ইতিহাস

ভারত ছাড়ো আন্দোলন বা আগস্ট আন্দোলন

Contents

ভারত ছাড়ো আন্দোলন বা আগস্ট আন্দোলন

ভারত ছাড়ো আন্দোলনের কারণ

ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের এক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হল ভারত ছাড়াে বা আগস্ট আন্দোলন । এই আন্দোলন ছিল অন্যতম স্বতঃস্ফূর্ত গণজাগরণ । এই গণজাগরণের পিছনে নিম্নলিখিত পরিস্থিতি কাজ করেছিল । 

ক্রিপস প্রস্তাবের ব্যর্থতা :

ক্রিপস প্রস্তাব ব্যর্থ হয়েছিল , কারণ এতে ভারতকে স্বাধীনতা দানের কোনাে উল্লেখ ছিল না । বরং এতে ছিল ভারতকে টুকরাে করে দেওয়ার চক্রান্ত । এই প্রস্তাব ব্যর্থ হওয়ার ফলে ভারতবাসী আর একটি গণ আন্দোলনের জন্য উন্মুখ হয়ে ওঠে । 

ব্রিটিশ সেনাদের অত্যাচার : 

যুদ্ধরত দেশগুলিতে প্রবাসী ভারতীয়দের প্রতি ব্রিটিশ সরকারের অত্যাচার ও নিপীড়নের ঘটনা ভারতবাসীর ক্ষোভকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছিল । 

খাদ্য সংকট ও মূল্য বৃদ্ধি :

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধজনিত কারণে মানুষের নিত্যপ্রয়ােজনীয় জিনিস পত্রের দাম আকাশ ছোঁয়া হয় । তীব্র খাদ্য সংকট দেখা দেয় । ভারতীয়রা ব্রিটিশ সরকারের প্রতি আস্থাহীন হয়ে পড়ে এবং ব্রিটিশ শাসনের অবসান কামনা করে । 

ভারতবাসীর স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা : 

অসহযােগ আন্দোলন , আইন অমান্য আন্দোলন – সহ অনেকগুলি গণ আন্দোলন ভারতীয়দের স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষাকে বাড়িয়ে তােলে । শহরবাসীদের পাশাপাশি গ্রামীণ মানুষের রাজনৈতিক চেতনা জাগ্রত হলে এক সর্বভারতীয় গণ আন্দোলনের পটভূমি তৈরি হয় । 

ভারত ছাড়ো আন্দোলনের প্রস্তাব গ্রহণ

গান্ধীজী ‘ হরিজন ‘ পত্রিকায় ব্রিটিশ সরকারকে ভারত ত্যাগের উপদেশ দিয়ে একটি প্রবন্ধ প্রকাশ করেন । গান্ধীজীর এই চিন্তাধারাকে ভিত্তি করে ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে ভারত ছাড়াে আন্দোলন শুরু হয় । এটি আগস্ট বিদ্রোহ বা ৪২ – এর আন্দোলন নামেও খ্যাত । ১৯৪২ – এর ১৪ জুলাই কংগ্রেস কার্যনির্বাহক সমিতি ঐতিহাসিক ভারত ছাড়াে প্রস্তাবটি গ্রহণ করে । ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের ৭ আগস্ট সারা ভারত কংগ্রেস কমিটি গান্ধীজীর নেতৃত্বে ব্যাপকভাবে অহিংস গণ আন্দোলন শুরু করার সিদ্ধান্ত নেয় । গান্ধীজী দৃপ্তকণ্ঠে ঘােষণা করেন , আমরা দেশকে স্বাধীন করব , নয়তাে ওই প্রচেষ্টায় মৃত্যুবরণ করব ( “ We shall either free India or die in the attempt ” ) 

নেতৃবৃন্দের গ্রেফতার 

‘ ভারত ছাড়াে ’ প্রস্তাব গৃহীত হওয়ার পর ৮ আগস্ট মধ্যরাতে গান্ধীজী , মৌলানা আজাদ এবং অন্যান্য শীর্ষ নেতাদের পুলিশ গ্রেফতার করে । জাতীয় কংগ্রেসকে অবৈধ ঘােষণা করা হয় । কংগ্রেসের তহবিল বাজেয়াপ্ত করা হয় ।

স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলন 

৯ আগস্ট নেতাদের গ্রেফতারের খবর সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে । সঙ্গে সঙ্গে ভারতবাসী স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রতিবাদ আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে । সভা সমিতি , শােভাযাত্রা ও হরতাল পালনের মাধ্যমে ভারতবাসী তাদের প্রতিবাদ জ্ঞাপন করে । আগস্ট আন্দোলনে ছাত্র , শ্রমিক ও কৃষক শ্রেণী সক্রিয়ভাবে অংশ নেয় । মেদিনীপুরের সুতাহাটা , উত্তরপ্রদেশের বালিয়া জেলা , মহারাষ্ট্রের সাতারা জেলা , আসামের নওগাঁ জেলায় সাময়িকভাবে জাতীয় সরকার প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয় । তমলুকের ৭৩ বছর বয়স্কা ‘ গান্ধিবুড়ি ’ মাতঙ্গিনী হাজরা , অসমিয়া তরুণী কনকলতা বড়ুয়া , করাচির কিশােরী হেমু কালানি পুলিশের গুলিতে প্রাণ দেন । 

