ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে আজাদ হিন্দ ফৌজের ভূমিকা
Contents
ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে আজাদ হিন্দ ফৌজের ভূমিকা
ভারতের মুক্তি সংগ্রামে এবং ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে আজাদ হিন্দ ফৌজের অবদান অবিস্মরণীয় । বিদেশের মাটিতে দাঁড়িয়ে আই. এন. এ. বাহিনী যেভাবে দেশের স্বাধীনতার জন্য লড়াই চালিয়েছিল তা ছিল সব প্রশংসার ঊর্ধ্বে । গান্ধীজী আজাদি সেনাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে বলেছিলেন , যদিও আজাদ হিন্দ ফৌজ তাদের লক্ষ্যে পৌঁছােতে পারেনি , তথাপি তারা এমন অনেক কিছু করেছে , যেজন্য তারা গর্ববােধ করতে পারে ।
আজাদ হিন্দ বাহিনী গঠন
জাপানে প্রবাসী ভারতীয় বিপ্লবী রাসবিহারী বসু ভারতীয়দের সংগঠিত করার উদ্দেশ্যে ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের ১৫ জুন ব্যাংককে স্বাধীনতাকামী ভারতীয়দের এক সম্মেলন আহ্বান করেন । এই সম্মেলনে ‘ ইন্ডিয়ান ইন্ডিপেন্ডেন্স লীগ ’ বা ‘ ভারতীয় স্বাধীনতা সংঘ ’ গঠিত হয় । রাসবিহারী বসু এর সভাপতি হন । ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের ১ সেপ্টেম্বর সিঙ্গাপুরে ‘ আজাদ হিন্দ ফৌজ ’ গঠনের কথা প্রকাশ্যে ঘােষণা করা হয় । এই প্রসঙ্গে রাসবিহারী বসু ও মােহন সিং – এর নাম উল্লেখযােগ্য । এই ফৌজে যােগদানকারী ভারতীয় সেনাদের উপযুক্ত শিক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয় । মােহন সিং ছিলেন এর প্রধান সেনাপতি । রাসবিহারীর আমন্ত্রণে সুভাষচন্দ্র জাপানে আসেন ও আজাদ হিন্দ ফৌজের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন ।
আজাদ হিন্দ ফৌজের সংগঠন
সুভাষচন্দ্র সর্বাধিনায়ক হয়ে আজাদ হিন্দ ফৌজের পুনর্গঠন করেন ।
( i ) আজাদ হিন্দ ফৌজে যােগ দেওয়ার জন্য জাপানের হাতে বন্দি ভারতীয় সৈন্যদের সংগঠিত করা হয় । ২০ হাজার ভারতীয় সেনা ফৌজে যােগ দেন ।
( ii ) সুভাষ আজাদ হিন্দ ফৌজকে পাঁচটি ব্রিগেডে বিভক্ত করেন । লক্ষ্মী স্বামীনাথন এর নেতৃত্বে ঝাঁসির রানি নামে একটি নারী বাহিনী গঠন করা হয় । অন্য চারটি বাহিনী হল — গান্ধী ব্রিগেড , সুভাষ ব্রিগেড , নেহরু ব্রিগেড ও আজাদ ব্রিগেড । আজাদ হিন্দ ফৌজ ছিল অসাম্প্রদায়িক । শাহনওয়াজ খান , জি. এস. ধীলন এবং পি. কে. সায়গল ছিলেন এই বাহিনীর তিন বিশিষ্ট সেনানায়ক । দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার ভারতীয় ব্যবসায়ীরা আজাদ হিন্দ ফৌজকে আর্থিক সাহায্য দিতে এগিয়ে আসেন ।
আজাদ হিন্দ সরকার প্রতিষ্ঠা
আইরিশ ( আয়াল্যান্ড ) বিপ্লবীদের দৃষ্টান্ত অনুসারে সুভাষচন্দ্র সিঙ্গাপুরে আজাদ হিন্দ সরকার প্রতিষ্ঠা করেন ( ২১ অক্টোবর , ১৯৪৩ খ্রি. ) । এই সরকারের প্রধানম প্রধান সেনাপতি হন সুভাষচন্দ্র বসু । জাপান , জার্মানি , ইতালিসহ আরও ছয়টি রাষ্ট্র এই অস্থায়ী সরকারকে স্বীকৃতি দেয় । জাপান সরকার তার অধিকৃত আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ আজাদ হিন্দ সরকারকে অর্পণ করে । এদের নতুন নাম হয় যথাক্রমে শহিদ ও স্বরাজ দ্বীপ । সুভাষচন্দ্র ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দের ৩১ ডিসেম্বর আন্দামানে উপস্থিত হয়ে স্বাধীন ভারতের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন । তিনি যুবসমাজের মনে আগুন জ্বালিয়ে বলেন “ তােমরা আমাকে রক্ত দাও , আমি তােমাদের স্বাধীনতা দেব ” । তিনি দিল্লি চলাে , ‘ জয় হিন্দ ’ ধ্বনি দিয়ে বাহিনীর জওয়ানদের উদ্বুদ্ধ করেন ।
