স্পেনের গৃহযুদ্ধের কারণ ও ফলাফল
Contents
স্পেনের গৃহযুদ্ধের কারণ ও ফলাফল

স্প্যানিশ আর্মাডার পতনের ( ১৫৮৮ খ্রি. ) পর স্পেনের গৌরব ধীরে ধীরে ম্লান হতে শুরু করে । ১৯ শতক নাগাদ স্পেন আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে এক দ্বিতীয় শ্রেণির শক্তিতে রূপান্তরিত হয় । ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দের জুলাই মাসে স্পেনে গৃহযুদ্ধ শুরু হয় আর শেষ হয় ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দের এপ্রিল মাসে । গৃহযুদ্ধে জয়ী হয়েছিল ফ্যাসিস্ট একনায়ক জেনারেল ফ্রাঙ্কোর দল । আর পরাজিত হয়েছিল নির্বাচিত সরকার অর্থাৎ প্রজাতন্ত্রী দল । ঐতিহাসিক ই. এইচ. কার স্পেনের গৃহযুদ্ধকে ইউরােপের গৃহযুদ্ধ বলেছেন ।
স্পেনের গৃহযুদ্ধের কারণ
প্রজাতান্ত্রিক দলের ক্ষমতা লাভ :
১৯৩০ খ্রিস্টাব্দের নির্বাচনে আলকালা জামােরার নেতৃত্বে ফ্রান্সে রাজতন্ত্রের অবসান ঘটিয়ে প্রজাতন্ত্রী দল প্রজাতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তন করে । প্রজাতান্ত্রিক সরকার আর্থসামাজিক পরিবর্তনের লক্ষ্যে বেশ কিছু প্রগতিশীল সংস্কার চালু করে । যেমন —
1. চার্চের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে সেগুলি কৃষকদের মধ্যে বিতরণ করা ,
2. শিল্প সংগঠনগুলিকে রাষ্ট্রায়ত্ত করা ,
3. সেনাবাহিনী পুনর্গঠন করা ,
4. চার্চের পরিচালনাধীন বিদ্যালয়গুলি বন্ধ করা ইত্যাদি ।
দক্ষিণ পন্থীদের ভূমিকা :
ফ্রান্সের দক্ষিণপন্থী শক্তিগুলি অর্থাৎ যাজক , রাজতন্ত্রী ও অভিজাত বর্গ প্রজাতন্ত্রের অবসান ও রাজতন্ত্রের পুনঃপ্রতিষ্ঠায় সচেষ্ট হয় । অপরদিকে সে সময়কার ফ্রান্সের উগ্র বামপন্থী গােষ্ঠী সিন্ডিক্যালিস্ট ও কমিউনিস্টগণ সােভিয়েত রাশিয়ার অনুকরণে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রগঠনে সচেষ্ট হয়ে ওঠেন । এমতাবস্থায় ১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দের নভেম্বরে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে উদারতন্ত্রী দল পরাজিত হয় । ক্যাথােলিক ও ব্যবসায়ীদের মিলিত দল ক্যাথােলিক পপুলার অ্যাকশন পার্টি জয়যুক্ত হয় । ক্ষমতা পেয়েই এরা প্রজাতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার পূর্বপ্রবর্তিত বিভিন্ন সংস্কার বাতিল করে দিতে শুরু করে । ফলে প্রজাতান্ত্রিকরা তীব্র বিরােধিতা শুরু করে । প্রেসিডেন্ট আলকালা জামােরা বাধ্য হয়ে পার্লামেন্ট ভেঙে দিয়ে পুনর্নির্বাচনের আদেশ দেন ।
পপুলার ফ্রন্ট এর ভূমিকা :
