্ত হত । এক্ষেত্রে কোনাে মধ্যস্বত্ব ভােগী ছিল না । স্বভাবতই উৎপাদকদের অনর্থক শােষণ বা অত্যাচারের শিকার হতে হত না । রাজস্বের পরিমাণ অতিরিক্ত মনে হলে , কৃষক জমি পুনর্জরিপ বা রাজস্বের পরিমাণ পুনর্নির্ধারণের আবেদন জানাতে পারত । প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা অন্য কোনাে কারণে উৎপাদন ব্যাহত হলে রাজস্ব মকুবের প্রার্থনাও সহানুভূতির সাথে বিবেচনা করা হত । ‘ জাবত ’ – প্রথা প্রধানত মুলতান , রাজপুতানা , দিল্লি , মালব , বিহার প্রভৃতি অঞ্চলে প্রচলিত ছিল ।
গল্লাবকস
কোনাে কোনাে অঞ্চলে আকবর ‘ গল্লাবকস ‘ ( Gallabaksh ) ও নসক ( Nasak ) নামক দুটি স্বতন্ত্র রাজস্ব-পদ্ধতি প্রবর্তন করেছিলেন । ‘ গল্লাবকস ’ পদ্ধতি অনুযায়ী উৎপন্ন ফসলের একটি নির্দিষ্ট অংশ রাজস্ব হিসেবে ধার্য হত । রাজস্ব ধার্যের জন্য তিনটি প্রথা অনুসরণ করা হত , যেমন —
( ১ ) ফসল তােলার সময় দু-পক্ষের উপস্থিতিতে আলােচনার ভিত্তিতে ফসল ভাগাভাগি হত ।
( ২ ) জমিতে বীজ বপনের পরেই জমি উভয় পক্ষের মধ্যে বণ্টন করা হত ।
( ৩ ) উৎপন্ন শস্যের এক-তৃতীয়াংশ রাজস্ব হিসেবে সরকারকে দেওয়া হত । এই তিনটি পদ্ধতি যথাক্রমে ‘ রসিবাটাই ’ , ‘ ক্ষেত বাটাই ’ এবং ‘ ল্যাক্সবাটাই ’ নামে অভিহিত হত । রাজস্ব বিষয়ে ‘ গল্লাবকস ’ পদ্ধতি কাবুল , কান্দাহার , সিন্ধু , কাশ্মীর প্রভৃতি অঞ্চলে অনুসৃত হত ।
নসক
‘ নসক ’ পদ্ধতির সাথে ইজারাদারি ব্যবস্থার মিল খুঁজে পাওয়া যায় । এক্ষেত্রে জমির আয়তন বা উৎপাদন ক্ষমতার পরিবর্তে কিছুটা অনুমানের ভিত্তিতে রাজস্ব নিরূপণ করা হত । এই ব্যবস্থা মূলত বাংলাদেশে প্রচলিত ছিল । আবুল ফজলের বক্তব্য থেকেও জানা যায় যে , “ বাংলাদেশে কৃষিজাত ফসল ছিল সুলভ এবং মােটামুটি অনুমানের উপর ভিত্তি করে রাজস্ব নির্ধারিত হত । ”
মূল্যায়ন
ভিনসেন্ট স্মিথের মতে , “ The land – revenue administration of Akbar was almost rational and well considered . ” বস্তুত আকবরের ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থার মধ্যস্বত্বভােগীর অস্তিত্ব না থাকার ফলে কৃষকদের শােষিত হবার সম্ভাবনা কম ছিল । রাজস্বের পরিমাণ নির্দিষ্ট থাকার ফলে আদায়কারী সরকারি কর্মচারীরাও কৃষকদের কাছে অতিরিক্ত রাজস্ব দাবি করতে পারত না । আবার ঘন ঘন জমিচ্যুত হবার সম্ভাবনা ছিল না বলে , স্বাভাবিকভাবই কৃষকেরা জমির মানােন্নয়ন ও উৎপাদন বৃদ্ধির কাজে আত্মনিয়ােগ করতে পারত । অবশ্য সম্পূর্ণ ব্যবস্থাটার সাফল্য নির্ভর করছিল সরকারি কর্মচারীদের সততার উপর । আকবরের সদাসতর্ক নজর অবশ্যই একটা রক্ষা কবচের কাজ করছিল ।