দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণ

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণ

images 5
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার মাত্র কুড়ি বছরের মধ্যেই আবার একটি বিশ্বযুদ্ধের সূচনা মানব জীবনকে বিপর্যস্ত করে তােলে । ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দের আগস্ট মাসের শেষ সপ্তাহে ‘ অস্থির শান্তি ’ পর্বের অবসানের পরিস্থিতি সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে । ১ সেপ্টেম্বর জার্মানি কর্তৃক পােল্যান্ড আক্রমণ ছিল বিশ্ববাসীর কাছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অশুভ সংকেত । আন্তর্জাতিক রাজনীতির ক্ষেত্রে এই মারাত্মক পরিণতির জন্য বহুবিধ উপাদান দায়ী ছিল । সােভিয়েত ঐতিহাসিক ভ্লাদিমির আলেকজান্দ্রভ  বলেছেন— “ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়েছিল সাম্রাজ্যবাদের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংঘাত থেকে ” ( The Second World War broke out owing to the aggravation of the economic and political contradiction of imperialism ) ।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরোক্ষ কারণ

ভার্সাই সন্ধির ত্রুটি : 

ভার্সাই চুক্তিপত্রের ৪৪০ টি ধারার বেশিরভাগ রচিত হয়েছিল জার্মানিকে স্থায়ীভাবে আর্থিক ও সামরিক দিক থেকে শক্তিহীন করে দেওয়ার উদ্দেশ্যে । জার্মানির সমরশক্তিকে বেলজিয়ামের মতাে অতি ক্ষুদ্র দেশের থেকেও কমিয়ে দেওয়া হয়েছিল । জার্মানির উপনিবেশগুলি ভাগ করে নিয়েছিল মিত্রশক্তি বর্গ । শুধু তাই নয় ভার্সাই চুক্তির দ্বারা জার্মানির ওপর বিশাল অঙ্কের ক্ষতিপূরণের বােঝা চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল । এর ফলে জার্মানি যুদ্ধমুখী হতে বাধ্য হয়েছিল । 

অতৃপ্ত জাতীয়তাবাদ : 

হিটলার চেয়েছিলেন পূর্ব ইউরােপে জার্মান সাম্রাজ্যের বিস্তার ঘটিয়ে জার্মানবাসীর জন্য লেবেনশ্রউম বা বাসস্থানের সম্প্রসারণ ঘটাতে । এই অতৃপ্ত জাতীয়তাবাদকে চরিতার্থ করতে নাৎসি দলের ক্ষমতা দখলের মধ্যে দিয়ে জার্মানিতে প্রাক্-বিশ্বযুদ্ধকালীন সামরিক তৎপরতা বৃদ্ধি পেয়েছিল । 

হিটলারের পররাষ্ট্রনীতি :

হিটলারের পররাষ্ট্রনীতির মূল উদ্দেশ্য ছিল জার্মানিকে ইউরােপের প্রধান শক্তিতে পরিণত করা । হিটলার বারবারই নিজ কূটনীতি প্রয়ােগের মাধ্যমে মিত্রশক্তিগুলির মধ্যে পারস্পরিক দ্বন্দ্বের সূচনা করেছিলেন এবং রুশ-জার্মান অনাক্রমণ চুক্তি স্বাক্ষরের মাধ্যমে সােভিয়েত ইউনিয়নকে এই জোট থেকে পৃথক করে ফেলতে সমর্থ হয়েছিলেন । অন্যদিকে হিটলার ফ্রান্স , পােল্যান্ড মৈত্রীতে ভাঙন ধরানাের জন্য ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দে পােল-জার্মান অনাক্রমণ চুক্তি স্বাক্ষর করেছিল । ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দে হিটলার পােল্যান্ড আক্রমণ করলে ইঙ্গ-ফরাসি জোট জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘােষণা করে । ই. এল. উডওয়ার্ড বলেন — দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ হিটলারের যুদ্ধ। তিনি এই যুদ্ধের পরিকল্পনা করেছিলেন । তিনি আরম্ভ করেছিলেন এবং শেষপর্যন্ত তিনিই পরাজিত হয়েছিলেন । 

উগ্র জাতীয়তাবাদ : 

হিটলার মনে করতেন — বিশ্বে একমাত্র জার্মানরাই বিশুদ্ধ আর্য রক্তের অধিকারী , তাই বিশ্বে জাতিগত দিক থেকে তারাই শ্রেষ্ঠ অর্থাৎ প্রভু জাতি বা হেরেনভক । এই কারণে অন্যান্য জাতির ওপর শাসন প্রতিষ্ঠা করার অধিকার রয়েছে জার্মানদের । হিটলারের এই হেরেনভক তত্ত্ব থেকে যে উগ্র সাম্রাজ্যবাদী নীতির জন্ম হয়েছিল , তা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকে অনিবার্য করে তুলেছিল । চেকোশ্লোভাকিয়া , পােল্যান্ড প্রভৃতি দেশে জার্মানির সুযােগমতাে অধিকার স্থাপনের প্রচেষ্টা বিশ্বযুদ্ধকে নিশ্চিত করে তুলেছিল ।

