হিটলারের রাশিয়া আক্রমণের কারণ ও ফলাফল
Contents
হিটলারের রাশিয়া আক্রমণের কারণ ও ফলাফল

হিটলার ‘ one by one policy ‘ অনুসরণে সুপরিকল্পিত ভাবে ধাপে ধাপে একটি করে দেশ আক্রমণ ও সেই দেশ জয়ের পরিকল্পনা গ্রহণ করেন । এই যুদ্ধনীতিরই অঙ্গ হিসেবে হিটলার রাশিয়া আক্রমণ করেন । ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দের ২২ জুন এক বিশাল নাৎসি বাহিনী ( প্রায় ৪০ লক্ষ সৈন্য , ৩৩০০ ট্যাংক , ৫০০০ বিমান ) কোনােরকম যুদ্ধ ঘােষণা না করেই হঠাৎ রুশ সীমান্ত অতিক্রম করে রাশিয়ায় প্রবেশ করে । পৃথিবীর ইতিহাসে ইতিপূর্বে এত বড়াে আক্রমণ আর ঘটেনি । ফিলিপ সুয়াভেন ( Philip Suavain ) – এর মতে , “ বিশ্বে ইতিপূর্বে এত বৃহৎ আক্রমণ আর দেখা যায়নি ” ( It was the biggest invasion the world had ever seen ) । কিন্তু প্রশ্ন হল রাশিয়ার সঙ্গে ১০ বছর মেয়াদি অনাক্রমণ চুক্তিটি ( ১৯৩৯ খ্রি. ) বলবৎ থাকা সত্ত্বেও কেন হিটলার সে দেশ আক্রমণ করলেন !
হিটলারের রাশিয়া আক্রমণের কারণ
বিশ্বরাজনীতিতে জার্মানির এই সােভিয়েত ইউনিয়ন আক্রমণ একটি তাৎপর্যপূর্ণ অধ্যায় হয়ে আছে । হিটলারের সােভিয়েত রাশিয়া আক্রমণের কয়েকটি কারণ ছিল । সেগুলি হল —
জার্মান আধিপত্য প্রতিষ্ঠা :
রুমানিয়া এবং তিনটি বাল্টিক রাজ্য এস্তোনিয়া , লাটভিয়া ও লিথুয়ানিয়া শক্তিশালী রাশিয়া দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার আগেই হিটলার রাশিয়া আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেন । কারণ পূর্ব ইউরােপে রুশ আধিপত্য জার্মান আধিপত্য প্রতিষ্ঠাই ছিল হিটলারের লক্ষ্য । অ্যালান বুলকের মতে হিটলারের উদ্দেশ্য ছিল পূর্ব ইউরােপে জার্মান আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করা , এ ব্যাপারে রাশিয়া ছিল প্রধান অন্তরায় । তাই তিনি রাশিয়া আক্রমণ করেন।
রাশিয়া কর্তৃক আক্রান্ত হওয়ার ভীতি :
হিটলারের মনে রাশিয়া কর্তৃক জার্মানি আক্রমণের একটা আশঙ্কা কাজ করেছিল বলে কেউ কেউ মনে করেন । ব্রিটেনের সঙ্গে যুদ্ধে জার্মান বিমানবহর ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সুযােগে সােভিয়েত ইউনিয়ন যদি পূর্বদিক থেকে জার্মানি আক্রমণ করে , তাই হিটলার আগেভাগেই সেখানে আক্রমণ হানেন ।
সাম্যবাদ ভীতি :
পূর্ব ইউরােপ জুড়ে সাম্যবাদের প্রসার ঘটতে শুরু করলে হিটলার ভীত হয়ে পড়েন । সাম্যবাদী সােভিয়েত শক্তিকে ধ্বংস করে তিনি নিশ্চিন্ত হতে চেয়েছিলেন । তাই তিনি পশ্চিমি যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর রুশ জার্মান অনাক্রমণ চুক্তি অগ্রাহ্য করে রাশিয়ায় আক্রমণ হানেন ।
ইংল্যান্ডকে বাগে আনার কৌশল :
