ইতিহাস

তাইপিং বিদ্রোহ

Contents

তাইপিং বিদ্রোহ

index 14
তাইপিং বিদ্রোহ

আধুনিক চীনের গণতান্ত্রিক লড়াই ছিল তাইপিং বিদ্রোহ । উনিশ শতকের মধ্যভাগে যেসব গণবিদ্রোহ চীনের অভ্যন্তরীণ ইতিহাসে প্রভাব ফেলেছিল , তার মধ্যে অন্যতম ছিল তাইপিং বিদ্রোহ ( ১৮৫০-১৮৬৪ খ্রি. ) । ‘ তাইপিং ’ শব্দটির অর্থ হল মহতী শান্তি । আরও ব্যাপক অর্থে – সামাজিক সমন্বয় ( Great Social Harmony ) । কার্ল মার্কস  তাঁর ‘ রেভেলিউশান ইন চায়না অ্যান্ড ইন ইউরােপ ’ ‘ Revolution in China and in Europe ‘ প্রবন্ধে লিখেছেন — ইংরেজ কামানের সাহায্যে চীনের ওপর আফিম নামক ঘুমের নেশার বস্তু জোর করে চাপিয়ে দিতে চাইলে এই অভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপট রচিত হয় ( The occasion of this outbreak has unquestionably been afforded by English canon forcing upon China , that soporific drug called opium ‘ ) ।

তাইপিং বিদ্রোহের কারণ

নানা কারণে তাইপিং বিদ্রোহ সূচিত হয়েছিল । 

মাঞ্চু সরকার এর অপদার্থতা : 

অপদার্থ মাঞ্চু শাসনে চীন সামাজিক , অর্থনৈতিক , রাজনৈতিক ইত্যাদি সমস্যায় জর্জরিত ছিল । সরকারের এই দুর্বলতার সুযােগে স্বার্থান্বেষী ইউরােপীয় শক্তিগুলি তখন চীনের বুকে নিজেদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতা বিস্তারে ব্যস্ত হয়ে ওঠে । ঠিক এই সময় , চীনা জনসাধারণ মাঞ্চু শাসনের অবসান ও বিদেশি শক্তির শােষণের বিরুদ্ধে এক প্রবল বিদ্রোহ গড়ে তােলে ।

ধর্ম রাজ্য প্রতিষ্ঠার আহ্বান : 

তাইপিং বিদ্রোহ রাজনৈতিক আন্দোলনের রূপ পরিগ্রহ করলেও প্রথমে কিন্তু এটি ছিল একটি ধর্মীয় আন্দোলন । হাং সিউ চুয়ান নামে জনৈক পণ্ডিত দক্ষিণ চীনের কোয়াং টুং প্রদেশে নিজেকে ‘ স্বর্গীয় রাজা ‘ রূপে ঘােষণা করেন । হাং সিউ চুয়ান মাঞ্চু বংশের জায়গায় তাইপিং রাজবংশ প্রতিষ্ঠা করে চীনে একটি ধর্মরাজ্য স্থাপনের পরিকল্পনা গ্রহণ করেন । তাঁর প্রবর্তিত ধর্মের নাম হয় তাইপিং খ্রিস্টধর্ম । অল্পকালের মধ্যেই হাং -এর অনুগামীর সংখ্যা বাড়ে ও তারা পরিকল্পনা মতাে বিদ্রোহ ঘােষণা করে । 

আর্থ সামাজিক সংকট : 

দীর্ঘকাল চীনের আর্থ সামাজিক কাঠামাে ছিল অপরিবর্তিত । জনসংখ্যা ব্যাপক হারে বাড়লেও মাথাপিছু আবাদি জমির পরিমাণ বাড়েনি । দারিদ্র ক্লিষ্ট সাধারণ মানুষ মহাজনি ঋণের আবর্তে পড়ে সর্বস্বান্ত হয় । তাই মুক্তির জন্য বিদ্রোহের ডাকে তারা স্বাভাবিকভাবেই সাড়া দেয় । 

প্রশাসনিক দুর্নীতি : 

এই সময় চীনের প্রশাসন ছিল দায়িত্বজ্ঞানহীন ও দুর্নীতিগ্রস্ত । জনকল্যাণের কোনাে পরিকল্পনাই মাঞ্চু সরকার নেয়নি । অর্থের বিনিময়ে অযােগ্য ও অসৎ ব্যক্তিরা সরকারি পদ দখল করেছিল । প্রশাসনের প্রতি আস্থাহীন চীনা জনগণ তাই বিদ্রোহমুখী হয় । 

