ইতিহাস

কোরিয়া সংকট কি

Contents

কোরিয়া সংকট কি

index 2
কোরিয়া সংকট

মাও জে দঙ -এর নেতৃত্বে চিনে প্রজাতন্ত্র গঠিত হওয়ার ( ১৯৪৯ খ্রি. অক্টোবর ) ৯ মাস পরে কোরিয়ার যুদ্ধ শুরু হয় ( ১৯৫০ খ্রি. ২৫ জুন ) । ১৯৪৫ সালে কোরিয়াবাসীর অনুমতি ছাড়াই কোরিয়াকে উত্তর ও দক্ষিণে ভাগ করা হয়েছিল । ৩৮° অক্ষরেখাকে দুই কোরিয়ার মধ্যে সীমারেখা হিসেবে ধার্য করা হয় । কায়রাে সম্মেলনে ( ১৯৪৩ খ্রি. ) কোরিয়াকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল । কিন্তু পরবর্তীকালে উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়ার ওপরে যথাক্রমে সােভিয়েত রাশিয়া ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাদের আধিপত্য কায়েম করলে কোরিয়া সংকট তীব্র হয়ে ওঠে । ঐতিহাসিক ডি. এফ. ফ্লেমিং তাঁর ‘ দ্য কোল্ড ওয়ার অ্যান্ড ইটস অরিজিন ’ গ্রন্থে লিখেছেন — মার্কিন নাগরিকদের কাছে কোরিয়ার যুদ্ধের উদ্বর্তপত্র অত্যন্ত নেতিবাচক ছিল ( —the balance sheet of Korean war was heavily negative ‘ ) 

কোরিয়া সংকটের সূত্রপাত 

কোরিয়া ১৯১০ খ্রিস্টাব্দ থেকেই জাপানের কর্তৃত্বাধীন ছিল । দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে মার্কিন সেনা ও সােভিয়েত লালফৌজ জাপানের হাত থেকে কোরিয়াকে মুক্ত করে । অবশেষে জাপান সম্পূর্ণরূপে পরাজিত হলে ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দের আগস্ট মাসে ৩৮° অক্ষরেখা বরাবর উত্তরাংশে সােভিয়েত রাশিয়ার ও দক্ষিণাংশে আমেরিকার নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয় । তখন স্বাভাবিকভাবেই উভয় শক্তি নিজ নিজ এলাকায় নিজেদের মতাদর্শ অনুযায়ী সরকার প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগী হয় । কিন্তু উত্তর কোরিয়ার সােভিয়েত সমর্থিত সেনাবাহিনী ৩৮ ° অক্ষরেখা বরাবর এগিয়ে দক্ষিণ কোরিয়ায় ঢুকলে কোরিয়া যুদ্ধের সূচনা ঘটে , যার অবসান ঘটে ১৯৫৩ খ্রিস্টাব্দের ২৭ জুলাই ।

কোরিয়া সমস্যা সমাধানে কমিশন গঠন 

১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বরে মস্কোয় রাশিয়া-মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মিলিত হয়ে এক যুগ্ম কমিশন গঠন করে । এই কমিশন কোরিয়ায় অস্থায়ী সরকার গঠন করবে বলে ঘােষণা করা হয় । কিন্তু আদর্শগত মতানৈক্যের কারণে যুক্তরাষ্ট্র তখন বিষয়টি রাষ্ট্রসংঘে উত্থাপন করলে সমস্যা সমাধানের জন্য সাধারণ সভা একটি অস্থায়ী কমিশন ( United Nations Temporary Commission on Korea ) গঠন করে ( সেপ্টেম্বর , ১৯৪৭ খ্রি. ) । ওই কমিশনের ওপর কোরিয়া থেকে বিদেশি সেনা অপসারণ এবং শান্তিপূর্ণ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে একটি জাতীয় সরকার প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব অর্পিত হয় । ভারতীয় কুটনীতিবিদ কে. পি. এস. মেনন ওই কমিশনের চেয়ারম্যান নিযুক্ত হন । 

