মনসবদারি প্রথা
Contents
মনসবদারি প্রথা

মুঘল শাসন ব্যবস্থার একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য ছিল মনসবদারি প্রথার প্রচলন । আকবরের নেতৃত্বে এই প্রথা সুসংহত রূপ লাভ করে এবং মুঘল সাম্রাজ্যের প্রধান ভিত্তিতে পরিণত হয় । অবশ্য এই প্রথা আকবরের উদ্ভাবিত ছিল না । পারস্য দেশে এই প্রথা পূর্ব থেকেই প্রচলিত ছিল । দিল্লি-সুলতানির রাজত্বকালেও এই ধরনের প্রথা আংশিকভাবে চালু ছিল । তবে সম্রাট আকবর একে ‘ সুনির্দিষ্ট , সুবিন্যস্ত ও সুসংহত ’ করে গড়ে তুলেছিলেন ।
মনসবদারি প্রথার পটভূমি
আকবর সিংহাসন আরােহণকালে সারা দেশে জায়গির ব্যবস্থা প্রচলিত ছিল । তখন সামরিক ও বেসামরিক প্রয়ােজনে সম্রাটকে সাহায্য করার শর্তে বিভিন্ন ব্যক্তি নির্দিষ্ট জায়গির ভােগ করতেন । কিন্তু কালক্রমে এই ব্যবস্থা ত্রুটিপূর্ণ ও দুর্বল হয়ে ওঠে । কারণ এর ফলে সম্রাটের ‘ খালিসা ’ জমি ভীষণভাবে কমে যায় । ফলে সরকারের রাজস্ব-আয় ভীষণ কমে যায় ।
দ্বিতীয়ত , অধিকাংশ জায়গিরদারই দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়েন । তারা প্রয়ােজনে সম্রাটকে সেনা সাহায্য করতে ব্যর্থ হন । সাহায্য করলেও সৈন্যদের গুণগত ও সংখ্যাগত মান হত খুবই নিম্নস্তরের । জায়গিরদারির এইসব ত্রুটি দূরীকরণের জন্যই আকবর ব্যাপক ও কার্যকরীভাবে মনসবদারি ব্যবস্থা প্রবর্তন করেন ।
মনসব কথার অর্থ
‘ মনসব ’ কথার অর্থ পদমর্যাদা ( Rank ) । ঐতিহাসিক আরভিন এর মতে , মনসবদারি প্রবর্তনে আকবরের তিনটি প্রধান উদ্দেশ্য ছিল ,
( ১ ) ‘ মনসব ’ এর অধিকারীকে মুঘল সম্রাটের কর্মচারীরূপে প্রমাণিত করা ,
( ২ ) পদমর্যাদা অনুযায়ী মনসবদারদের বেতন নির্দিষ্ট করা এবং
( ৩ ) মনসবদারকে নির্দিষ্ট সংখ্যক পদাতিক ও অশ্বারােহী বাহিনী রাখতে এবং প্রয়ােজনে সম্রাটকে সাহায্য করতে বাধ্য করা ।
মনসবদারি প্রথার বৈশিষ্ট্য
অনেকের মতে , আকবর তার রাজত্বের অষ্টাদশ বৎসরে ( ১৫৩৭-৭৪ খ্রিঃ ) মনসবদারি প্রথা প্রবর্তন করেছিলেন এবং প্রথম থেকেই এটি ছিল স্বয়ংসম্পূর্ণ । কিন্তু আধুনিক গবেষকদের মতে , আকবর ‘ মনসব ’ – প্রথা প্রবর্তন করেছিলেন ঠিকই , তবে এটি বিভিন্ন পর্যায়ে সংশােধিত ও সংযােজিত হয়েছিল এবং ১৫৯৭ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ সম্পূর্ণ হয়েছিল । রাজত্বের অষ্টাদশ বৎসরে তিনি যখন মনসব প্রথা প্রথম প্রবর্তন করেন , তখন একটি সংখ্যাসূচক পদের দ্বারা বিভিন্ন মনসবদারের সৈন্যসংখ্যা ও পদমর্যাদা নির্দিষ্ট করা ছিল । এই নির্দিষ্ট সৈন্য মজুত রাখা এবং সম্রাটের প্রয়ােজনে যুদ্ধক্ষেত্রে উপস্থিত হওয়া বাধ্যতামূলক ছিল । কিন্তু বাস্তবে তা হত না । অধিকাংশ মনসবদারই নির্দিষ্ট সংখ্যার কম সৈন্য পােষণ করতেন । এই ত্রুটি দূর করার জন্য রাজত্বের চল্লিশতম বৎসরে আকবর মনসব ব্যবস্থায় ‘ জাট ’ ও ‘ সওয়ার ’ এই দুটি পদের প্রবর্তন করেন ।
জাট ও সওয়ার :
