ভারত ছাড়ো আন্দোলনের গুরুত্ব
Contents
ভারত ছাড়ো আন্দোলনের গুরুত্ব
ভারত ছাড়াে আন্দোলন ছিল ভারতে ব্রিটিশ শাসন অবসানের অন্তিম পদক্ষেপ । “ ১৯৪২ -এর বিদ্রোহ বাস্তবিকই ছিল সৈনিকের যুদ্ধ । সেনাপতি ছিলেন দ্বিধাগ্রস্ত ; কিন্তু সৈনিকগণের ভূমিকা ছিল গৌরবজনক । কারণ তারা দেশের স্বাধীনতার জন্য শহিদের ন্যায় জীবন উৎসর্গ করেছিলেন । ” ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র মজুমদারের এই মন্তব্য থেকেই ভারত ছাড়াে আন্দোলনের গুরুত্ব উপলব্ধি করা যায় । যেসব কারণে এই আন্দোলন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ , সেগুলি হল—
স্বাধীনতার অজেয় সংকল্প
১৯৪২ এর ভারত ছাড়াে আন্দোলন ছিল ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের চূড়ান্ত পর্যায় । ব্রিটিশ শাসনের প্রতি ভারতবাসীর ঘনীভূত ক্ষোভ ও তা থেকে মুক্তির জন্য অজেয় সংকল্প এই বিদ্রোহে সুস্পষ্ট ভাবে প্রমাণিত হয় ।
সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখা
মুসলিম লীগ এই আন্দোলনে যােগ না দিলেও আন্দোলন চলাকালে কোথাও কোনাে সাম্প্রদায়িক বিরােধ বাধেনি । তাই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও হিন্দু-মুসলিম ঐক্য ছিল এই আন্দোলনের এক বিশাল সম্পদ ।
জাতীয় বিপ্লব
বিয়াল্লিশের আন্দোলনের প্রকৃতি বিশ্লেষণ করতে গিয়ে জওহরলাল নেহরু বলেছিলেন — নেতা নেই , সংগঠন নেই , উদ্যোগ আয়ােজন কিছু নেই , কোনাে মন্ত্রবল নেই , অথচ একটা অসহায় জাতি স্বতঃস্ফূর্তভাবে কর্মপ্রচেষ্টার আর কোনাে পথ না পেয়ে বিদ্রোহী হয়ে উঠল — এ দৃশ্য বাস্তবিকই বিস্ময়ের । এই আন্দোলনকে তিনি ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের মহাবিদ্রোহের সঙ্গে তুলনা করেছেন । বড়ােলাট লর্ড লিনলিথগাে -ও এই আন্দোলনকে ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের পর সবচেয়ে বড়াে বিদ্রোহ বলে উল্লেখ করেছেন ।
ব্রিটিশ শাসনের মৃত্যুঘণ্টা
অধ্যাপক সুমিত সরকারের মতে — বিভিন্ন অঞ্চলের কৃষকদের অংশগ্রহণের ফলেই আগস্ট বিদ্রোহ এক দুর্দমনীয় আন্দোলনে পরিণত হয়েছিল । এই অতুলনীয় গণবিদ্রোহ ব্রিটিশ শাসকগােষ্ঠীর মনে এই বােধ সুস্পষ্টভাবেই জাগিয়ে দিয়েছিল যে , ভারতে ব্রিটিশ শাসনের অবসান আর বেশি দূরে নেই । ভারতের স্বাধীনতা লাভ একটি অবধারিত ব্যাপার । বাকি কেবল ক্ষমতা হস্তান্তর কীভাবে হবে বা স্বাধীনতা লাভের পর ভারতের সরকার কীভাবে সংগঠিত হবে সেটা ঠিক করা । তাই একথা বলা হয় যে , বিয়াল্লিশের আন্দোলন বা ভারত ছাড়াে আন্দোলন ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের মৃত্যু ঘণ্টাধ্বনি শুনিয়েছিল ।
স্বাধীনতা অর্জনের ভিত্তি স্থাপন