দক্ষিণ কোরিয়ার সরকার গঠন

সােভিয়েত রাশিয়া কমিশনের সদস্যদের উত্তর কোরিয়ায় প্রবেশের অনুমতি দেয়নি । রাষ্ট্রসংঘ তখন নিজ তত্ত্বাবধানে দক্ষিণ কোরিয়ায় একটি নির্বাচনের আয়ােজন করে ( ১৯৪৮ খ্রি. ) । এরই প্রেক্ষিতে ওই বছর ১৫ আগস্ট প্রজাতান্ত্রিক কোরিয়া ( Republic of Korea ) নামে সেখানে মার্কিন প্রভাবিত একটি গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হয় । সিওল হয় এর রাজধানী । এই সরকারকেই রাষ্ট্রসংঘ সমগ্র কোরিয়ার একমাত্র বৈধ সরকার বলে স্বীকৃতি জানায় ( ১২ ডিসেম্বর , ১৯৪৮ খ্রি. ) । পরের বছর ১ জানুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রও প্রজাতান্ত্রিক কোরিয়া তথা দক্ষিণ কোরিয়াকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দান করে । এরই পরিপ্রেক্ষিতে যুক্তরাষ্ট্র সমস্ত দিক থেকেই দক্ষিণ কোরিয়াকে সাহায্য করতে থাকে । মার্কিন মদতপুষ্ট সিংম্যান রি ছিলেন এই সরকারের প্রধান ।

উত্তর কোরিয়ার আগ্রাসন 

দক্ষিণ কোরিয়াকে কেন্দ্র করে সুদূর প্রাচ্যে যখন একটি মার্কিন ঘাঁটি তৈরি হচ্ছে , তখন কোরিয়া সমস্যাকে আরও জটিল করে তােলেন উত্তর কোরিয়ার কমিউনিস্ট নেতা কিম – উল – সুং । সােভিয়েত মদতে তিনি সেখানে জনগণতান্ত্রিক কোরিয়া ( Peoples’ Democratic Republic of Korea ) নামে একটি সরকার গঠন করেন । পানমুনজম হয় এর রাজধানী । এই সরকারের সেনাবাহিনী কোনাে পূর্বাভাস ছাড়াই হঠাৎ ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দের ২৫ জুন ৩৮° অক্ষরেখা অতিক্রম করে দক্ষিণে প্রবেশ করলে দু-পক্ষের মধ্যে শুরু হয় প্রত্যক্ষ লড়াই । 

আন্তর্জাতিক সেনা প্রেরণ 

নিরাপত্তা পরিষদ উত্তর কোরিয়াকে আক্রমণকারী বলে চিহ্নিত করে এবং কোরিয়ায় রাষ্ট্রসংঘের সেনাবাহিনী পাঠানাের সিদ্ধান্ত নেয় । 

চীনের অংশগ্রহণ

রাষ্ট্রসংঘ প্রেরিত বাহিনীর প্রধান জে. ম্যাক আর্থার দক্ষিণ থেকে শত্রুসেনা বিতাড়িত করার পর ৩৮° অক্ষরেখা অতিক্রম করে উত্তর কোরিয়ায় প্রবেশ করেন । এতে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে পড়ে । কিন্তু এখানে না থেমে ম্যাক আর্থারের নেতৃত্বে রাষ্ট্রসংঘ বাহিনী চিন সীমান্তে ইয়ালু নদীর তীর পর্যন্ত অগ্রসর হয়ে সেখানে বােমাবর্ষণ করলে চীন তার তীব্র প্রতিবাদ জানায় । এরপরই চীন কোরিয়া যুদ্ধে যােগদান করে এবং অতি দ্রুত দক্ষিণ কোরিয়ার রাজধানী সিওল দখল করে নেয় ( ১৯৫১ খ্রি. ) । 

কোরিয়া যুদ্ধের অবসান 

মার্কিন রাষ্ট্রপতি ট্রুম্যান পরিস্থিতিকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য ম্যাক আর্থারকে বরখাস্ত করেন । এরপরই সােভিয়েত রাশিয়া উভয়পক্ষের মধ্যে সমঝােতা ও যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব দিলে যুদ্ধের গতি মন্থর হয়ে যায় । শেষ পর্যন্ত ১৯৫৩ খ্রিস্টাব্দের ২৭ জুলাই উত্তর কোরিয়ার রাজধানী পানমুনজমে উভয়পক্ষের যুদ্ধবিরতি ঘটে । পূর্বের মতাে ৩৮° অক্ষরেখা ধরেই দুই কোরিয়ার রাষ্ট্রসীমা নির্ধারিত হয় ।

