ইতিহাস

সুয়েজ সংকট

Contents

সুয়েজ সংকট

index 18
সুয়েজ সংকট

মিশর দেশের উত্তর-পূর্ব দিকে ইংরেজ ও ফরাসিদের তত্ত্বাবধানে খনন করা একটি খাল হল সুয়েজ খাল । ১৮৫৯ খ্রিস্টাব্দে ওই খাল খনন শুরু হলেও ১৮৬৯ থেকে এতে বাণিজ্যিকভাবে জাহাজ চলাচল শুরু হয় । সুয়েজ ক্যানাল কোম্পানি নামে এক সংস্থাকে একটি চুক্তির ভিত্তিতে ৯৯ বছরের জন্য খালটি পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হয় । কিন্তু মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ার আগেই ১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দের ২৬ জুলাই মিশরের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি গামাল আবদেল নাসের এক ঘােষণাবলে সুয়েজ খাল ও সুয়েজ ক্যানাল কোম্পানি — দুটিকেই জাতীয়করণ করে নেন । বিশ্বজুড়ে এই সমস্যাকেই সুয়েজ সংকট বােঝায় । 

সুয়েজ সংকটের কারণ 

ব্রিটেন ও ফ্রান্সের দায়িত্ব :

ব্রিটেন ও ফ্রান্স ইসরায়েলকে অস্ত্র সরবরাহের সিদ্ধান্ত নিলে আরব দেশগুলি ক্ষুব্ধ হয় ও নাসেরের সঙ্গেও পাশ্চাত্য দেশগুলির মনোমালিন্য শুরু হয় । আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ব্রিটেন ও ফ্রান্সই সুয়েজ খালের ওপর সবথেকে বেশি নির্ভরশীল ছিল । মার্কিন বিদেশ মন্ত্রী ডালেস যখন সুয়েজ খাল ব্যবহারকারী দেশগুলিকে নিয়ে এক সংস্থা গঠনের প্রস্তাব দেন তখনও ব্রিটেন ও ফ্রান্স সে প্রস্তাবে সাড়া দেয়নি । উলটে জাতিপুঞ্জে মিশর এই প্রস্তাব তুলে ধরলে ব্রিটেন ও ফ্রান্স সুয়েজ খালের ওপর আন্তর্জাতিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার দাবি জানায় , যা নাসেরের পক্ষে মেনে নেওয়া সম্ভব ছিল না । 

আসওয়ান বাঁধ নির্মাণ প্রকল্প :

নাসের চেয়েছিলেন মিশরের আর্থিক উন্নয়নের জন্য নীলনদের ওপর আসওয়ান বাঁধ নির্মাণ করতে । কেননা , এই বাঁধের সাহায্যে ৮ লক্ষ ৬০ হাজার হেক্টর জমিতে জলসেচ করে সেগুলি আবাদি জমিতে পরিণত করা যাবে । আবার এই বাঁধের জলাধার থেকে যে বিদ্যুৎ উৎপন্ন হবে তা শিল্পোন্নয়নে সাহায্য করবে । এই নির্মাণ প্রকল্পের মােট খরচ ধরা হয়েছিল ১ হাজার ৪ শত মিলিয়ন ডলার । ইংল্যান্ড , আমেরিকা ও বিশ্বব্যাংক মিলিত ভাবে এই প্রকল্পের জন্য ৭০ মিলিয়ন ডলার ঋণ দিতে রাজিও হয় । কিন্তু এক বছর আলােচনা চলার পর আমেরিকা ও ব্রিটেনের প্ররােচনায় বিশ্বব্যাংক ঋণ প্রস্তাব বাতিল করে দিলে নাসের প্রচণ্ড ক্ষুদ্ধ হন । 

নাসেরের পাশ্চাত্য বিরোধী মনোভাব :

নাসের কখনই চাননি ইজিপ্ট ( মিশর ) -এ ইংল্যান্ডের সৈন্যরা অবস্থান করুক । তাই তিনি ইংল্যান্ডকে চাপে রাখার জন্য সােভিয়েত সামরিক শক্তির সাহায্য জরুরি বলে মনে করেন । এই লক্ষ্যে তিনি একসঙ্গে জোট নিরপেক্ষ নীতি অবলম্বন করেন ও ইঙ্গ-মার্কিন গােষ্ঠীর বিরােধিতা শুরু করেন । তিনি কমিউনিস্ট চীনকেও স্বীকৃতি জানান । নাসেরের এই আচরণে ক্ষুব্ধ হয় ব্রিটেন ও ফ্রান্স । 