১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনে সমাজতান্ত্রিক , বামপন্থী , প্রজাতান্ত্রিক , সাম্যবাদী এবং নৈরাজ্যবাদী সিন্ডিক্যালিস্টরা এক জোট হয়ে পপুলার ফ্রন্ট গঠন করে । নির্বাচনে এই ফ্রন্ট জেতে এবং জোটের সমাজতান্ত্রিক দল সবথেকে বেশি আসন পায় । ফ্রন্টের তরফে প্রেসিডেন্ট হন ম্যানুয়েল আজানা , আর প্রধানমন্ত্রী হন স্যানটিয়াগাে কুইরোগা । পার্লামেন্ট জামােরাকে পদচ্যুত করে আজানাকে প্রেসিডেন্ট করে । এরপর থেকেই দক্ষিণপন্থী ও বামপন্থীদের সংঘাত চরম রূপ ধারণ করে ।
সেনাবাহিনীর ক্ষোভ :
গােটা দেশ জুড়ে অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করার জন্য সেনাবাহিনীকে হস্তক্ষেপ করতে হয় । জেনারেল ফ্রাঙ্কোর নেতৃত্বে বিদ্রোহীরা কয়েকটি সেনাদলের সঙ্গে মিলিত হয়ে স্পেনীয় মরক্কোর ওপর আধিপত্য বিস্তার করে । ফ্রাঙ্কো এরপর মরক্কো থেকে দক্ষিণ স্পেনে চলে এলে প্রজাতন্ত্রী সরকার ও বামপন্থীরা তাকে বাধা দেয় , শুরু হয় স্পেনের গৃহযুদ্ধ ।
ইউরোপীয় যুদ্ধে রূপান্তর
গৃহযুদ্ধটি স্পেনের মাটিতে হলেও এটির ইউরােপীয় গৃহযুদ্ধে রূপান্তর ঘটেছিল । স্পেনের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের সঙ্গে আসলে মিশে গিয়েছিল আন্তর্জাতিক দ্বন্দ্বের রেশ । সমকালীন ইউরােপের রাজনৈতিক পরিস্থিতি এই গৃহযুদ্ধকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল । তাই ডেভিড টমসন বলেছেন — ইউরােপে গণতন্ত্র বনাম একনায়কতন্ত্রের মধ্যে যে দ্বন্দ্ব চলেছিল তারই প্রতিফলন ঘটেছিল স্পেনের গৃহযুদ্ধে । যে কারণে গৃহযুদ্ধটি আন্তর্জাতিক রূপ পেয়েছিল সেটি হল — মুসােলিনি আবিসিনিয়া জয়ের পর পশ্চিম ভূমধ্যসাগর অঞ্চলে ইতালির অবস্থানকে আরও দৃঢ় ও স্থায়ী করার জন্য গৃহযুদ্ধকে কাজে লাগাতে চেয়েছিলেন । এক্ষেত্রে তাঁর লক্ষ্য ছিল স্পেনের নৌঘাটিকে ফ্রান্সের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা । অনুরূপভাবে জার্মানিও সাম্যবাদ প্রতিরােধে স্পেনের প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিতে সাহায্য করার সিদ্ধান্ত।
গৃহযুদ্ধে বিদেশি হস্তক্ষেপ
স্পেনের গৃহযুদ্ধের সূচনালগ্ন থেকেই ইতালি ও জার্মানি বিদ্রোহীদের সমর্থন করেছিল । ইতালি দেড় লক্ষ সেনা পাঠায় এবং জার্মানি ট্যাংক , বন্দুক , কামান ও অন্যান্য যুদ্ধাস্ত্র দিয়ে বিদ্রোহীদের সাহায্য করে । তুলনায় স্পেনের সরকার সেরকমভাবে বিদেশিদের কাছ থেকে সাহায্য পায়নি । স্পেনের সরকার তৎকালীন ফ্রান্সের প্রধানমন্ত্রী লিও রুম এবং ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বল্ডউইনের কাছে সাহায্য চেয়ে ব্যর্থ হয় । কেন না ব্রিটেন ও ফ্রান্স স্পেনের গৃহযুদ্ধ থেকে বিরত থাকার সিদ্ধান্ত নেয় ।
গৃহযুদ্ধের বর্ণনা