কোরিয়া যুদ্ধের ফলাফল

কোরিয়া যুদ্ধের মূল উদ্দেশ্য আদৌ সফল হয়নি । এই যুদ্ধের ফলে — 

বিভাজন স্বীকার : 

বলপ্রয়ােগের মাধ্যমে দুই কোরিয়ার সংযুক্তি তাে দূরের কথা , উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়ার বিভাজনকেই মেনে নিতে হয় । 

মানবিক ও আর্থিক ক্ষতি : 

দীর্ঘস্থায়ী ওই যুদ্ধে দুই কোরিয়ারই প্রচণ্ড ক্ষতি হয় । মার্কিনি , কোরীয় , চিনা সব মিলিয়ে ২৫ লক্ষেরও বেশি মানুষ নিহত হয় । উত্তর ও দক্ষিণ উভয় অঞ্চলেরই অর্থনীতি বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে । 

আমেরিকার সামরিক শক্তি বৃদ্ধির প্রস্তুতি : 

যুক্তরাষ্ট্র এই যুদ্ধের সুযােগে চিনকে দুর্বল করতে চাইলেও তা পারেনি । তাই তখন থেকে সে তার সামরিক বাহিনীকে আরও শক্তিশালী করে গড়ে তােলার প্রস্তুতি নেয় । 

ঠান্ডা লড়াই এর বিস্তার :

এই যুদ্ধের ফলে ঠান্ডা লড়াই সমগ্র প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে বিস্তার লাভ করে । 

কোরিয়া যুদ্ধের গুরুত্ব

আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে কোরিয়া যুদ্ধ একাধিক কারণে গুরুত্বপূর্ণ — 

সামরিক জোট তৈরি : 

এই যুদ্ধের পর থেকেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ফিলিপিন্স , অস্ট্রেলিয়া , নিউজিল্যান্ড , জাপান , তাইওয়ান প্রভৃতি দেশের সঙ্গে একের পর এক সামরিক জোট প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগী হয় । 

রাষ্ট্রসংঘের মর্যাদা হ্রাস : 

এই যুদ্ধকে কেন্দ্র করে মার্কিন স্বার্থে রাষ্ট্রসংঘকে ব্যবহার করা হলে রাষ্ট্রসংঘের মর্যাদা হ্রাস পায় । 

শান্তি প্রতিষ্ঠা : 

এই যুদ্ধের প্রেক্ষিতেই ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দের নভেম্বরে রাষ্ট্রসংঘের সাধারণ সভা শান্তির জন্য ঐক্যবদ্ধ হওয়ার প্রস্তাব পাশ করেছিল । এই যুদ্ধ নিঃসন্দেহে পারমাণবিক অস্ত্রের যুগেও সীমিত যুদ্ধের ঐতিহ্য রক্ষা করেছিল । 

ঠান্ডা লড়াইয়ের সম্প্রসারণ : 

এতদিন পর্যন্ত ঠান্ডা লড়াই ইউরােপীয় ভূখণ্ডেই সীমাবদ্ধ ছিল । এখন এই যুদ্ধে সাম্যবাদী চিনের অংশগ্রহণের ফলে তা এশিয়া মহাদেশেও সম্প্রসারিত হয় । 

সোভিয়েত-চীন মৈত্রী প্রতিষ্ঠা :

এই যুদ্ধের প্রেক্ষিতেই সোভিয়েত ইউনিয়ন বিরােধী মার্কিন পররাষ্ট্রনীতি বৃহত্তর সাম্যবাদ বিরােধী রূপ গ্রহণ করে । এই যুদ্ধকে কেন্দ্র করেই সোভিয়েত-চীন মৈত্রী দৃঢ় হয় । 

উপসংহার 

কোরিয়ার যুদ্ধ প্রকৃত অর্থে ছিল অনাবশ্যক ও নিস্ফল , কেননা দীর্ঘস্থায়ী এই যুদ্ধের ফল ছিল শূন্য । ঐতিহাসিক পার্ল এস. বার্কের  মতে — কোরিয়ার যুদ্ধের জন্য এশিয়াবাসীর মন থেকে মার্কিন প্রীতি হারিয়ে যায় , যা আমরা হারাতে পারি না ( ‘ The Korean war … lost us ( Americans ) what we cannot afford to lose the mind of man in Asia ‘ )।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!