ইতিহাস

বঙ্গভঙ্গ বিরোধী স্বদেশী ও বয়কট আন্দোলন কি

Contents

বঙ্গভঙ্গ বিরোধী স্বদেশী ও বয়কট আন্দোলন কি

ভারতে ব্রিটিশ শাসনের এক কলঙ্কজনক ঘটনা ছিল বঙ্গবিভাগের সিদ্ধান্ত । লর্ড কার্জনের নেতৃত্বে ইংরেজ সরকারের এই জঘন্য ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে সারা দেশে তীব্র আলােড়ন সৃষ্টি হয় । ভগিনী নিবেদিতার  মতে , স্বদেশী বয়কট হল একই জিনিসের দুটি প্রয়ােজনীয় দিক । একটিকে বাদ দিয়ে অপরটি বিকশিত হতে পারে না ( ” Swadeshi and Boycott are the two necessary aspects of one and the same thing . One cannot flourish and strive without the help of the other ” ) ।

স্বদেশী ও বয়কট আন্দোলনের পটভূমি

১৯০৫ খ্রিস্টাব্দের জুলাই মাসে বঙ্গভঙ্গের সিদ্ধান্ত সরকারি ভাবে ঘােষিত হয় । ফলস্বরূপ দেশের সর্বস্তরের মানুষ ও পত্রপত্রিকা গুলি প্রতিবাদে সােচ্চার হয়ে ওঠে ।

স্বদেশী ও বয়কট আন্দোলনের প্রতিক্রিয়া

সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর ‘ বেঙ্গলী ’ পত্রিকায় বঙ্গভঙ্গের সিদ্ধান্তকে এক গুরুতর জাতীয় বিপর্যয় বলে মন্তব্য করেন । ‘ হিতবাদী ’ পত্রিকা মন্তব্য করে যে , “ বিগত ১৫০ বছরের মধ্যে বাঙ্গালী জাতি এরকম দুর্দিনের সম্মুখীন হয়নি । ” 

1. লন্ডন থেকে প্রকাশিত ‘ ডেইলি নিউজ ’ পত্রিকা বঙ্গভঙ্গের সিদ্ধান্তকে ‘ অদূরদর্শী রাজনৈতিক চিন্তার ফসল ‘ বলে অভিহিত করে ।

2. জাতীয় কংগ্রেস বােম্বাই অধিবেশনে বঙ্গভঙ্গের পরিকল্পনাকে ‘ বাঙালীর জাতিসত্তাকে খণ্ডিত করার অপপ্রয়াস ’ বলে অভিহিত করে । 

স্বদেশী ও বয়কট আন্দোলনের কর্মসূচি

১৯০৫ খ্রিস্টাব্দের ১৬ অক্টোবর বঙ্গভঙ্গ কার্যকরী হবে বলে সরকার ঘােষণা করে । সঙ্গে সঙ্গে বিক্ষোভে ফেটে পড়ে বাংলা । রবীন্দ্রনাথের প্রস্তাব অনুসারে ওই দিনটি রাখি বন্ধন দিবস হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত হয় । রবীন্দ্রনাথের নেতৃত্বে শুরু হয় বিরাট শােভাযাত্রা । অরন্ধন পালিত হয় ঘরে ঘরে । বন্ধ থাকে সমস্ত হাটবাজার , দোকানপাট । 

বিদেশি দ্রব্য বর্জন ও স্বদেশী দ্রব্য গ্রহণ — এই দুটি ছিল স্বদেশী আন্দোলনের প্রধান কর্মসূচি । ‘ সঞ্জীবনী ’ কাগজের সম্পাদক কৃষ্ণকুমার মিত্র  দেশবাসীকে বিদেশি দ্রব্য বর্জন ও স্বদেশি দ্রব্য গ্রহণের আহ্বান জানালে তা সমস্ত স্তরের মানুষের মধ্যে সাড়া জাগায় । বস্তুত বয়কট ও স্বদেশি একই ভাবধারার দুটি প্রকাশ । বয়কট ছিল নেতিবাচক এবং স্বদেশি ছিল ইতিবাচক দিক ।  

স্বদেশী ও বয়কট আন্দোলনে সাহিত্য ও পত্র পত্রিকার ভূমিকা

স্বদেশি আন্দোলনে প্রেরণা জোগাতে রচিত হয় বহু স্বদেশি – আদর্শ ভিত্তিক কবিতা , গান ও নাটক । এগুলির মধ্যে উল্লেখযােগ্য হল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের  “ বাংলার মাটি বাংলার জল , বাংলার বায়ু , বাংলার ফল , পুণ্য হউক , পুণ্য হউক , পুণ্য হউক , হে ভগবান ” ; রজনীকান্ত সেনের  “ মায়ের দেওয়া মােটা কাপড় মাথায় তুলে নে রে ভাই ” , মুকুন্দ দাসের  “ ফেলে দে রেশমী চুড়ি বঙ্গনারী কভু হাতে আর পরাে না ” ইত্যাদি । দ্বিজেন্দ্রলাল রায় রচনা করেন মেবার পতন ’ , ‘ দুর্গাদাস ’ , ‘ প্রতাপ সিংহ ’ প্রভৃতি দেশাত্মবােধক নাটক । 