সুয়েজ খাল জাতীয়করণ :

ক্ষুদ্ধ নাসের সুয়েজ খাল এবং সুয়েজ ক্যানাল কোম্পানির জাতীয়করণ করেন ( ১৯৫৬ খ্রি. ২৬ জুলাই ) এবং ঘােষণা করেন এই সুয়েজ খাল থেকে আদায় করা অর্থ আসওয়ান বাঁধ নির্মাণে খরচ করা হবে । এর ঠিক তিনমাস পরে ( ২৯ অক্টোবর , ১৯৫৬ খ্রি. ) ব্রিটেন ও ফ্রান্সের গােপন প্ররােচনায় ইসরায়েল মিশর আক্রমণ করে ।

সুয়েজ সংকটের গুরুত্ব / ফলাফল  

১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দের সুয়েজ সংকট আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে এক অতি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা । 

আরব দুনিয়ার পশ্চিমী বিদ্বেষ :

প্রথম আরব-ইসরায়েল যুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সমেত পশ্চিমী শক্তিগুলি নিজেদের স্বার্থে নানাভাবে ইসরায়েলকে সাহায্য করেছিল । এমতাবস্থায় সুয়েজ সংকটকে কেন্দ্র করে মিশরের ওপর ইঙ্গ-ফরাসি আক্রমণ শুরু হলে মিশরসহ গােটা আরব দুনিয়ায় পশ্চিম বিরােধী মনােভাবের সৃষ্টি হয় । 

সুদৃঢ় আরব ঐক্য : 

পশ্চিম বিরােধী মনােভাব আরবদের আরও সংহত করে তােলে । তাদের ঐক্য আরও দৃঢ় হয় । মিশর ও সিরিয়া ঐক্যবদ্ধ হয়ে গঠিত হয় সংযুক্ত আরব প্রজাতন্ত্র । নাসের হন তার প্রথম রাষ্ট্রপতি ।

নাসের এর জনপ্রিয়তা : 

আরব জাতীয়তাবাদ শেষ পর্যন্ত জয়যুক্ত হলে নাসেরের আন্তর্জাতিক মর্যাদা বৃদ্ধি পায় । আরবদের মধ্যে তাঁর জনপ্রিয়তা শীর্ষে পৌছােয় । আরব জাতীয়তাবাদীদের কাছে নাসের বীরের সম্মান লাভ করেন । তিনি ‘ আধুনিক সালাদিন ’ উপাধিতে ভূষিত হন । নাসের জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের অন্যতম স্তম্ভে পরিণত হন । 

ব্রিটেনের মর্যাদা হ্রাস : 

সুয়েজ সংকটের পরিণতিতে যে দ্বিতীয় আরব-ইসরায়েল দ্বন্দ্ব বাঁধে তার জেরে মধ্যপ্রাচ্যে ব্রিটেন ও ফ্রান্সের কর্তৃত্বের অবসান ঘটে । ব্রিটেনের আন্তর্জাতিক মর্যাদা হ্রাস পায় । খােদ ব্রিটেনেই বিরােধিতার জেরে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী অ্যান্টনি ইডেন পদত্যাগ করতে বাধ্য হন । ফরাসি উপনিবেশ আলজিরিয়ায় ফ্রান্স বিরােধী মুক্তি সংগ্রাম তীব্র রূপ ধারণ করে এবং শেষ পর্যন্ত আলজিরিয়া স্বাধীনতা ফিরে পায় । 

শত্রুতা বৃদ্ধি : 

সুয়েজ সংকট মিশর ও ইসরায়েলের মধ্যে শত্রুতাকে চরমে নিয়ে যায় । ইসরায়েলকে কেন্দ্র করে মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতি আরও জটিল হয়ে ওঠে । 

পশ্চিমী শক্তিবর্গের মতভেদ : 

সুয়েজ সংকট পশ্চিমী দুনিয়ার ঐক্যে ফাটল ধরায় । মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইঙ্গ ফরাসি আক্ৰমণকে সমর্থন করেনি । 

দুই বৃহৎ শক্তির ঐকমত : 

