ইতিহাস

জাতিসংঘের ব্যর্থতার কারণ কি

Contents

জাতিসংঘের ব্যর্থতার কারণ কি

১৯২০ খ্রিস্টাব্দে বিশ্ব শান্তি ও নিরাপত্তার জন্য লিগ অব নেশন্স বা জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠিত হলেও কার্যক্ষেত্রে তা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয় । জাতিসংঘ মাত্র ২০ বছর স্থায়ী হয়েছিল । জাতিসংঘের প্রতিষ্ঠার সময় রবীন্দ্রনাথ  বলেছিলেন— “ এটা লিগ অব নেশন্স হবে না । হবে লিগ অব রবারস । ” ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দের পর সত্যি সত্যিই ইউরােপ এবং জাপানে এই দস্যুশক্তির নগ্ন আত্মপ্রকাশ দেখা গিয়েছিল । রুমানিয়ার রাজনীতিবিদ টিটু লেসু  বলেছেন — জাতিসংঘের ব্যর্থতার জন্য লিগের চুক্তিপত্র দায়ী নয় ; দায়ী মানুষই ( ‘ If the League has miscarried , the fault was not in the covenant , but in man ‘ ) ।

লিগ অব নেশন্স – এর বেশ কিছু কৃতিত্ব থাকলেও শেষ পর্যন্ত এই সংগঠন ব্যর্থ হয়েছিল । এই ব্যর্থতার পেছনে কারণগুলি হল —

মিত্রপক্ষের কর্তৃত্ব 

জাতিসংঘ মূলত একটি ইউরােপীয় সংস্থারূপেই আত্মপ্রকাশ করেছিল । ইংল্যান্ড , ফ্রান্সসহ ইউরােপীয় দেশগুলি অর্থাৎ মিত্রপক্ষীয় দেশগুলিই জাতিসংঘের কর্তৃত্ব করতে শুরু করেছিল । যার ফলে জাতিসংঘের অন্তর্ভুক্ত অন্যান্য দেশগুলির মধ্যে ক্ষোভ পুঞ্জীভূত হয় , যা আন্তর্জাতিক স্তরে রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব প্রশমনে জাতিসংঘের ভূমিকাকে হতাশায় পর্যবসিত করেছিল । 

আমেরিকার অনুপস্থিতি 

মার্কিন সেনেট অনুমােদন না করায় জাতিসংঘে যুক্তরাষ্ট্র যােগদান করেনি । বিশ্বের অন্যতম শিল্প সমৃদ্ধ , সামরিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে শক্তিধর আমেরিকার অনুপস্থিতি জাতিসংঘের ভিত্তিকে দুর্বল করে । 

রাশিয়া ও জার্মানির অসমর্থন 

রাশিয়া ও জার্মানিও প্রথমে জাতিসংঘের সদস্যপদ লাভ করেনি । রাশিয়া লিগকে সব সময় সন্দেহের চোখে দেখত এবং একে পুঁজিপতিদের সংস্থা বলে মনে করত । ১৯২৫ ও ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দে জার্মানি ও রাশিয়া লিগের সদস্যভুক্ত হলেও , অল্প সময়ের মধ্যেই জার্মানি ও জাপান লিগের সদস্যপদ ত্যাগ করেছিল । যার পরিণামে আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে লিগের গুরুত্ব হ্রাস পায় । ডেভিড টমসন  বলেছেন , “ জাতিসংঘের ইতিহাসে এমন সময় কখনাে আসেনি যখন পাঁচটার বেশি বড়াে রাষ্ট্র এর অন্তর্ভুক্ত ছিল অথবা অন্তত দুটি বড়াে রাষ্ট্র এর বাইরে ছিল না । ”

ভার্সাই সন্ধির ত্রুটি

ভার্সাই চুক্তির ( ১৯১৯ খ্রি. ) ত্রুটিপূর্ণ শর্তাদির মধ্যেও জাতিসংঘের ব্যর্থতার কারণ নিহিত ছিল । এই সন্ধির মাধ্যমে জার্মানির ওপর যেসব অবমাননাকর শর্ত চাপানাে হয়েছিল , জাতিসংঘের সদস্য দেশগুলি শর্তগুলি সম্পর্কে অবগত হলেও ইচ্ছা করেই সেগুলােকে এড়িয়ে গিয়েছিল । ফলে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের অক্ষমতা জাতিসংঘকে বিফলতার দিকে দ্রুত ঠেলে দিয়েছিল ।