আজাদ হিন্দ ফৌজের ভারত অভিযান
আন্দামান থেকে সুভাষচন্দ্র ব্রম্ভদেশে যান এবং সেখান থেকে ভারত অভিযান শুরু করেন । প্রথমে আজাদ হিন্দ ফৌজ আরাকান দখল করে ( ৪ ফেব্রুয়ারি , ১৯৪৪ খ্রি. ) । এরপর ১৮ মার্চ আজাদ হিন্দ ফৌজ ব্রম্ভদেশ অতিক্রম করে ভারতের মাটি স্পর্শ করে । মণিপুরের মৈরাং – এ ভারতের জাতীয় পতাকা উত্তোলন ( ১৪ এপ্রিল ) করা হয় । মণিপুরের কোহিমা শহরটি আজাদ হিন্দ ফৌজ দখল করে । এরপর শুরু হয় ইম্ফল দখলের লড়াই । কিন্তু প্রবল প্রাকৃতিক বিপর্যয় ফৌজের সব ধরনের প্রয়াস ব্যর্থ করে দেয় ।
আজাদ হিন্দ ফৌজের আত্মসমর্পণ
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষ দিকে ইঙ্গ-মার্কিন বাহিনীর আক্রমণে জাপান বিধ্বস্ত হয়ে পড়লে জাপানের কাছ থেকে সাহায্যের সম্ভাবনা শেষ হয়ে যায় । ফলে আজাদ হিন্দ ফৌজকেও আত্মসমর্পণ করতে হয় । এরপর নেতাজির ইতিহাস রহস্যের অবগুণ্ঠনে আবৃত ।
আজাদ হিন্দ ফৌজের ব্যর্থতার কারণ
আজাদ হিন্দ ফৌজের ভারত অভিযান আপাত দৃষ্টিতে ব্যর্থ হয় । এই ব্যর্থতার নানা কারণ ছিল ।
( i ) দুর্গম পর্বত সংকুল এলাকায় প্রবল প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের জন্য ফৌজ যথাযথ ভাবে লড়াই করতে পারেনি ।
( ii ) জাপানের সমর্থন ও সহযােগিতা ছিল বহুলাংশে ভাঁওতা । জাপানি শক্তির সাহায্যের ওপর নির্ভরশীলতা আজাদ হিন্দ বাহিনীকে দুর্বল করেছিল ।
( iii ) আজাদ হিন্দ ফৌজ দেশের অভ্যন্তরে রাজনৈতিক দলগুলির কাছ থেকে যথাযথ সমর্থন পায়নি ।
আজাদ হিন্দ ফৌজের গুরুত্ব
আপাত ব্যর্থ হলেও ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে আজাদ হিন্দ ফৌজের অবদান অস্বীকার করা যায় না ।
( i ) আজাদ হিন্দ ফৌজ নানা ধর্ম ও জাতির মানুষকে সমন্বিত করে একতা ও জাতীয় সংহতির মহৎ আদর্শ স্থাপন করে ।
( ii ) এই ফৌজের বীরত্বপূর্ণ সংগ্রাম ও আত্মত্যাগ ভারতীয়দের স্বাধীনতা সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ করে ।
( iii ) ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দে বােম্বাইতে নৌ সেনার বিদ্রোহের অনুপ্রেরণা ছিল আজাদ হিন্দ বাহিনীর আত্মত্যাগ ।
মূল্যায়ন
সুভাষচন্দ্রের নেতৃত্বে আজাদ হিন্দ ফৌজের লড়াই ভারতের স্বাধীনতার প্রশ্নকে একটি আন্তর্জাতিক বিষয়ে উন্নীত করে । আজাদি সেনাদের নিঃস্বার্থ আত্মত্যাগ ও আত্মবলিদান প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে ভারতবাসীকে দেশাত্মবােধে উদ্বুদ্ধ করবে এ বিষয়ে কোনাে সন্দেহ নেই । গান্ধীজী বলেছেন , তাঁরা একই পতাকাতলে ভারতের সব ধর্ম ও জাতির মানুষকে একত্রিত করেছিলেন , ধর্মীয় ভেদ বুদ্ধির উর্ধ্বে তাঁরা একতা ও সংহতির আদর্শ সঞ্চারিত করেছেন ।