জাতীয়তাবাদী সমর্থকগণ মাদ্রিদ , ভ্যালেন্সিয়া , ক্যাটালােনিয়া — এসব অঞ্চলে তীব্র প্রতিরােধ গড়ে তুললে গৃহযুদ্ধ ভয়ংকর রূপ নেয় । স্পেনের সরকার বাধ্য হয়ে স্পেনের রাজধানী ভ্যালেন্সিয়া থেকে বার্সেলােনায় স্থানান্তরিত করে । প্রাণসংশয় দেখা দিলে স্পেনের প্রেসিডেন্ট আজানা প্যারিসে পালিয়ে গেলে সরকারি সেনারা আত্মসমর্পণে বাধ্য হয় । স্পেনের প্রতিক্রিয়াশীল সব শক্তি এসময়ে ফ্রাঙ্কোর পাশে দাঁড়ায় । স্পেনীয় সেনাবাহিনীর সর্বোচ্চ পদাধিকারী জেনারেল মিয়াজা স্পেনবাসীর কাছে শান্তির জন্য আবেদন রাখেন । এদিকে মাদ্রিদে কমিউনিস্টরা বিদ্রোহী হয়ে ওঠে । চারিদিকে শুরু হয় নির্বিচারে হত্যাকাণ্ড । সেনাপতি মিয়াজা মাদ্রিদ ছেড়ে চলে যান ।
স্পেনের গৃহযুদ্ধের অবসান
১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দে জাতিসংঘ স্পেন থেকে সকল বিদেশি সেনা সরিয়ে নেওয়ার জন্য প্রস্তাব গ্রহণ করে । কিন্তু জার্মানি বা ইতালি লিগের সদস্য না হওয়ায় এই প্রস্তাবকে অমান্য করে চলে । অবশেষে জেনারেল ফ্রাঙ্কো মাদ্রিদে প্রবেশ করে জাতীয়তাবাদী সরকার গঠন করেন ও স্পেনের রাষ্ট্রপ্রধান হয়ে ওঠেন । ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দের এপ্রিলে প্রায় তিন বছর ধরে চলতে থাকা রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধের অবসান ঘটে ।
স্পেনের গৃহযুদ্ধের গুরুত্ব বা ফলাফল
স্পেনের গৃহযুদ্ধের গুরুত্ব বা ফলাফল ছিল অত্যন্ত সুদূরপ্রসারী ।
ফ্যাসিবাদী শক্তি বৃদ্ধি :
ফ্রাঙ্কোর নেতৃত্বে স্পেনে ফ্যাসিস্ট সরকার প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় আন্তর্জাতিক আঙিনায় ফ্যাসিবাদী জোট আরও শক্তিশালী হয় ।
সমর দক্ষতা যাচাইয়ে :
জার্মানি ও ইতালি এই গৃহযুদ্ধ থেকে ফায়দা লােটে । হিটলার এই গৃহযুদ্ধে যােগ দিয়ে তাঁর বিমান বাহিনীর দক্ষতা ও মারণাস্ত্রের ক্ষমতা যাচাই করে নেন ।
পাশ্চাত্য দেশগুলোর সাম্যবাদ ভীতি :
এই যুদ্ধ প্রমাণ করে পাশ্চাত্য দেশগুলি ফ্যাসিবাদ ও নাৎসিবাদের চেয়েও সােভিয়েত সাম্যবাদকে বেশি ভয় করে ।
জার্মানি ইতালি সম্পর্ক :
এই গৃহযুদ্ধ জার্মানি ও ইতালির সম্পর্ককে ঘনিষ্ঠ করে , যার ফলশ্রুতি রোম বার্লিন অক্ষ চুক্তি ।
জাতিসংঘের ব্যর্থতা :
স্পেনের গৃহযুদ্ধে জাতিসংঘের হতাশাজনক ভূমিকায় এর ব্যর্থতাই ফুটে ওঠে ।
উপসংহার
স্পেনের গৃহযুদ্ধের মধ্যে দিয়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়ংকর রূপটি প্রকাশ পায় । দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ প্রায় নিশ্চিত এটাও বােঝা যায় । এই গৃহযুদ্ধে ইউরােপের প্রায় সকল দেশই জড়িয়ে পড়ায় একে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মহড়া ( Stage rehearsal of the Second World War ) বলা হয় ।
Best writing
Very good but keep it up