বিয়াল্লিশের আন্দোলনের গভীরতা ও ব্যাপকতা যে ভারতের স্বাধীনতার ভিত্তিভূমি রচনা করেছিল , সে বিষয়ে কোনাে সন্দেহ নেই । একদিকে যখন সুভাষচন্দ্রের সশস্ত্র বিপ্লবী তৎপরতায় ভারতের ব্রিটিশ সরকার আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিল , ঠিক তখনই ‘ ভারত ছাড়াে ’ আন্দোলনের তীব্রতা সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ সরকারের প্রশাসনিক ভিত্তিকে নড়বড়ে করে দিয়েছিল ।
ব্রিটিশের বােধােদয়
ভারত ছাড়াে আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে ভারতবাসীর যে তীব্র স্বাধীনতাকাঙ্ক্ষা প্রকাশিত হয় , তা ব্রিটিশের বােধােদয় ঘটায় । ব্রিটিশ সরকার অনুভব করে যে এবার তাদের ভারত ছাড়ার সময় হয়েছে । আন্দোলনের গভীরতা উপলব্ধি করে লিনলিথগাের পরবর্তী বড়ােলাট লর্ড ওয়াভেল লিখেছিলেন , যুদ্ধ শেষ হলে ভারতকে স্বাধীনতা দিতে বাধ্য হওয়ার আগেই ভারতীয় নেতাদের সঙ্গে আলােচনা শুরু করা উচিত ।
কংগ্রেসি মর্যাদার পুনঃপ্রতিষ্ঠা
আন্দোলন চলাকালীন মহাত্মা গান্ধীর অনশন জাতির হৃদয়ে কংগ্রেসের মর্যাদাকে পুনরায় অধিষ্ঠিত করে । এই আন্দোলনের মধ্যে দিয়েই সংশয়াতীতভাবে প্রমাণিত হয় কংগ্রেসের জনপ্রিয়তা ব্যাপক এবং সর্বাত্মক ।
নতুন নেতৃত্বের আবির্ভাব
আন্দোলন পরিচালনার প্রয়ােজনে নতুন নতুন নেতার আবির্ভাবের মধ্যে দিয়ে ভারতবাসীর সংগ্রামী শক্তি ও স্বাধীনতা লাভের ইচ্ছা যে কত প্রবল ও প্রচণ্ড তাও সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয় ।
ভারতের স্বাধীনতা সুনিশ্চিতকরণ
সর্বোপরি , মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্বে এই সংগ্রাম অহিংসা নীতিকে সম্পূর্ণভাবে মেনে চলতে ব্যর্থ হলেও , ভারতীয় স্বাধীনতাকে সুনিশ্চিত করেছিল । এই দিকটি বিবেচনা করলে আগস্ট আন্দোলন ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে এক চিরস্মরণীয় অধ্যায় ।
গণ আন্দোলন হিসেবে
ভারত ছাড়াে আন্দোলন প্রকৃত অর্থেই হয়ে উঠেছিল সর্ববৃহৎ জাতীয় গণ আন্দোলন । এই আন্দোলনে শ্রমিক ও কৃষকসহ সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি স্বতঃস্ফূর্তভাবে শামিল হয়ে একে গণ আন্দোলনের রূপ দান করে । নিখিল ভারত কংগ্রেস কমিটিও এই আন্দোলনকে ‘ গণযুদ্ধ ’ আখ্যা দিয়েছিল ।
উপসংহার
ভারত ছাড়াে আন্দোলনের গুরুত্ব এখানেই যে — এই আন্দোলনই ঠিক করে দেয় , ভারতবাসী স্বাধীনতা পাচ্ছে । কবে সেই স্বাধীনতা আসছে শুধু সেই প্রশ্নের উত্তরটুকুই বাকি থাকে । প্রকৃতপক্ষে এই আন্দোলনের তীব্রতাকে ভয় পেয়েই ব্রিটিশ সরকার সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছিল যে , ভারতবাসীকে এবার স্বাধীনতা প্রদান করতে হবে।