জাতীয় কংগ্রেসের ত্রিপুরী অধিবেশন
Contents
জাতীয় কংগ্রেসের ত্রিপুরী অধিবেশন
১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দে জাতীয় কংগ্রেসের বার্ষিক অধিবেশন বসে মধ্যপ্রদেশের ত্রিপুরী গ্রামে । এই অধিবেশনে সুভাষচন্দ্রকে পুনরায় জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতির পদে মনােনয়নের দাবি ওঠে । এই দাবি তােলেন , নাম্বুদিরিপাদ , সুন্দরাইয়া সহ আটজন বিক্ষুদ্ধ বামপন্থী নেতা ।
গান্ধী – সুভাষ বিরোধ
এই সময় সুভাষচন্দ্রের বিভিন্ন রচনা ও বক্তৃতায় বামপন্থী আদর্শের প্রভাব এবং আপসহীন সাম্রাজ্যবাদী মনােভাব গান্ধীজী ও তাঁর একনিষ্ঠ অনুগামীদের ভাবিয়ে তুলেছিল । এ ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্র গঠন , পূর্ণ স্বাধীনতা অর্জন ইত্যাদি আদর্শ কংগ্রেসের অধীনে শ্রমিক কৃষকদের সংগঠিত করে ।
সুভাষের জয়
জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচনে ( ২৯ জানুয়ারি , ১৯৩৯ খ্রি. ) সুভাষ পান ১৫৮০ টি ভােট , সীতারামাইয়া পান ১৩৭৭ টি ভােট । সুভাষচন্দ্র ২০৩ টি ভােটে পরাজিত করেন গান্ধী গােষ্ঠী সমর্থিত প্রার্থী পট্টভি সীতারামাইয়াকে । পট্টভির পরাজয় গান্ধীজীকে মর্মাহত করে । তিনি বলেন— “ সীতারামাইয়ার পরাজয় , আমার পরাজয় । ”
গান্ধীজীর অসহযােগিতা
সুভাষ সভাপতি মনােনীত হওয়ায় গান্ধীগােষ্ঠীর চূড়ান্ত অসহযােগিতা শুরু হয় । গান্ধীজীর সমর্থন ছাড়া সুভাষচন্দ্রের পক্ষে সভাপতি হিসেবে কাজ করা কঠিন হয়ে পড়ে । দু মাস ধরে চেষ্টা করেও একটি পছন্দসই কার্যকরী সমিতি গঠন করতে তিনি ব্যর্থ হন । বরং পুরাতন কার্যকরী সমিতিকে পুনর্মনােনয়ন দেওয়া হয় ও গান্ধী নীতি বিপুলভাবে সমর্থিত হয় ।
ফরওয়ার্ড ব্লক গঠন
গান্ধীজীর গােপন নির্দেশে কংগ্রেস কার্যকরী সমিতির ১৩ জন সদস্যের সকলেই পদত্যাগ করলে সুভাষচন্দ্র বাধ্য হয়ে সভাপতির পদে ইস্তফা দেন ( ১৯৩৯ খ্রি. ২৯ এপ্রিল ) । তবে কংগ্রেসের অভ্যন্তরেই বামপন্থী অনুগামীদের নিয়ে তিনি ৩ মে ফরওয়ার্ড ব্লক নামে একটি গােষ্ঠী গঠন করেন । ফলে সুভাষচন্দ্র প্রবলভাবে সমালােচিত হন এবং শৃঙ্খলাভঙ্গের অভিযােগে ১১ আগস্ট তিন বছরের জন্য কংগ্রেসের কোনাে পদ গ্রহণের অধিকার থেকে তাঁকে বঞ্চিত করা হয় । বাধ্য হয়ে সুভাষচন্দ্র কংগ্রেস ত্যাগ করেন এবং ফরওয়ার্ড ব্লককে একটি স্বতন্ত্র রাজনৈতিক দল হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেন ।
জাতীয় কংগ্রেসের ত্রিপুরী অধিবেশনের গুরুত্ব
সভাপতি পদে ইস্তফা :
গান্ধীজীর অলিখিত নির্দেশ নেমে কংগ্রেসের কার্যকরী সমিতি ( Congress Working Committee ) – র সকল সদস্য পদত্যাগ করেন । ফলে সুভাষ বাধ্য হয়ে জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতির পদে ইস্তফা দেন ও আলাদা ফরওয়ার্ড ব্লক দল গঠন করেন ।
বামপন্থীদের ক্ষমতা হ্রাস :
সুভাষচন্দ্রের পদত্যাগের পরিণতি হিসেবে কংগ্রেসের দক্ষিণপন্থীরা ধীরে ধীরে ক্ষমতাশালী হন ও বামপন্থীরা দুর্বল হতে থাকেন ।
জাতীয় আন্দোলনে গতিহীনতা :
সুভাষচন্দ্র ও গান্ধীজীর মতাে দেশের দুই শীর্ষ নেতৃবৃন্দের মধ্যেকার দ্বন্দ্ব পরােক্ষভাবে দেশের জাতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনকে দুর্বল করে ।
বিদেশি শক্তির সাহায্যে স্বাধীনতা অর্জন :
ত্রিপুরী কংগ্রেসের সুদূর প্রসারী প্রভাব হিসেবে সুভাষচন্দ্র অনুভব করেন যে ভারতের মধ্যে থেকে স্বাধীনতা আন্দোলনের মাধ্যমে ব্রিটিশ শাসনের উচ্ছেদ সম্ভব নয় । তাই তিনি বিদেশি শক্তির সাহায্য নিয়ে ভারতের স্বাধীনতা অর্জনের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা গ্রহণ করেন ।
মন্তব্য
ত্রিপুরী কংগ্রেসকে কেন্দ্র করে কংগ্রেসের মধ্যে বামপন্থী মানসিকতাকে নির্মূল করতে চাওয়া হয় । সুভাষ নিজের পরাজয় প্রসঙ্গে যে তিনটি কারণের উল্লেখ করেছিলেন সেগুলি ছিল — জওহরলালের অসহযােগিতা , কংগ্রেসের সমাজতন্ত্রী দলের বিশ্বাসঘাতকতা এবং নেতৃত্বের প্রশ্নে তাঁর ও গান্ধীজীর দ্বন্দ্বকে ব্যক্তিগত সংঘর্ষের রূপদান । কংগ্রেসের ত্রিপুরী অধিবেশনে গান্ধী গােষ্ঠী সুভাষের এই জয়কে নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখেছিলেন বলেই সুভাষকে দল থেকে বহিষ্কৃত হতে হয়েছিল । ব্রিটিশ গবেষক টমলিনসনের মতে — সভাপতি নির্বাচনে সুভাষচন্দ্রের জয় ছিল নেতিবাচক ।