ইতিহাস

হিটলারের পররাষ্ট্রনীতি

Contents

হিটলারের পররাষ্ট্রনীতি

আডলফ হিটলার

জার্মানির ফ্যাসিবাদী আগ্রাসন হিটলার তাঁর আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ ‘ মেইন ক্যাম্প ’ -এ জার্মানির বিদেশনীতির বর্ণনা করেছেন । 

হিটলারের পররাষ্ট্রনীতির মূল উদ্দেশ্য

হিটলারের পররাষ্ট্রনীতির উদ্দেশ্য গুলি ছিল— 

1. অপমানজনক ভার্সাই সন্ধি ও সেন্ট জার্মেইন সন্ধির শর্তগুলিকে উপেক্ষা করা । 

2. অতীত গৌরব ফিরিয়ে এনে পৃথিবীতে জার্মানিকে আবার বৃহৎ শক্তিশালী দেশরূপে সুপ্রতিষ্ঠিত করা । 

3. বিশ্বের সমস্ত জার্মান ভাষাভাষী মানুষদের নিয়ে এক বৃহত্তর জার্মান সাম্রাজ্য গড়ে তােলা । 

4. ভার্সাই সন্ধিতে জার্মানির প্রতি অবিচার করা হয় । ফলে ইংল্যান্ডসহ বহু দেশ জার্মানির প্রতি সহানুভূতিশীল হয়ে তােষণ নীতি অনুসরণ করতে থাকে । 

5. সোভিয়েত রাশিয়াতে সাম্যবাদের বিস্তারের ফলে সব দেশই উদবিগ্ন ছিল । সুতরাং হিটলারের সাম্যবাদ বিরােধী ক্রিয়াকলাপে ইংল্যান্ড , ফ্রান্স প্রভৃতি দেশ খুশি হয় ।

পররাষ্ট্রনীতি

নিরস্ত্রীকরণ সম্মেলন ও জাতিসংঘ ত্যাগ : 

১৯৩২-৩৩ খ্রিস্টাব্দে জাতিসংঘের নিরস্ত্রীকরণ সম্মেলনে হিটলার ফ্রান্সের সমতুল্য অস্ত্র সংরক্ষণের দাবি জানান । কিন্তু ফ্রান্স তা মেনে না নেওয়ায় , জার্মানি জাতিসংঘের সদস্যপদও ত্যাগ করে । 

ব্রিটেনের সঙ্গে চুক্তি : 

হিটলার ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দে ইংল্যান্ডের সঙ্গে একটি নৌ-চুক্তি স্বাক্ষর করেন । এই চুক্তি অনুসারে হিটলার ডুবােজাহাজ সহ ব্রিটেনের নৌ শক্তির এক-তৃতীয়াংশ পর্যন্ত নৌশক্তি বৃদ্ধির সুযােগ পান । 

ইতালির সঙ্গে মিত্রতা : 

ইতালি এই সময় ( ১৯৩৫ খ্রি. ) আবিসিনিয়া আক্রমণ করলে হিটলার মুসােলিনিকে সমর্থন করেন । ফলে ইতালি ও জার্মানির মধ্যে বন্ধুত্ব দৃঢ় হয় । 

রাইনল্যান্ড দখল : 

ইতালি আবিসিনিয়া আক্রমণ করলেও মুসােলিনির বিরুদ্ধে জাতিসংঘও কোনাে দৃঢ় পদক্ষেপ নিতে দ্বিধা করে । এতে হিটলার উৎসাহিত হন । তিনি ভার্সাই চুক্তি ও লোকার্নো চুক্তির শর্ত ভেঙে রাইনল্যান্ড দখল করে নেন।

জাপান ও ইতালির সঙ্গে অ্যান্টি-কমিন্টার্ন চুক্তি : 

হিটলার কমিউনিস্টদের ক্ষমতা বৃদ্ধি রােধ করার উদ্দেশ্যে জাপানের সঙ্গে অ্যান্টি কমিন্টার্ন প্যাক্ট স্বাক্ষর করেন ( ১৯৩৬ খ্রি. ) । পরের বছর ইতালির সঙ্গেও তিনি অনুরূপ কমিন্টার্ন-বিরােধী চুক্তিতে আবদ্ধ হন । এই জোট রোম বার্লিন টোকিও অক্ষশক্তি নামে পরিচিত । 

