ইতিহাস

জেনেভা সম্মেলন

Contents

জেনেভা সম্মেলন

index 13
জেনেভা চুক্তি

দিয়েন বিয়েন ফু ঘটনায় ফরাসিদের ব্যর্থতার পর জেনেভা সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় ( ১৯৫৪ খ্রি. ৮ মে ) । ইন্দোচীন সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে ফরাসি প্রধানমন্ত্রী পিয়ের মেন্ডেস ফ্রাঁস জেনেভা সম্মেলন আহ্বান করেন । আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র প্রথম দিকে জেনেভা সম্মেলনের ব্যাপারে খুব একটা আগ্রহ না দেখালেও অবশেষে জেনেভা সম্মেলনের সিদ্ধান্তগুলিকে স্বীকৃতি জানিয়েছিল । জেনেভা সম্মেলনের চূড়ান্ত ঘােষণায় বলা হয় , সম্মেলন স্বীকার করে যে , ভিয়েতনাম সম্পর্কিত চুক্তির প্রকৃত উদ্দেশ্য হল যুদ্ধের অবসান ঘটানাের জন্য সামরিক প্রশ্নের একটা মীমাংসা করা । 

জেনেভা সম্মেলনের পটভূমি 

উত্তর ভিয়েতনামে দিয়েন বিয়েন ফু ( ১৯৫৪ খ্রি. ) -র শােচনীয় ব্যর্থতার পর ফ্রান্স আর ভিয়েতনামে যুদ্ধ চালাতে রাজি ছিল না । তার রাজি না হওয়ার পেছনে দুটি প্রধান কারণ ছিল । সেগুলি হল— 

1. মান-সম্মান বজায় থাকতে থাকতেই ফ্রান্স নিজেকে ভিয়েতনাম থেকে সরিয়ে নিতে চেয়েছিল । 

2. ইতিপূর্বেই জাতীয় নির্বাচনে ফ্রান্সে রাজনৈতিক পট-পরিবর্তন হয়ে গেছে । নতুন প্রধানমন্ত্রী পিয়ের মেন্ডেস ফ্রাঁস ছিলেন যুদ্ধবিরােধী । তিনি চেয়েছিলেন ইন্দোচিন সমস্যার সমাধান আলাপ-আলােচনার মাধ্যমে হােক । আর এ ব্যাপারে তিনি নিজেই উদ্যোগ গ্রহণ করেন । এই রকম এক প্রেক্ষাপটে কালবিলম্ব না করে দিয়েন বিয়েন ফু -তে ফরাসি বাহিনীর আত্মসমর্পণের পরদিনই ( ৮ মে , ১৯৫৪ খ্রি. ) জেনেভায় ইন্দোচিন সমস্যার সমাধানকল্পে একটি সম্মেলন বসে । এটিই জেনেভা সম্মেলন বা জেনেভা কনভেনশন বা জেনেভা চুক্তি ( ১৯৫৪ খ্রি. ) নামে পরিচিত । 

জেনেভা সম্মেলনের সদস্য রাষ্ট্রসমূহ

ইন্দোচিন সমস্যার সমাধানকল্পে আহূত জেনেভা সম্মেলনে আমেরিকা , ব্রিটেন , ফ্রান্স , চিন , ভিয়েতনাম , লাওস ও কাম্বােডিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা যােগদান করেন । অবশেষে ২০ জুলাই যুদ্ধবিরতি চুক্তি সম্পাদিত হয় ।

জেনেভা চুক্তির শর্ত

জেনেভা চুক্তির শর্তগুলি ছিল — 

1. ১৭° অক্ষরেখা বরাবর ভিয়েতনামকে দু ভাগে ভাগ করা হবে । 

2. ওই অক্ষরেখার উত্তরাঞ্চলে ভিয়েতমিন এবং দক্ষিণাঞ্চলে ফরাসি নিয়ন্ত্রণাধীন ন-দিন-দিয়েম এর শাসন প্রতিষ্ঠিত থাকবে । 

3. উত্তর বা দক্ষিণ ভিয়েতনামের কোথাও কোনাে বিদেশি সেনা থাকবে না । 

4. ভিয়েতনামের ওই বিভাজন হবে সম্পূর্ণ সাময়িক । শান্তিপূর্ণ উপায়ে দুই ভিয়েতনামের মিলনের জন্য একটি নির্বাচন আহ্বান করা হবে । 

5. ওই নির্বাচন জাতিপুঞ্জ গঠিত একটি তদারকি কমিশনের নেতৃত্বে দু বছর পরে ১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দের জুলাই মাসে অনুষ্ঠিত হবে । প্রসঙ্গত , ওই নির্বাচন তদারকির জন্য ভারতের নেতৃত্বে পােল্যান্ড ও কানাডাকে নিয়ে কমিশনটি গঠিত হয় । 

6. দুই ভিয়েতনামকে ঐক্যবদ্ধের লক্ষ্যে ১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দে গােপন ব্যালটে গণভােট নেওয়া হবে । 

7. জেনেভা সম্মেলনে যুগ্ম সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিল ব্রিটেন ও সােভিয়েত ইউনিয়ন । 

8. লাওস ও কাম্বােডিয়া থেকে ফরাসি ও ভিয়েতমিন সেনা অপসারিত হবে এবং ওই দুই দেশে ফরাসি শাসনের অবসান ঘটিয়ে পূর্বতন রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে । 