কৃষক অসন্তোষ : 

বিভিন্ন স্থানে গড়ে ওঠা কৃষক বিক্ষোভগুলি ছিল সেসময় চীনের একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য । অথচ মাঞ্চু সরকার কারণ অনুসন্ধান বা প্রতিকারের কোনাে চেষ্টা না করেই কঠোর দমননীতি গ্রহণ করে । ফলে কৃষক অসন্তোষ ক্রমেই বেড়ে গিয়ে বিদ্রোহের রূপ নেয় । 

প্রাকৃতিক বিপর্যয় : 

হোনান প্রদেশে খরা , হুপে ও কিয়াংসু প্রদেশে ইয়াংসি নদীর প্লাবন , কোয়াং সি প্রদেশে দুর্ভিক্ষ , সানটুং অঙুলে পীত নদীর গতি পরিবর্তন ইত্যাদি প্রাকৃতিক বিপর্যয় চিনাবাসীর মনােবল ভেঙে দেয় । ক্ষতিগ্রস্তদের ত্রাণ দেওয়ার ব্যাপারে সরকারের উদাসীনতা জনগণকে বিদ্রোহমুখী করে তােলে ।  

সেনাবাহিনীর অবক্ষয় :

নৈতিক অবক্ষয় চীনা সেনাবাহিনীকেও স্পর্শ করেছিল । শারীরিক সক্ষমতার অভাব ও নৈতিক মানের অবনতি সেনাবাহিনীকে দুর্বল করে তােলে । অপরদিকে মাঞ্চুবাহিনী থেকে কর্মচ্যুত সেনারা জীবিকার কারণে দস্যুবৃত্তি বেছে নেয় । ফলে চীনে ভয়ংকর বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয় । এই সুযােগে গুপ্ত সমিতিগুলি ও উচ্চাকাঙ্ক্ষী চীনারা মাঞ্চু শাসন বিরােধী বিদ্রোহ ঘটায় । 

অবশিল্পায়ন :

চীনের গ্রামীণ অর্থনীতির মূল উৎস ছিল বস্ত্রশিল্প । কিন্তু প্রথম আফিম যুদ্ধে চীন পরাজিত হওয়ায় নানকিং চুক্তির শর্তানুসারে চীনের পাঁচটি বন্দর বিদেশিদের জন্য খুলে দেওয়া হয় । এর ফলে বিদেশি সুতিবস্ত্রে চিনের বাজার ছেয়ে যায় । স্বাভাবিকভাবেই চীনে দেশীয় সুতিবস্ত্রের চাহিদা হ্রাস পায় এবং হস্তশিল্পী ও কারিগররা বেকার হয়ে পড়ে । এরা ক্ষুব্ধ হয়ে তাইপিং বিদ্রোহে যােগ দেয় ।

তাইপিং বিদ্রোহের সূচনা 

কোয়াং সি প্রদেশের জিন তিয়েন গ্রামে এক অনুষ্ঠানের মধ্যে দিয়ে তাইপিং বিদ্রোহের সূচনা ঘটে ( ১৮৫০ খ্রি. ) । এই সময় হাং -এর অনুগামীর সংখ্যা দাঁড়ায় প্রায় দশ হাজার । এদের মধ্যে ছিল দরিদ্র হাক্কা ( খ্রিস্টান ) কৃষক , কাঠকয়লা বিক্রেতা , খনি-মজুর , বহু প্রাক্তন জলদস্যু , কিছু ব্যবসায়ী , সম্পন্ন কৃষক , সরকারি কর্মচারী ও ক্যান্টনের কুলিরা । 

তাইপিং বিদ্রোহের প্রসার 

তাইপিং অনুগামীরা ১৮৫২ খ্রিস্টাব্দে কোয়াং সি ত্যাগ করে ইয়াংসি নদীর উত্তরে হূপেই অঞ্চলের দিকে অগ্রসর হয় । পথে অসংখ্য নিঃস্ব কৃষক স্বেচ্ছাচারী মাঞ্চু শাসন থেকে মুক্তি পেতে বিদ্রোহীদের পক্ষে যােগদান করে । অবশেষে ১৮৫৩ খ্রিস্টাব্দে তারা নানকিং অধিকার করলে হাং সেখানে তাঁর স্বর্গীয় সাম্রাজ্যের রাজধানী স্থাপন করেন । তখন থেকে তাই পিং আন্দোলন মাঞ্চু সরকার বিরােধী একটি রাজনৈতিক শক্তিতে পরিণত হয় । ১৮৬৪ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত এগারাে বছর নানকিং তাইপিং বিদ্রোহীদের দখলে থাকে । বিদ্রোহী নেতারা ঘােষণা করেন “ স্বর্গের নীচের সমস্ত জমিই স্বর্গের নীচের সব মানুষের … তাদের একসঙ্গে তা কর্ষণ করতে দাও । ” 