বৃহৎ রাষ্ট্রের স্বার্থ রক্ষাকারী প্রতিষ্ঠান

জাতিসংঘের সনদে এর যে উদ্দেশ্য ও আদর্শের চিন্তা ভাবনা স্থান পেয়েছিল , তাতে প্রেসিডেন্ট উইলসনের চোদ্দো দফা নীতির বিশেষ ভূমিকা ছিল । কিন্তু কার্যক্ষেত্রে এই নীতিগুলি বাস্তবায়িত হয়নি । ফলে ক্ষুদ্র ও দুর্বল রাষ্ট্রবর্গ জাতিসংঘকে বৃহৎ রাষ্ট্রের স্বার্থরক্ষাকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে ভাবতে শুরু করেছিল । 

নিজস্ব সামরিক বাহিনীর অভাব 

জাতিসংঘের নিজস্ব কোনাে সামরিক বাহিনী ছিল না । জাতিসংঘের নিজস্ব সামরিক বাহিনীর অভাবের জন্য অন্যায়কারী রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের ক্ষেত্রে জাতিসংঘকে তার সদস্য রাষ্ট্রগুলির থেকে পাঠানাে বাহিনীর ওপর নির্ভর করতে হত । এক্ষেত্রে আবার সদস্য রাষ্ট্রগুলি সব সময় জাতিসংঘকে সামরিক বাহিনী দিয়ে সাহায্য করতে বাধ্য না থাকায় জাতিসংঘ কার্যত অসহায় হয়ে পড়ে । এ প্রসঙ্গে ই. লিপসনের  মতে — লিগ যেন এক অসহায় বৃদ্ধা , যার দংশন করার মতাে দন্তও নেই । 

দুই বৃহৎ সদস্যের স্বার্থ সংঘাত

জাতিসংঘের অন্যতম প্রধান দুই সদস্য ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স প্রথম থেকেই নিজেদের মধ্যে আদর্শ ও সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থ সংক্রান্ত দ্বন্দ্বে লিপ্ত ছিল । ফলে ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের স্বার্থরক্ষা করতে গিয়ে জাতিসংঘের বাঞ্ছিত নীতির প্রয়ােগ অনেক ক্ষেত্রেই সম্ভব হয়নি । 

নিরস্ত্রীকরণ সম্মেলনের ব্যর্থতা 

বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠা ও নিরাপত্তা রক্ষার উদ্দেশ্যে লিগের উদ্যোগে জেনেভাতে আহূত হয় নিরস্ত্রীকরণ সম্মেলন ( ১৯৩২ খ্রি. ) । ১৯৩২-৩৩ খ্রিস্টাব্দে জেনেভার নিরস্ত্রীকরণ সম্মেলনের ব্যর্থতা জাতিসংঘের মৃত্যু – ঘণ্টা বাজিয়ে দিয়েছিল । এই সম্মেলনে জার্মানির চেয়ে ফ্রান্সের অধিক সমরাস্ত্র সংগ্রহের নীতি স্বীকৃত হলে জার্মানি সম্মেলন ছেড়ে চলে যায় , যার ফলে নিরস্ত্রীকরণ সম্মেলন ভেস্তে যায় । 

জাপানের মাঞ্চুরিয়া আক্রমণ 

জাপানের মাঞ্চুরিয়া অধিকার এবং প্রাচ্যদেশীয় অংশে তার ব্যাপক প্রভাব বিস্তার জাতিসংঘ কোনােভাবেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি । এক্ষেত্রে লিগ কাউন্সিল জাপানকে শুধু অভিযুক্ত করেই দায়িত্ব পালন করে । লিগ চুক্তিপত্রের ষােড়শ শর্তানুযায়ী জাপানের বিরুদ্ধে কোনাে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি । জাপান পরবর্তীকালে স্বেচ্ছায় লিগের সদস্যপদ ত্যাগ করে ( ১৯৩৩ খ্রি. ) ।