স্পেনের গৃহযুদ্ধে অংশগ্রহণ : 

স্পেনের প্রজাতান্ত্রিক সরকারের বিরুদ্ধে ‘ ফ্যাসিবাদ ’ মতাদর্শের অনুগামী জেনারেল ফ্রাঙ্কো বিদ্রোহ করলে হিটলার প্রকাশ্যে ফ্রাঙ্কোকে সমর্থন জানান । এই গৃহযুদ্ধে ফ্রাঙ্কোর বিজয় একাধারে একনায়কতন্ত্রবাদ ও হিটলারের বিজয় ঘােষণা করে । 

পোল্যান্ডের সঙ্গে অনাক্রমণ চুক্তি :

হিটলার ১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দে পোল্যান্ডের সঙ্গে একটি দশ বছর মেয়াদি অনাক্রমণ চুক্তি স্বাক্ষর করেন । এই চুক্তি হিটলারের কূটনীতির জয় ঘােষণা করে । 

অস্ট্রিয়া দখল : 

হিটলার অখিল জার্মান ঐক্য এর পরিকল্পনাকে বাস্তবায়িত করার জন্য জার্মান অধ্যুষিত অস্ট্রিয়াকে জার্মানির সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নেন । তাঁর এই নীতি আনস্লুস ( Anschluss ) বা ‘ নিবিড় মৈত্রী ’ নামে পরিচিত । তিনি অকস্মাৎ অস্ট্রিয়া দখল করে একটি গণভােটের মাধ্যমে জার্মানির সঙ্গে অস্ট্রিয়ার সংযুক্তি ঘটান । 

চেকোস্লোভাকিয়া দখল :

রাজনৈতিক , সামরিক ও অর্থনৈতিক দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ চেকোস্লোভাকিয়াকে দক্ষিণ-পূর্ব ইউরােপের প্রবেশদ্বার বলে অভিহিত করা হয় । মিউনিখ চুক্তি ( ১৯৩৮ খ্রি. ) দ্বারা স্থির হয় চেকোস্লোভাকিয়ার সুদেতান অঞ্চল জার্মানির অন্তর্ভুক্ত হবে । এর ছয় মাসের মধ্যেই হিটলার সমগ্ৰ চেকোস্লোভাকিয়া দখল করে নেন ।

মেমেল বন্দর দখল : 

চেকোস্লোভাকিয়া দখলের পর হিটলার আরও আগ্রাসী হয়ে ওঠেন । তিনি লিথুয়ানিয়াকে ভয় দেখিয়ে মেমেল বন্দরটি দখল করে নেন । 

ডানজিগ বন্দর দাবি : 

হিটলার পােল্যান্ডের কাছে ডানজিগ বন্দর এবং সেইসঙ্গে পােল্যান্ডের রাষ্ট্রসীমার মধ্য দিয়ে জার্মানির দুই অঞ্চলের মধ্যে যােগাযােগের জন্য একটি সংযােগ-ভূমি ( Polish corridor ) দাবি করেন । 

রুশ জার্মান অনাক্রমণ চুক্তি :

ইংল্যান্ড , ফ্রান্স বুঝতে পারে তােষণ দ্বারা হিটলারের উদগ্র রাজ্যলিঙ্গাকে সন্তুষ্ট করা যাবে না । তাই তারা হিটলারের দাবির বিরুদ্ধে পােল্যান্ডকে সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দেয় । হিটলার তাই পূর্ব সীমান্ত নিরাপদ করার জন্য ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দে রুশ জার্মান অনাক্রমণ চুক্তি স্বাক্ষর করেন ।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূচনা : 

১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দের ১ সেপ্টেম্বর হিটলার পোল্যান্ড আক্রমণ করেন । ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স পােল্যান্ডের পক্ষে অস্ত্রধারণ করলে শুরু হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ।

মূল্যায়ন 

হিটলারের সীমাহীন আত্মম্ভরিতা ও আগ্রাসী মানসিকতা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকে অনিবার্য করে তুলেছিল । দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের জন্য হিটলার তথা জার্মানির মূল দায়িত্ব স্বীকার করে নিয়েও বলা যায় যে , ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের মতানৈক্য ও অদূরদর্শী তোষণ নীতি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের জন্য খুব কম দায়ী ছিল না ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!