জাপানের আগ্রাসী নীতি : 

প্রাচ্য তথা এশীয় অংশে জাপানের ক্রম অগ্রগমন মিত্রশক্তির মনে আতঙ্কের সঞ্চার করেছিল । ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দে জাপানের মাঞ্চুরিয়া অধিকার তার সাম্রাজ্যবাদী নীতিরই পরিচায়ক ।  

ইতালি আগ্রাসন :

ইতালির আগ্রাসন ও পররাজ্য গ্রাস নীতি বিশ্বকে দ্রুত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দিকে ঠেলে দেয় । ইতালি কর্তৃক আবিসিনিয়া অধিকারের কোনাে প্রতিকার না হওয়ায় মুসােলিনির ক্ষমতা ও প্রভাব আরও বৃদ্ধি পায় , তাঁর আগ্রাসী মনােভাব বহুগুণ বেড়ে যায় । 

দুটি সামরিক শিবিরের স্বার্থ সংঘাত :

ভার্সাই চুক্তির অব্যবহিত পরেই ফ্রান্স ও ইংল্যান্ডসহ মিত্রশক্তি জোট এবং জার্মানি , জাপান ও ইতালির অক্ষশক্তি জোটের মধ্যে বাণিজ্যিক , ঔপনিবেশিক ও সাম্রাজ্যবাদী সংঘাত বিশ্বযুদ্ধের সম্ভাবনাকে বৃদ্ধি করেছিল । মুসোলিনির  মতে — দুই জগতের এই দ্বন্দ্বে আপসের কোনাে স্থান নেই , হয় আমরা নয় ওরা । 

ইঙ্গ ফরাসি তোষণ নীতি :

তােষণ নীতির দ্বারা ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স পশ্চিম ইউরােপের বদলে পূর্বে রাশিয়ার দিকে হিটলারের অবাধ সম্প্রসারণ চেয়েছিল । কারণ ওইসব ধনতন্ত্রী দেশগুলির কাছে নাৎসি জার্মানি বা ফ্যাসিবাদী ইতালির চেয়ে সমাজতন্ত্রী রাশিয়া ছিল অনেক বেশি বিপজ্জনক । তাই ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স চেয়েছিল হিটলারের জার্মানি ও মুসােলিনির ইতালিকে দিয়ে সােভিয়েত সাম্যবাদকে ধ্বংস করতে । কিন্তু এই তােষণ নীতি হিটলার তথা একনায়কদের শক্তিই শুধু বৃদ্ধি করেনি , তাদের আগ্রাসী মনােভাবকে তীব্র করে তুলেছিল । এ. জে. পি. টেলরের  মতে ইঙ্গ-ফরাসি তােষণ নীতি ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অন্যতম কারণ । 

আদর্শগত দ্বন্দ্ব : 

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়কালে ইউরােপের রাষ্ট্রগুলি আদর্শগত দিক থেকে পরস্পর বিরােধী দুই শিবিরে ভাগ হয়ে যায় । একদিকে ছিল ইংল্যান্ড , ফ্রান্স , মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রভৃতি গণতন্ত্রবাদী রাষ্ট্র । অপরদিকে ছিল ইতালি , জাপান , জার্মানি ও স্পেন প্রভৃতি স্বৈরতন্ত্রী রাষ্ট্র । আবার সােভিয়েত রাশিয়াতে ছিল সাম্যবাদী আদর্শ দ্বারা পরিচালিত সরকার । এদের বিভিন্ন আদর্শের দ্বন্ধ বিশ্বের রাজনৈতিক ভারসাম্যকে বিঘ্ন করে ও আন্তর্জাতিক উত্তেজনা বৃদ্ধি করে যুদ্ধের পরিবেশ সৃষ্টি করে । 

সমাজতান্ত্রিক ও ধনতান্ত্রিক ভাবধারার সংঘাত : 

সমাজতান্ত্রিক সােভিয়েত রাশিয়ার সঙ্গে ধনতান্ত্রিক ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের বারংবার ভুল বােঝাবুঝি ও পারস্পরিক সন্দেহপ্রবণতা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকে ত্বরান্বিত করে । হিটলার অনাক্রমণ চুক্তি দ্বারা রাশিয়াকে নিষ্ক্রিয় রাখলেও ইংল্যান্ডের দুর্বল নীতি যুদ্ধ ডেকে আনে । 

বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দা :

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পূর্বে বিশ্বজুড়ে যে অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দিয়েছিল , তার ফলে বিশ্ববাণিজ্য ও শিল্পায়ন প্রক্রিয়া দুর্বল হয়ে পড়ে । বিভিন্ন দেশে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি চরমে পৌঁছােয় । বেশ কিছু দেশ এই সমস্যার থেকে দেশবাসীর মুখ ঘুরিয়ে দেওয়ার জন্য যুদ্ধে যােগ দেয় । 