পূর্বদিক থেকে আক্রমণের আশঙ্কাকে দূর করতে পারলে , ইংল্যান্ডের ওপর পুরাে নজর দিতে পারবেন — রাশিয়া আক্রমণের পেছনে হিটলারের এই চিন্তাও কাজ করেছিল । হিটলারের ধারণা হয়েছিল , সাম্যবাদী রাশিয়ার বিরুদ্ধে আক্রমণ চালিয়ে তিনি ব্রিটেনের হিটলার বিরােধিতার তীব্রতা কমিয়ে আনতে পারবেন ।
নীতিগত মতভেদ :
দার্দেনেলিস প্রণালীতে জার্মানি নিজের নৌ-আধিপত্য প্রতিষ্ঠার দাবি জানালে রাশিয়া নীতিগত কারণে তাতে আপত্তি জানায় । এ ছাড়া রুমানিয়া ও বাল্টিক রাজ্যগুলির ক্ষেত্রেও রাশিয়া ও জার্মানির মধ্যে তীব্র নীতিগত মতভেদ দেখা দেয় । এই মতভেদ হিটলারকে রাশিয়া আক্রমণের সিদ্ধান্ত গ্রহণের দিকে ঠেলে দেয় ।
প্রাকৃতিক সম্পদ দখলে ব্যগ্রতা :
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূচনায় রাশিয়া জার্মানিকে প্রচুর খাদ্য , রসদ , খনিজ দ্রব্য ইত্যাদি সরবরাহ করেছিল । কিন্তু ফ্রান্সের পরাজয়ের পর জার্মান সামরিক শক্তির সম্যক পরিচয় পেয়ে রাশিয়া আতঙ্কিত হয়ে পড়ে ও সেই সরবরাহ বন্ধ করে দেয় । ফলে ক্ষিপ্ত হিটলার রাশিয়ার শস্যভাণ্ডার বলে পরিচিত ইউক্রেন ও বাকুর তৈলখনি দখলে ব্যগ্র হয়ে ওঠেন ।
অপারেশন বারবারোসা :
১৯৪১ খ্রিস্টাব্দের ২২ জুন ভাের চারটে থেকে দেড়শাে ডিভিশনের জার্মান সৈন্যবাহিনী রাশিয়ার সীমানার ভেতরে ঢুকে বারবারােসা অভিযান শুরু করে । যুদ্ধ শুরু হওয়ার ষষ্ঠ দিনের মাথায় জার্মানির পানজার ডিভিশন রাশিয়ার সীমান্তের ২০০ মাইল ভেতরে ঢুকে পড়ে আর গ্যাডােরিয়ান বাহিনী মস্কোর ৩২০ মাইল দূরবর্তী ডেনিপার অঞ্চলে পৌঁছােয় । জেনারেল ভনলিব – এর সেনাবাহিনী রাশিয়ার উত্তরে রিগা অঞ্চল দখল করে নেয় । সেনাবাহিনী কার্জন লাইন পার করে স্নোলেস্ক শহরে ঢুকে পড়ে ( ১৭ জুলাই ) । প্রথম ৬ মাসের মধ্যে নাৎসি বাহিনী ৮ লক্ষ বর্গকিলােমিটার অঞ্চল দখল করে নেয় । হিটলার বলেন — বারবারােসা অভিযান শুরু হলে বিশ্ব নিশ্চেষ্ট ও নিস্তব্ধ হবে ( ‘ When Barbarossa Commences , the world will hold its breath and make no comment ‘ ) ।
রাশিয়ার পোড়ামাটি নীতি :
রুশরা ১২৯ বছর পূর্বে সংঘটিত নেপােলিয়নের রুশ অভিযান ব্যর্থ করে দেওয়ার জন্য যেভাবে পােড়ামাটি নীতির প্রয়ােগ করেছিল , ঠিক সেভাবেই জার্মানির বিরুদ্ধে তারা একই নীতি গ্রহণ করে । রুশ বাহিনী সকল সেতু , বাড়ি ধ্বংস করে ও শস্যক্ষেত্র পুড়িয়ে দিতে দিতে পিছু হঠতে থাকে । এভাবে নাৎসি সেনাবাহিনীকে রাশিয়ার ভেতর দিকে তারা ঢুকিয়ে নেয় । এক সময় জার্মান বাহিনী খাদ্যের অভাব অনুভব করে । ঠিক সেই সময়েই রুশ সেনাপতি মার্শাল ঝুকভের নেতৃত্বে রুশ বাহিনী পালটা আঘাত হানে ।
জার্মানির পরাজয় :