অনুশীলন দল , যুগান্তর দল ও কংগ্রেস সমাজতন্ত্রী দল আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয় । সর্বভারতীয় নেতাদের মধ্যে অগ্রণী ছিলেন জয়প্রকাশ নারায়ণ , অচ্যুত পট্টবর্ধন , রামমনােহর লােহিয়া , অরুণা আসফ মাতঙ্গিনী হাজরা আলি প্রমুখ ।

ভারত ছাড়ো আন্দোলনের ব্যর্থতার কারণ

‘ ভারত ছাড়াে ’ আন্দোলনের ব্যর্থতার একাধিক কারণ ছিল । 

পরিকল্পনা ও শৃঙ্খলার অভাব :

প্রথম থেকেই ভারত ছাড়াে আন্দোলন ছিল অপরিকল্পিত ও অসংগঠিত । নেতারা কারারুদ্ধ থাকায় আন্দোলনকারী জনতা নিজেরাই আন্দোলনে নেতৃত্ব দিতে থাকেন । স্বভাবতই আন্দোলনের মধ্যে শৃঙ্খলার অভাব আন্দোলনকে দুর্বল করেছিল । অর্থাৎ আন্দোলনের সময় নির্ধারণ সঠিক ছিল না । 

অন্যান্য দলের বিরােধিতা : 

কিছু রাজনৈতিক দল ও গােষ্ঠীর বিরূপতা আন্দোলনের ব্যর্থতার জন্য দায়ী ছিল । ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি , হিন্দু – মহাসভা এই আন্দোলন সমর্থন করেনি । 

অন্যান্য কারণ : 

আন্দোলন চলাকালে প্রাকৃতিক বিপর্যয় , শস্যহানি ইত্যাদি কারণে খাদ্যাভাব , মূল্যবৃদ্ধি ঘটে । ফলে মানুষ আন্দোলন থেকে সরে আসতে বাধ্য হয় । 

ভারত ছাড়ো আন্দোলনের গুরুত্ব

ভারত ছাড়াে আন্দোলন ব্যর্থ হলেও , এই আন্দোলনের গুরুত্ব কম ছিল না । 

1. এই আন্দোলন ভারতবাসীর স্বাধীনতা আকাঙ্ক্ষাকে বাড়িয়ে দেয় । 

2. সর্বপ্রথম এই আন্দোলনেই কৃষক ও শ্রমিকশ্রেণী ব্যাপক আকারে স্বতঃস্ফূর্তভাবে শামিল হয়েছিল । যার ফলে আন্দোলন প্রকৃত অর্থে একটি সামগ্রিক গণ আন্দোলনে রূপান্তরিত হয়েছিল । 

3. বস্তুত ভারত ছাড়াে আন্দোলনের মধ্য দিয়ে আবার প্রমাণিত হয়ে যায় যে , ভারতীয়দের মধ্যে কংগ্রেসের জনপ্রিয়তা প্রশ্নের অতীত । সে সময়কার ভারতীয় রাজনীতির নিয়ন্ত্রক জাতীয় কংগ্রেসের ওপর দেশবাসীর শ্রদ্ধা ও আনুগত্য বহুগুণ বেড়ে যায় । 

4. এই আন্দোলনে ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে ভারতীয়দের মনে দীর্ঘদিনের যে ক্ষোভ ও স্বাধীনতার জন্য যে দৃঢ়সংকল্প লুকিয়ে ছিল তা সুস্পষ্টরূপে প্রকাশ পেয়েছিল । 

মূল্যায়ন 

ভারত ছাড়াে বা আগস্ট আন্দোলন ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের কফিনে শেষ পেরেকটি পুঁতে দিয়েছিল । ইউরােপের বুকে যখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছে তখন সারা ভারত জুড়ে তীব্র ব্রিটিশ বিরােধী আন্দোলন বিশ্ব রাজনীতির দৃষ্টি আকর্ষণ করে । এর পরেই আমেরিকাও ভারতকে স্বাধীনতা দেওয়ার ব্যাপারে ব্রিটেনের ওপর চাপ সৃষ্টি করে । ঐতিহাসিক ড. রমেশচন্দ্র মজুমদার  লিখেছেন – ১৯৪২ – এর গণ বিদ্রোহ প্রকৃত অর্থেই সৈনিকের যুদ্ধ । সেনাপতি দ্বিধাগ্রস্ত ছিলেন , কিন্তু সৈনিকের ভূমিকা ছিল গৌরবময় কারণ তারা দেশের স্বাধীনতার জন্য জীবন উৎসর্গ করে শহিদ হয়েছেন ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!