এই সংকটকে কেন্দ্র করেই আমেরিকা ও সােভিয়েত ইউনিয়ন একমত হয়ে ব্রিটেন , ফ্রান্স ও ইসরায়েলকে যুদ্ধবিরতি ও সৈন্য অপসারণ করতে বাধ্য করেছিল । ঠান্ডা লড়াইয়ের যুগে এরকম ঘটনা খুব বেশি ঘটেনি । 

সোভিয়েতের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি :

সুয়েজ খাল জনিত সংকট থেকে পুরাে ফায়দা তােলে সােভিয়েত ইউনিয়ন । আরব-ইসরায়েল সংঘর্ষে নৈতিকভাবে আরবদের পাশে থাকায় আরব দুনিয়ায় সােভিয়েত ইউনিয়ন জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল । 

মিশরের কর্তৃত্ব : 

মিশর কর্তৃক সুয়েজ খাল জাতীয়করণকে আন্তর্জাতিক দুনিয়া স্বীকৃতি দিলে সুয়েজ খালের ওপর মিশরের কর্তৃত্ব দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয় । 

ইসরায়েলের মার্কিন নির্ভরতা বৃদ্ধি :

সুয়েজ সংকটের জেরে সংঘটিত দ্বিতীয় আরব ইসরায়েল যুদ্ধে ইসরায়েল আর্থিক ও সামরিক দিক থেকে প্রচণ্ড ক্ষতিগ্রস্ত হয় । এই ক্ষতি পূরণের জন্য ইসরায়েল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়ায় ।

সুয়েজ সংকট সমাধানের ক্ষেত্রে ভারতের ভূমিকা

সুয়েজ সংকট সৃষ্টির পর থেকেই ভারত এই সংকট সমাধানের উদ্যোগ নেয় । ভারত সুয়েজ খাল ব্যবহারকারী দেশ ছিল বলে , সুয়েজ সমস্যা সমাধানে ভারতের স্বার্থ জড়িত ছিল । সুয়েজ সংকট সমাধানে আগাগােড়া ভারতের ভূমিকা ছিল ইতিবাচক ।  

প্রাথমিক প্রচেষ্টা হিসেবে : 

সুয়েজ খাল ব্যবহারকারী দেশ হিসেবে নিজ স্বার্থেই ভারত সুয়েজ সমস্যা ( ১৯৫৬ খ্রি. ) সমাধানে এক অগ্রণী ভূমিকা পালন করে । ভারত সুয়েজ খালকে মিশরের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ বলেই মনে করে । তবে সেই সঙ্গে সে এ -ও মনে করত যে , খাল ব্যবহারকারীদের একটি উপদেষ্টামূলক ভূমিকা থাকা দরকার । 

বিদেশ মন্ত্রীর মাধ্যমে :

১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দের আগস্ট মাসে সুয়েজ সমস্যার সমাধানে লন্ডন সম্মেলনে মিশরের কোনাে প্রতিনিধি যােগদান না করায় ভারতের প্রতিনিধি বিদেশ মন্ত্রী কৃষ্ণমেনন দু -পক্ষের মধ্যে যােগসূত্রের ভূমিকা পালন করেছিলেন । সুয়েজ সংকট সমাধানের লক্ষ্যে কৃষ্ণমেনন পাঁচ দফা পরিকল্পনা পেশ করেন । তিনি সুয়েজ খাল ব্যবহারকারী দেশগুলির মধ্যে এক কমিটি গঠন করে সমস্যা সমাধানের কথা বলেন । তিনি মিশরের ওপরও খাল রক্ষার দায়িত্ব দেওয়ার কথা বলেন । 

প্রধানমন্ত্রীর মাধ্যমে : 

ব্রিটেন ও ফ্রান্সের প্ররােচনায় মিশরের ওপর ইসরায়েলের আক্রমণকে ভারত সরকার কঠোরভাবে নিন্দা করে । প্রধানমন্ত্রী নেহরু এটিকে এক ‘ নগ্ন আক্রমণ ’ বলে নিন্দা করেন । 

জাতিপুঞ্জে যােগদান : 

জাতিপুঞ্জের শান্তিরক্ষা বাহিনী হিসেবে ভারত মিশরে সেনা পাঠায় । যুদ্ধবিরতি কার্যকরী করার উদ্দেশ্যে জাতিপুঞ্জে আলাপ-আলােচনাকালে ভারত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!