9. কাম্বােডিয়া , লাওস , উত্তর ও দক্ষিণ ভিয়েতনাম সরকার কোনােরকম সামরিক জোটে আবদ্ধ হবে না । 

10. ইন্দোচিনে কোনাে বিদেশি শক্তি হস্তক্ষেপ করতে পারবে না । 

11. যুদ্ধবিরতি তদারকের জন্য একটি আন্তর্জাতিক কমিশন গঠিত হবে ।

জেনেভা সম্মেলনের ফলাফল 

জেনেভা চুক্তি ( ১৯৫৪ খ্রি. ) দ্বারা ভিয়েতনাম সমস্যার সমাধান হয়নি । এই ব্যর্থতার পেছনে একাধিক কারণ ছিল । সেগুলি হল— 

নব অধ্যায়ের সূচনা : 

এই সম্মেলন ভিয়েতনাম যুদ্ধের একটা অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটালেও , আর একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা করে । সম্মেলনে ভিয়েতনামকে দু-ভাগে বিভক্ত করা হয় । ফলে ঐক্যবদ্ধতার প্রশ্নে ভিয়েতনামে নতুন সমস্যার সৃষ্টি হয় । 

সংকটের স্থায়িত্ব : 

জেনেভা চুক্তি অনুযায়ী দক্ষিণ ভিয়েতনাম থেকে ফরাসি শক্তি সরে গেলেও তার জায়গায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রবেশ করে । ফলে ভিয়েতনাম সংকট সমস্যাগ্রস্ত হয়েই থাকে । 

ঠান্ডা লড়াইয়ের কেন্দ্রবিন্দু :

স্টালিন সহ সােভিয়েত রাজনীতিবিদরা মনে করেছিলেন নিরপেক্ষ বলয়রূপে সমগ্র দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াকে সামরিক জোটের বাইরে রাখা যাবে । কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা সম্ভব হয়নি । ভিয়েতনাম ঠান্ডা লড়াইয়ের কেন্দ্রে রূপান্তরিত হয় । 

নির্বাচন ব্যবস্থার প্রতিরােধ : 

সম্মেলনের সিদ্ধান্ত অনুসারে রাষ্ট্রসংঘের তদারকি কমিশনের নেতৃত্বে ভিয়েতনামে নির্বাচনের ব্যবস্থা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্ররােচনায় ও দক্ষিণ ভিয়েতনামের অসহযােগিতায় বানচাল হয়ে যায় । ফলে জেনেভা সম্মেলনের মূল উদ্দেশ্যই ব্যর্থ হয় ।

জেনেভা সম্মেলনের গুরুত্ব 

আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে জেনেভা সম্মেলন ছিল এক গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ —

নিরপেক্ষ ও সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত গ্রহণ : 

জেনেভা সম্মেলনে স্বাক্ষরিত জেনেভা চুক্তি অনুযায়ী ভিয়েতনামে শান্তি প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে এক নিরপেক্ষ ও সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা সম্ভব হয়েছিল । 

শান্তি প্রতিষ্ঠা : 

বিশ্ব জুড়ে যখন ভয়াবহ রক্তক্ষয়ী যুদ্ধোন্মাদনার হাতছানি দেখা যাচ্ছে তখন শান্তি প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে চিন , ব্রিটেন , আমেরিকা এবং ফ্রান্সসহ বিভিন্ন দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র ভিয়েতনামে শান্তি প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে একজোট হচ্ছেন ; এটাই সেসময়কার আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে এক প্রশংসনীয় পদক্ষেপ বলা চলে । 

তৃতীয় বিশ্বের উত্থান : 

এই সম্মেলনে যেভাবে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিল তা পরবর্তীকালের আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে তৃতীয় বিশ্বের উত্থানের পথকে প্রশস্ত করেছিল । 

সাম্রাজ্যবাদ থেকে মুক্তি : 

জেনেভা সম্মেলনে স্বাক্ষরিত চুক্তির ফলে ভিয়েতনাম দীর্ঘ ফরাসি সাম্রাজ্যবাদের হাত থেকে মুক্ত হয় । এর পাশাপাশি লাওস ও কাম্বােডিয়া স্বাধীনতা ফিরে পায় । 

উপসংহার 

জেনেভা সম্মেলন কেবলমাত্র ভিয়েতনাম সমস্যার সমাধানের পদক্ষেপ নয় । এটি আন্তর্জাতিক রাজনীতির বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের উত্তরদানের প্রচেষ্টাও বটে । জেনেভা চুক্তির পরবর্তী সময়কালে ভিয়েতনামে শান্তি প্রতিষ্ঠার বদলে অশান্তির আগুন জ্বলে ওঠে । মুখে শান্তি প্রতিষ্ঠার কথা বললেও এখানে আমেরিকা তার সামরিক কর্মসূচি বজায় রাখে । এই চুক্তি থেকে ভিয়েতনামবাসীরা কোনাে সুফল পায়নি । এতদিন ফরাসি সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে রক্ত ঝরানাের পর এবার তাদের মার্কিন হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে আরও দীর্ঘস্থায়ী এবং রক্তক্ষয়ী সংগ্রামে লিপ্ত হতে হয় ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!