মিত্রপক্ষের তোষণ নীতি 

ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স লিগের ওপর কর্তৃত্ব করত । একদিকে এই দুই রাষ্ট্রের পরস্পর বিরােধী আদর্শ ও সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থ সংঘাত , আর অন্যদিকে জার্মানির প্রতি দুই দেশের তােষণ নীতি জার্মানির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থার প্রতিবন্ধক হয়ে দাড়ায় । অনুরূপভাবে ইতালির আবিসিনিয়া অধিকারের প্রতিকার করতে জাতিসংঘ ব্যর্থ হয় । 

ভিন্ন ভিন্ন জাতীয় স্বার্থের সংঘাত 

জাতিসংঘের সদস্যরাষ্ট্রগুলির জাতীয় স্বার্থ ছিল আলাদা আলাদা । ফ্রান্স চেয়েছিল জার্মানিকে চিরকালের জন্য পঙ্গু করে রাখতে । অন্যদিকে ইংল্যান্ড চেয়েছিল জার্মানি পুনরায় বৃহৎ শক্তিশালী রাষ্ট্রভুক্ত হােক । জাতিসংঘে প্রথম থেকেই ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের প্রাধান্য ছিল । তাই এই দুই রাষ্ট্রের স্বার্থ আলাদা হওয়ায় জাতিসংঘ তার নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছােতে ব্যর্থ হয় । 

সাংবিধানিক ত্রুটি 

যুদ্ধনীতিতে : 

জাতিসংঘের গঠনতন্ত্রে কোনাে অবস্থাতেই যুদ্ধ করা চলবে না একথা বলা হয়নি । বরং লিগের গঠনতন্ত্রের দ্বাদশ ধারায় বলা হয়েছিল কোনাে বিরােধের সিদ্ধান্ত প্রকাশের তিন মাসের মধ্যে বিবাদমান কোনাে পক্ষ যুদ্ধের আশ্রয় নিতে পারবে না । 

ভেটো ক্ষমতায় : 

আক্রমণকারী কোনাে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে গেলে জাতিসংঘের সমস্ত রাষ্ট্রের মত গ্রহণ করতে হত । এক্ষেত্রে যে – কোনাে সদস্যরাষ্ট্র ভেটো ( নাকচ ক্ষমতা ) প্রয়ােগের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত স্থগিত রাখতে পারত । তাই কোনাে আক্রমণকারী দেশকে শাস্তি দেওয়া জাতিসংঘের পক্ষে সহজ কাজ ছিল না । 

বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দা 

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর থেকেই সমগ্র বিশ্ব জুড়ে অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দেয় । মানুষের নিত্যপ্রয়ােজনীয় জিনিসপত্রের দাম দিনের পর দিন বাড়তে থাকে । এই ধরনের অর্থনৈতিক মন্দার কোনাে সমাধান সূত্র জাতিসংঘ দেখাতে পারেনি । যার ফলে অর্থনৈতিক মন্দা আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে এক গভীর সমস্যার সৃষ্টি করে । 

প্রতিশোধ মূলক মনোভাব

প্রথম বিশ্বযুদ্ধে বিজয়ীপক্ষের প্রতি বিজিত পক্ষের রাষ্ট্রগুলির প্রতিশােধমূলক মনােভাব লিগের কাজগুলি সুষ্ঠুভাবে সম্পাদনের ক্ষেত্রে বাধা দেয় । বিশেষত , জার্মানির প্রতিশােধমূলক মনােভাব লিগের কাজগুলি পরিচালনায় অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায় । 

উপসংহার 

১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দের ১ সেপ্টেম্বর হিটলার পােল্যান্ড আক্রমণ করলে জাতিসংঘ কার্যকারিতা হারায় । এফ. পি. ওয়াল্টার্স ‘ A History of the League of Nations ‘ গ্রন্থে মন্তব্য করেছেন — কার্যকরী সংস্থা হিসেবে লিগ আজ মৃত ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!