হিটলার নতুন পরিকল্পনা গ্রহণ করে ভল্লা ও ককেসাস অঞ্চল দিয়ে সেনা অভিযানের সিদ্ধান্ত নেন । ডন উপত্যকা অঞ্চলটি জার্মান বাহিনী দখল করে নেওয়ার পর তাদের একটি শাখা ককেসাস ও কৃষ্ণসাগরের দিকে এগিয়ে যায় । কিন্তু শীতকাল এসে যাওয়ায় জার্মান সেনা অভিযান থমকে যায় । রাশিয়ার লালফৌজের গেরিলা আক্রমণের মুখে জার্মান নাৎসি বাহিনী পিছু হটতে শুরু করলে যুদ্ধের গতিপথ পরিবর্তিত হতে শুরু করে । এরপরেই শুরু হয় বিখ্যাত স্ট্যালিনগ্রাডের যুদ্ধ । মার্শাল ঝুকভের নেতৃত্বে রুশ বাহিনী চোদ্দো ডিভিশন জার্মান বাহিনীকে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য করে । রুশ বাহিনী রােস্টোভ , কুষ্ক ও খারকোভ অঞ্চলগুলি পুনরুদ্ধার করে । ৩ লক্ষ ৩৮ হাজার জার্মান সৈন্যের মধ্যে মাত্র ৮০ হাজার সেনা ও ১৬ জন সেনাপতি রাশিয়ার হাতে বন্দি হয় । বাকি সবাই যুদ্ধক্ষেত্রে নিহত হয় । ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দের জুলাইয়ে অবশিষ্ট জার্মান সেনারা পুনরায় রাশিয়ার পূর্ব সীমান্তে আক্রমণ চালালেও রুশদের প্রতি আক্রমণে জার্মান অগ্রগতি প্রতিহত হয় । অবশেষে রুশ বাহিনী জার্মানদের পিছু ধাওয়া করে রাশিয়া থেকে বহিষ্কৃত করে ( ১৯৪৪ খ্রি. মার্চ ) ।
হিটলারের রাশিয়া আক্রমণের ফলাফল
জার্মানির ধ্বংসসাধন :
যে আশা নিয়ে হিটলার রাশিয়া আক্রমণ করেছিলেন তা সফল হয়নি । প্রথম ছয় মাসেই নাৎসি সেনা রাশিয়ার প্রায় ৮ লক্ষ বর্গকিলােমিটার এলাকা দখল করে নেয় । লেনিনগ্রাড অবরুদ্ধ হয় , জার্মান সেনা মস্কো শহরের খুব কাছে পৌঁছােয় । কিন্তু শেষরক্ষা হয়নি । হিটলার রাশিয়া আক্রমণ করে জার্মানিকেই ধ্বংস করেন ।
দেশপ্রেমিক যুদ্ধ :
হিটলারের ধারণাকে নস্যাৎ করে এই সময় সােভিয়েত রাশিয়ায় কমিউনিস্ট বিরােধী কোনাে বিদ্রোহের ঘটনা ঘটেনি । বরং তার উলটোই হয়েছিল । রেনার ও রন স্টেপলে তাঁদের ‘ World History ‘ গ্রন্থে লিখেছেন — সােভিয়েত নাগরিক — কমিউনিস্ট আর অ-কমিউনিস্ট নিজেদের এই বিরােধ ভুলে , স্টালিনের নেতৃত্বকে স্বীকার করে নিয়েছিল এবং জার্মান আক্রমণকে দেশপ্রেমমূলক এক যুদ্ধে রূপান্তরিত করেছিল ।
নাৎসি বিরােধী প্রতিরোধ সংগঠন :
এই আক্রমণের এক তাৎক্ষণিক ফল হল — হিটলার অধিকৃত দেশগুলিতে সােভিয়েত কমিউনিস্টরা নাৎসি বিরােধী ‘ প্রতিরােধ ’ সংগঠন গড়ে তুলে অনন্য নজির গড়েছিল ।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তি :
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মান বাহিনী চূড়ান্তভাবে পরাজিত হয় । জার্মান শক্তি অনেকটাই হ্রাস পায় , ফলে মিত্রপক্ষের জয় সহজ হয় ।
উপসংহার
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন জার্মানির রাশিয়া অভিযান চাঞ্চল্যকর ঘটনা । এই সংঘর্ষে দুপক্ষেরই ক্ষয়ক্ষতি হয় । কিন্তু শেষ পর্যন্ত জার্মানির পতন ঘটে । পূর্ব জার্মানির ওপর রুশ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয় , পূর্ব ইউরােপে হিটলার যেসব অঞ্চল দখল করে রেখেছিলেন রাশিয়া তার কিছু নিজের নিয়ন্ত্রণে এনে সেসব জায়গায় সাম্যবাদী সরকার গঠন করে ।