প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কারণ ও ফলাফল
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কারণ ও ফলাফল
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কারণ ( 1914 খ্রি. )
মানব সভ্যতার ইতিহাসে অন্যতম দুঃখজনক ঘটনা হল প্রথম বিশ্বযুদ্ধ । ১৯১৪-১৯১৮ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত প্রসারিত এই মহাযুদ্ধে বিশ্বের প্রতিটি দেশ কোনাে না কোনােভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল । একাধিক কারণে এই যুদ্ধের সূচনা হয় । যেমন 一
উগ্র জাতীয়তাবাদ :
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অন্যতম প্রধান কারণ উগ্র জাতীয়তাবাদের উদ্ভব ও বিকাশ । প্রত্যেকটি দেশ অপরাপর দেশ ও জাতি থেকে অধিক সম্মান ও গৌরব দাবি করতে থাকে । যেমন জার্মানি টিউটনিক সভ্যতার শ্রেষ্ঠত্বের তত্ত্ব প্রচার করে । এইভাবে ইউরােপের বিভিন্ন দেশ জাতিগত অহমিকা ও পারস্পরিক ঘৃণা প্রদর্শন করে জাতিগত প্রতিদ্বন্দ্বিতার সৃষ্টি করে ।
অতৃপ্ত জাতীয়তাবাদ :
অতৃপ্ত বলকান জাতীয়তাবাদ প্রথম বিশ্বযুদ্ধকে ত্বরান্বিত করে । বসনিয়া ও হারজিগােভিনা ছিল সার্বিয়ার প্রাপ্য । কিন্তু বার্লিন কংগ্রেসে ওই দুটি স্থানের ওপর অস্ট্রিয়ার কর্তৃত্ব স্থাপিত হয়েছিল । এই বিধান বসনিয়া-হারজিগােভিনার অধিবাসীরা কখনােই মেনে নিতে পারেনি ।
বিরোধী রাষ্ট্র জোট গঠন :
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালে ইউরােপের দেশগুলি দুটি পরস্পর বিরােধী শক্তিজোটে বিভক্ত হয়ে পড়ে । একদিক জার্মানি , অস্ট্রিয়া ও ইতালির সমন্বয়ে গঠিত হয় ট্রিপল অ্যালায়েন্স বা ত্রিশক্তি চুক্তি । অন্যদিকে ইংল্যান্ড , ফ্রান্স ও রাশিয়ার মধ্যে গঠিত হয় ট্রিপল আঁতাত বা ত্রিশক্তি মৈত্রী । শান্তিরক্ষার পরিবর্তে এই শক্তিজোট দুটি পরস্পর প্রতিদ্বন্দ্বিতার সম্মুখীন হয় ।
বাণিজ্য প্রতিযোগিতা :
আফ্রিকা ও এশিয়া মহাদেশে ইউরােপীয় সাম্রাজ্যবিস্তার নীতির ফলে বৃহৎ শক্তিবর্গের মধ্যে রেষারেষির সৃষ্টি হয় । ইংল্যান্ড , ফ্রান্স ও জার্মানির মধ্যে বাণিজ্যিক দ্বন্দ্ব , অস্ট্রিয়া ও রাশিয়ার মধ্যে অর্থনৈতিক দ্বন্দ্ব সংঘাতের সুত্রপাত করে । কালক্রমে এই দ্বন্দ্ব বিশ্বযুদ্ধকে অবশ্যম্ভাবী করে তােলে ।
সামরিক প্রতিযোগিতা :
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অন্যতম কারণ ছিল বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যে সামরিক প্রতিযােগিতা । বিভিন্ন ইউরােপীয় রাষ্ট্রের মধ্যে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রতিযােগিতা বৃদ্ধি পেলে প্রত্যেকেই নিজেদের সামরিক শক্তি বৃদ্ধি করতে থাকে । এই সুযােগে শিল্পপতিগণ গড়ে তােলেন নানা ধরনের অস্ত্র তৈরির বহু কারখানা । একদিকে বৃহৎ রাষ্ট্রবর্গের হাতে মজুত বিপুল অস্ত্রসম্ভার ও অপরদিকে শিল্পপতিদের পরােক্ষ ইন্ধন রাষ্ট্রবর্গকে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে প্ররােচিত করে ।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রত্যক্ষ কারণ
১৯১৪ খ্রিস্টাব্দের ২৮ জুন অস্ট্রিয়ার যুবরাজ ফার্দিনান্দ ও তাঁর স্ত্রী বসনিয়ার রাজধানী সেরাজেভাে পরিদর্শনে গেলে দুজনেই জনৈক বসনিয়াবাসী ছাত্রের হাতে নিহত হন । এই হত্যাকাণ্ডে সার্বিয়ার ইন্ধন আছে — এই অভিযােগ করে অস্ট্রিয়া সার্বিয়াকে এক চরমপত্র দেয় । এই চরমপত্রে দাবি করা হয় —
( i ) সার্বিয়া সরকার অস্ট্রিয়া বিরােধী প্রচার বন্ধ করবে ,
( ii ) অস্ট্রিয়ার দুজন রাজকর্মচারীকে সার্বিয়াতে তদন্তের সুযােগ দিতে হবে ,
( iii ) অস্ট্রিয়া বিরােধী সব ব্যক্তিকে সরকারি চাকরি থেকে বরখাস্ত করতে হবে ,