এর পাশাপাশি বিভিন্ন পত্র পত্রিকা , যেমন ‘ বেঙ্গলী ’ , ‘ কেশরী ’ , ‘ দ্য হিন্দু ’ , ‘ মারাঠা ’ , ‘ অমৃতবাজার ‘ , ‘ সঞ্জীবনী ’ , ‘ সন্ধ্যা ’ প্রভৃতি কঠোর ভাষায় ইংরেজের এই অন্যায় কাজের প্রতিবাদ জানায় ।

স্বদেশী ও বয়কট আন্দোলনের প্রসার

অল্পদিনের মধ্যেই স্বদেশি আন্দোলন সর্বাত্মক ও ব্যাপক আকার ধারণ করে । 

1. প্রতিষ্ঠিত হয় স্বদেশি কাপড়ের কল , ব্যাংক , গেঞ্জি মােজা , বিভিন্ন প্রসাধনী দ্রব্যের কারখানা ইত্যাদি । আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় প্রতিষ্ঠা করেন ‘ বেঙ্গল কেমিক্যাল ’ , ডা. নীলরতন সরকার প্রতিষ্ঠা করেন জাতীয় সাবান কারখানা , জামসেদজি টাটা প্রতিষ্ঠা করেন টাটা আয়রন অ্যান্ড স্টিল কোম্পানি । 

2. দলে দলে স্বেচ্ছাসেবকরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে স্বদেশি দ্রব্য বিক্রি করতে থাকেন । 

3. সেই সঙ্গে চলতে থাকে বিদেশি দ্রব্যের দোকানের সামনে লাগাতার পিকেটিং । পুড়িয়ে দেওয়া হয় বহু বিদেশি জিনিস । 

4. বাঙালি ছাত্র-শিক্ষক বর্জন করে ইংরেজি বিদ্যালয় । উকিল – মুহুরি ত্যাগ করে ইংরেজের কোর্টকাছারি । এমনকি ধােপা , নাপিত , রাঁধুনি ইত্যাদি শ্রেণির কর্মীরাও বর্জন করে তাদের ইংরেজ মালিকদের । 

স্বদেশী ও বয়কট আন্দোলনে ছাত্র সমাজের ভূমিকা

স্বদেশী ও বয়কট আন্দোলনে প্রধান শক্তি ছিল ছাত্র সমাজ । ছাত্রদের আন্দোলন থেকে দূরে রাখার উদ্দেশ্যে সরকার কার্লাইল সার্কুলার জারি করে । 

আন্দোলনে যােগদানকারী ছাত্র ও তাদের বিদ্যালয়ের উদ্দেশে শাস্তিমূলক ব্যবস্থার নির্দেশ দেওয়া হয় । এর প্রতিবাদে আন্দোলনকারীরা গঠন করে অ্যান্টি-সার্কুলার সােসাইটি

বঙ্গভঙ্গ প্রত্যাহার 

সরকারি দমন নীতির প্রবল চাপে আন্দোলনের গতি ধীরে ধীরে স্তিমিত হয়ে আসে । তবে পূর্ব বাংলার ঢাকা ও বরিশাল জেলায় অশ্বিনী কুমার দত্তের নেতৃত্বে এই আন্দোলন গণমুখী ও দুর্বার হয়ে ওঠে । শেষ পর্যন্ত সম্রাট পঞ্চম জর্জ দিল্লিতে এসে বঙ্গভঙ্গ প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত ঘােষণা করতে বাধ্য হন ( ১৯১১ খ্রি. ) । 

স্বদেশী ও বয়কট আন্দোলনের গুরুত্ব

জাতীয় আন্দোলনের মূল ধারায় এই আন্দোলন ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ । 

1. এই আন্দোলন জাতীয় আন্দোলনের মর্যাদা পেয়েছিল ।  

2. নরমপন্থী আদর্শের খােলস ছেড়ে বেরিয়ে এসে এই আন্দোলন এক নতুন পথ ধরে অগ্রসর হয়েছিল । 

3. আন্দোলনে সমাজের সকল স্তরের মানুষ সমর্থন জানানােয় আন্দোলন গণমুখী হয়ে উঠেছিল । 

মূল্যায়ন 

স্বদেশী ও বয়কট আন্দোলন ছিল ভারতবাসীর প্রথম জাতীয়তাবাদী গণ আন্দোলন । এই আন্দোলনের ফলে বাংলাদেশ সমগ্র ভারতবর্ষের সামনে ভারতীয় জাতীয়তাবাদের অভূতপূর্ব দৃষ্টান্ত তুলে ধরলেও তা একেবারে ত্রুটিমুক্ত ছিল না । অমলেশ ত্রিপাঠী  তাঁর ‘ Extremist Challenge ‘ গ্রন্থে বলেছেন , বিশাল আওয়াজ ও প্রতিধ্বনি করে শুরু হলেও এই আন্দোলন অবশেষে কাতর আওয়াজ করে থেমে যায় ( “ The increment began with a bang and ended with a whimper ” )।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!