ঔপনিবেশিক লড়াই :

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর থেকেই ভার্সাই চুক্তির অধিকার বলে ইংল্যান্ড , ফ্রান্স , আমেরিকা বিশ্বের বেশিরভাগ উপনিবেশগুলি দখল করে নেয় । অপরদিকে ইতালি , জার্মানি ও জাপান দেরিতে হলেও নতুন নতুন উপনিবেশ দখলের কর্মসূচি গ্রহণ করে । ইতালি ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে উপনিবেশ বিস্তারে সচেষ্ট হলে ইঙ্গ ফরাসি স্বার্থে আঘাত লাগে । আবার জাপান প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে প্রভাব বাড়াতে চাইলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র শঙ্কিত হয়ে পড়ে । এভাবেই ঔপনিবেশিক স্বার্থসংঘাত যুদ্ধ পরিস্থিতি তৈরি করে । জার্মানির বিদেশমন্ত্রী রিবেনট্রপ বলেছিলেন — জার্মানি উপনিবেশ বিস্তারের অধিকারকে এক মৌলিক অধিকাররূপে দাবি জানাচ্ছে । ( ‘ Germany claims a fundamental right to colonial possessions ‘ ) ।

নিরস্ত্রীকরণ সম্মেলনের ব্যর্থতা : 

১৯৩২ খ্রিস্টাব্দে লিগের তত্ত্বাবধানে জেনেভায় নিরস্ত্রীকরণ সম্মেলন আহূত হয় । এই সম্মেলনে সমবেত প্রতিনিধিবর্গ সংকীর্ণ দেশীয় স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে বক্তব্য রাখতে পারেননি । তাই শেষ পর্যন্ত জার্মানি এই সম্মেলন ছেড়ে চলে যায় । এই সম্মেলনের ব্যর্থতা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অন্যতম কারণ ছিল । জাতিসংঘের চুক্তিপত্রের অষ্টম ধারায় উল্লিখিত ছিল — শান্তিরক্ষার্থে চুক্তিবদ্ধ সকল সদস্যরাষ্ট্রের আত্মরক্ষার প্রয়ােজনের সঙ্গে সংগতি রেখে যতদূর সম্ভব অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ করতে হবে । কিন্তু জাতিসংঘের কোনাে সদস্যরাষ্ট্রই তা না মানায় যুদ্ধ ত্বরান্বিত হয় ।

জাতিসংঘের ব্যর্থতা : 

লিগ বৃহৎ শক্তিবর্গের অন্যায় কাজের বিরুদ্ধে উপযুক্ত ব্যবস্থা নিতে দ্বিধান্বিত ছিল । ফলে বিশ্বের শান্তি ও নিরাপত্তার রক্ষক হিসেবে সদর্থক ভূমিকা পালন করতে ব্যর্থ হয় । ইতালির আবিসিনিয়া অধিকার , জাপানের মাঞ্চুরিয়া অধিকার এবং জার্মানির চেকোশ্লোভাকিয়া দখলের প্রতিকার করতে লিগ ব্যর্থ হয় । ফলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ঘটে । 

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রত্যক্ষ কারণ — হিটলারের পােল্যান্ড আক্রমণ 

রােম-বার্লিন-টোকিও অক্ষশক্তি গঠন হওয়ার পর হিটলার পােল্যান্ডের রাষ্ট্রসীমার মধ্যে দিয়ে ডানজিগ অঞ্চলের মধ্যে যােগাযােগের জন্য একটি সংযোেগ ভূমি বা পােলিশ করিডর দাবি করেন । ফ্রান্স ও ইংল্যান্ড এই ঘােষণার বিরােধিতা করে পােল্যান্ডের পক্ষ নেবে বলে হুমকি দেয় । এই হুমকিকে নস্যাৎ করে দিয়ে হিটলার পােল্যান্ড আক্রমণ করে বসেন ( ১৯৩৯ খ্রি. ১ সেপ্টেম্বর ) । এর দুদিন পর ( ৩ সেপ্টেম্বর ) ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স পােল্যান্ডের পক্ষে যােগ দিলে শুরু হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ । 

উপসংহার 

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের জন্য যুদ্ধরত দুই পক্ষের কূটনৈতিক ব্যর্থতাও কম দায়ী নয় । ইতালিতে ফ্যাসিবাদ , জার্মানিতে নাৎসিবাদ ও জাপানে জঙ্গিবাদের উত্থান বিশ্বশান্তি ও নিরাপত্তাকে বিপন্ন করলেও গণতান্ত্রিক দেশগুলি তা রক্ষার জন্য কোনাে উদ্যোগই নেয়নি ।

Leave a Reply

Your email address will not be published.

x
error: Content is protected !!