( iv ) এই হত্যাকাণ্ডের নিন্দা করতে হবে ইত্যাদি । সার্বভৌমত্ব ক্ষুন্ন হবে না এমন শর্তগুলি পূরণ করতে সার্বিয়া রাজি হয় । কিন্তু অন্যগুলি পরবর্তী আন্তর্জাতিক বৈঠকে মীমাংসা করা হবে বলে সার্বিয়া জানায় । এতে সন্তুষ্ট না হয়ে অস্ট্রিয়া সার্বিয়া আক্রমণ করলে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয় ।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ফলাফল
১৯১৪ থেকে ১৯১৮ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত স্থায়ী প্রথম বিশ্বযুদ্ধ সমগ্র মানব সভ্যতাকে চরম সংকটের মুখে ঠেলে দেয় । পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি দেশ প্রত্যক্ষ বা পরােক্ষভাবে এই যুদ্ধ দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল ।
ব্যাপক জীবনহানি :
দীর্ঘস্থায়ী প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ধ্বংসলীলা ছিল অভূতপূর্ব । এই যুদ্ধে প্রায় ২৬ লক্ষ সৈন্য নিহত হয় । আহত হয় প্রায় ৭০ লক্ষ মানুষ । এছাড়াও যুদ্ধজনিত মহামারি , দুর্ভিক্ষ প্রভৃতি কারণে প্রাণহানি ঘটে বহু মানুষের ।
ইংল্যান্ড , ফ্রান্সের অবনমন :
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স প্রচুর ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয় । একসময়ে এই দুটি দেশ ছিল বিশ্বের শ্রেষ্ঠ শক্তি ও সম্পদের অধিকারী । বিশ্বযুদ্ধের পর ইংল্যান্ড , ফ্রান্স দ্বিতীয় শ্রেণির শক্তিতে পরিণত হয় ।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার উত্থান :
বিশ্ব রাজনীতিতে প্রথম শ্রেণির শক্তি হিসেবে উঠে আসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সােভিয়েত ইউনিয়ন । পরবর্তী কয়েক দশক এই দুটি দেশ ইউরােপ তথা বিশ্ব রাজনীতিতে নিয়ন্ত্রকের ভূমিকা নেয় ।
গণতন্ত্রের জয় :
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে গণতন্ত্র ও শুভচেতনার জয় ঘােষিত হয় । জার্মানি , অস্ট্রিয়া প্রভৃতি শক্তির পতন এবং ইংল্যান্ড , ফ্রান্স প্রভৃতি উদারতান্ত্রিক ও গণতন্ত্রবাদী দেশের জয়লাভ অসৎ – এর বিরুদ্ধে সৎ , অশুভের বিরুদ্ধে শুভ চেতনার সাফল্য নির্দেশ করে ।
জাতীয়তাবাদের বিজয় :
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে গণতন্ত্রের বিজয় বিশ্বের বিভিন্ন ঔপনিবেশিক দেশগুলিতে গণজাগরণের সম্ভাবনা সৃষ্টি করে । পরাধীন জাতিগুলি বিদেশি শাসন থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য নতুন ভাবে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে । বিশ্বযুদ্ধে ইংল্যান্ড , ফ্রান্স প্রভৃতি দেশ দুর্বল হয়ে পড়ায় , তারাও উপনিবেশগুলিকে মুক্তি দেওয়ার প্রয়ােজন অনুভব করে । প্রথম বিশ্বযুদ্ধকালে ও পরে গান্ধীজির নেতৃত্বে ভারতেও স্বাধীনতার আন্দোলন জোরদার হয় ।
শ্রমিক জাগরণ :
যুদ্ধে শ্রমিকশ্রেণী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল । এই সংকটের সময় শ্রমিকশ্রেণী তাদের গুরুত্ব উপলব্ধি করতে পারে । মারণাস্ত্র ও বিবিধ সরঞ্জাম তৈরি করে শ্রমিকশ্রেণী তাদের নিজ নিজ দেশের সেনাবাহিনী , সরকার , অর্থনীতি ইত্যাদি ক্ষেত্রে শক্তি সঞ্জয় করতে সহায়তা করে । শ্রমিকের শ্রমই রাষ্ট্রের সম্পদ সৃষ্টির উৎস — এই ধারণা প্রতিষ্ঠিত হলে শ্রমিকদের সামাজিক মর্যাদা ও অর্থনৈতিক সুযােগসুবিধা বৃদ্ধির সম্ভাবনা দৃঢ় হয় ।
আন্তর্জাতিকতাবাদের প্রসার :
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ধ্বংসলীলা মানুষকে শান্তি ও নিরাপত্তার জন্য উন্মুখ করে তােলে । আন্তর্জাতিক স্তরে সৌহার্দ্য ও সমঝােতা যে শান্তি ও নিরাপত্তার প্রধান শর্ত — এই সত্য মানুষের কাছে স্পষ্ট হয় । বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মধ্যে ঐক্য ও সম্প্রীতি রক্ষার মাধ্যম হিসেবে গড়ে ওঠে জাতিসংঘ বা লীগ অব নেশনস নামক আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান ।
Very good..