‘ জাট ’ ও ‘ সওয়ার ’ পদ দুটির প্রকৃত অর্থ নিয়ে মতভেদ আছে । ব্লকম্যান ( Blockmann ) -এর মতে , ‘ জাট ‘ অর্থে বােঝাত মনসবদারের মােট সেনা ( পদাতিক + অশ্বারােহী ) এবং ‘ সওয়ার ’ অর্থে বােঝাত কেবল অশ্বারােহী সেনার সংখ্যা । আরভিন এবং আব্দুল আজিজ -এর মতে , ‘ জাট ’ বলতে বােঝাত অশ্বারােহী সেনা এবং ‘ সওয়ার ’ বলতে বােঝাত অতিরিক্ত সেনা । কারও কারও মতে , ‘ জাট ’ ছিল সম্রাটের ব্যক্তিগত মর্যাদা এবং ‘ সওয়ার ’ ছিল তার অধীনস্থ সৈন্যের সংখ্যা ।
সৈন্য পােষণ ক্ষমতা অনুযায়ী মনসবদারদের আবার তিনটি শ্রেণিতে বিভক্ত করা ছিল । যেমন — যিনি ‘ জাট ’ মর্যাদার সমান সংখ্যক সওয়ার সৈন্য রাখতেন , তিনি ছিলেন প্রথম শ্রেণিভুক্ত , যিনি সামান্য কম সওয়ার সৈন্য রাখতেন , তিনি ছিলেন দ্বিতীয় শ্রেণিভুক্ত এবং যিনি নির্দিষ্ট সংখ্যার অর্ধেকেরও কম সওয়ার সৈন্য রাখতেন , তিনি ছিলেন তৃতীয় শ্রেণিভুক্ত মনসবদার ।
দাগ ও চেহারা :
সৈন্য সংখ্যা নির্দিষ্ট থাকলেও মনসবদারগণ মিথ্যাচারের আশ্রয় নিতেন । যেমন , অনেকে কমসংখ্যক সৈন্য পােষণ করতেন বা ভাড়া করা সৈন্য ও ঘােড়া নামাতেন বা সাধারণ লােককে পােশাক পরিয়ে সৈন্য হিসেবে যুদ্ধক্ষেত্রে পাঠাতেন । এই ত্রুটি দূরীকরণের জন্য আকবর ‘ দাগ ’ ( Branding ) ও ‘ চেহারা ’ ( তালিকা ) প্রথা চালু করেন । এই প্রথা অনুযায়ী বিভিন্ন মনসবের অধীনস্থ ঘােড়াগুলির শরীরে দাগ দেওয়া হত এবং সৈন্যদের দৈহিক বিবরণ লিপিবদ্ধ করা হত , যাতে একই ঘােড়া বা সৈন্য দুজন মনসবদার প্রদর্শন করতে না পারে ।
স্তর বিন্যাস :
আকবরের আমলে মনসবদারদের ৩৩ টি স্তরের প্রচলন ছিল । সর্বনিম্ন মনসবদারের সৈন্যসংখ্যা ছিল ১০ জন এবং সর্বোচ্চ ছিল ৫০০০ জন । ৭ হাজার , ৮ হাজার ও ১০ হাজারি কিছু মনসবদারি সম্রাটের বিশ্বাসভাজন ব্যক্তি বা রাজপুরুষদের মধ্যে দেওয়া ছিল ।
মনসবদারি প্রথা এর ত্রুটি
মনসবদারি প্রথা ত্রুটি যুক্ত ছিল এবং কালক্রমে এই ব্যবস্থা মুঘল সাম্রাজ্যের পতনের কারণ সৃষ্টি করেছিল । আরভিন – এর ভাষায় : “ The Mughal military system contained seeds of its own decay . ”
প্রথমত : মনসবদারি প্রথানুযায়ী স্বতন্ত্র মনসবের অধীনস্থ সৈন্যবাহিনীকে কার্যকরীভাবে ব্যবহার করা নির্ভর করত সম্রাটের ব্যক্তিগত দক্ষতার উপর । আকবরের পরবর্তী সম্রাটদের দুর্বলতার ফলে এই ব্যবস্থার কার্যকারিতা ক্ষুন্ন হয়েছিল ।
দ্বিতীয়ত : বিভিন্ন প্রতিষেধকমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হলেও মনসবদারগণ নির্দিষ্ট সংখ্যক এবং সক্ষম সৈন্য কখনােই পােষণ করত না । ফলে সৈন্যবাহিনীর দুর্বলতা প্রকট হতে থাকে ।
তৃতীয়ত : মনসবদারদের অভ্যন্তরীণ ঈর্ষা ও দ্বন্দ্ব এবং বড়াে মনসব লাভের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা তাদের পরস্পরের শত্রুতে পরিণত করেছিল । ফলে যুদ্ধক্ষেত্রে তার একাত্মভাবে যুদ্ধ করতে পারেনি ।
চতুর্থত : উচ্চ মনসবদারেরা কালক্রমে দরবারি রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন এবং সাম্রাজ্যের ভিতকে দুর্বল করে তােলেন ।