তাইপিং বিদ্রোহের প্রকৃতি 

তাইপিং বিদ্রোহের প্রকৃতি বিশ্লেষণে দেখা যায় — 

1. প্রথমে বুর্জোয়া শ্রেণি ও পরে কৃষকরা ছিল তাইপিং বিদ্রোহের মূল চালিকাশক্তি । 

2. এই বিদ্রোহের নেতৃবর্গ উঠে এসেছিলেন সমাজের একেবারে দরিদ্ৰশ্রেণি থেকে । 

3. জাতীয়তাবাদী আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে বিদ্রোহীরা মাঞ্চু বিরােধী জেহাদ ঘােষণা করেছিল ।

4. মাঞ্চু বিরােধী জাতীয়তাবাদী অঙ্গীকারে পাশ্চাত্যের আধুনিক ধারণার অনুপ্রবেশ ঘটেছিল । তাইপিং বিদ্রোহের মধ্য দিয়ে । 

তাইপিং বিদ্রোহের ফলাফল

তাইপিং বিদ্রোহের ফলাফল ছিল অত্যন্ত সুদূরপ্রসারী । 

1. আধুনিক চীনের ইতিহাসে তাইপিং বিদ্রোহ ছিল প্রথম বৈপ্লবিক সংগ্রাম । এই বিদ্রোহের মাধ্যমে বিদ্রোহীরা এই প্রথম একটি নিজস্ব সমান্তরাল রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে তুলেছিল । 

2. এই বিদ্রোহ চীনবাসীর সামনে একথাই তুলে ধরে যে চিনে আর মাঞ্চু শাসন প্রয়ােজন নেই । কেননা এই শাসকদের ব্যর্থতার সুযােগ নিয়েই বিদেশি শক্তি চীনের মূল ভূখণ্ডে প্রবেশ করার উৎসাহ পেয়েছে । 

3. তাইপিং বিদ্রোহের ফলস্বরূপ দীর্ঘকালীন কেন্দ্রীভূত শাসনব্যবস্থার বিকেন্দ্রীকরণ ঘটে । মাঞ্চুদের পরিবর্তে সাধারণ চীনারাও গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক পদে নিযুক্ত হতে শুরু করে ।  

4. এই বিদ্রোহের মাধ্যমে যে আদর্শ রাষ্ট্র ব্যবস্থার উদাহরণ সৃষ্টি হয় তা পরবর্তীকালের প্রগতিশীল ও আধুনিক চীনের পটভূমি রচনায় সাহায্য করে । 

5. চীনের কমিউনিস্ট নেতা মাও জে দঙ , আধুনিক চীনের জনক সান ইয়াৎ সেন সহ পরবর্তীকালের বহু চীনা নেতৃবৃন্দকে মহান চীন গঠনের আদর্শে উদ্বুদ্ধ করেছিল এই তাইপিং বিদ্রোহ । 

6. শুধুমাত্র চীনে নয় , ইউরােপেও তাইপিং বিদ্রোহীদের মহান আদর্শ ছড়িয়ে পড়েছিল । 

উপসংহার 

তাইপিং বিদ্রোহের গভীর প্রভাবের কথা স্মরণ করে এই আন্দোলনকে নিঃসন্দেহে ‘ বিপ্লব ’ বলা যেতে পারে । আর এই বিপ্লবই যে অদূর ভবিষ্যতে চীনকে এক মহাবিপ্লবের পথে এগিয়ে যেতে সাহায্য করেছিল , সে বিষয়ে কোনাে সন্দেহ নেই । ইস্রায়েল এপস্টেইন  এর মতে — তাই পিং অভ্যুত্থান বিশ্বের ইতিহাসে মানব মুক্তির অন্যতম এক মহান সংগ্রাম হিসেবে মানুষের চেতনায় জায়গা পাবে ( ‘ The Tai Ping uprising will take its place to the consciousness of all peoples as one of the world’s great wars for human freedom ‘ ) ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!