জোসেফ ম্যাৎসিনি এর অবদান
Contents
জোসেফ ম্যাৎসিনি এর অবদান
উনিশ শতকে ইতালির জাতীয় আন্দোলনে তিনটি স্বতন্ত্র ধারা লক্ষ করা যায় । যাজক জিওবার্তির নেতৃত্বে পরিচালিত নব্য গুয়েলফ বা পােপপন্থী আন্দোলন ও রাষ্ট্রনেতা মাসিমাে দ্য আজেগলিওর নেতৃত্বে ইতালির ঐক্য আন্দোলন । এই দুই ধারার পাশাপাশি তৃতীয় ধারাটি ছিল জোসেফ ম্যাৎসিনির ( ১৮০৫-১৮৭২ খ্রি. ) নেতৃত্বে ইতালির ঐক্য ও স্বাধীনতা আন্দোলন । তিনি ছিলেন ইতালির ঐক্য আন্দোলনের প্রাণপুরুষ তথা স্বাধীনতাযজ্ঞের প্রথম পুরােহিত । ঐতিহাসিক সি. ডি. হ্যাজেন বলেছেন — ম্যাৎসিনি ছিলেন ইতালির পুনর্জাগরণের আধ্যাত্মিক শক্তি , নব ইতালির পথপ্রদর্শক (‘ Mazzini was the spiritual force of the Italian resurrection . The prophet of a state that was not yet.’)।

জোসেফ ম্যাৎসিনি এর আদর্শ
ম্যাৎসিনি ছাত্রাবস্থা থেকেই স্বাধীন , ঐক্যবদ্ধ , গণপ্রজাতন্ত্রী ইতালির স্বপ্ন দেখতেন । তিনি প্রতিজ্ঞা করেন মাতৃভূমি ঐক্যবদ্ধ না হওয়া পর্যন্ত শােকের চিহ্নস্বরূপ কালাে পােশাক পরবেন । বলা বাহুল্য সারাজীবনই তিনি তা পরেছিলেন । তিনি জনগণের সার্বভৌমত্বে বা প্রজাতন্ত্রে বিশ্বাস করতেন , রাজতন্ত্রের প্রতি তার আস্থা ছিল না । ম্যাৎসিনি বলতেন জনগণের গণ আন্দোলনের মধ্যে দিয়েই ইতালির স্বাধীনতা আসবে । তার বিশ্বাস ছিল ইতালি থেকে অস্ট্রিয়াকে সরানাের জন্য ইতালির যুবসম্প্রদায়ই যথেষ্ট , এজন্য বিদেশি সাহায্যের দরকার নেই ।‘ ডিউটিজ অব ম্যান ’ প্রবন্ধে ম্যাৎসিনি তার বিশ্বজনীন জাতীয়তাবাদী আদর্শ ঘােষণা করে বলেন — ঐক্যবদ্ধ ইতালি সমগ্র মানবজাতির শান্তি ও স্বাধীনতার লক্ষ্যে কাজ করে যাবে । ম্যাৎসিনির আদর্শের মূল ধারণা ছিল — ঈশ্বর , জনগণ ও মানবতাবাদ ( God , People and Humanity )।
জোসেফ ম্যাৎসিনি এর দলগঠন
ইয়ং ইতালি গঠন :
ফ্রান্সের মার্সেই শহরে থাকাকালীন ম্যাৎসিনি ইয়ং ইতালি বা নব্য ইতালি ( Giovine Italia ) দল গঠন করেন ( ১৮৩২ খ্রি. ) । চল্লিশ বছর বয়সের মধ্যেকার যে – কোনাে ইতালিবাসী এই দলের সদস্য হতে পারত । এই দলের পতাকার একদিকে লেখা থাকত স্বাধীনতা ও ঐক্য এবং অন্যদিকে ছিল গণতন্ত্র , সাম্য ও মানবতা । ইতালিকে ঐক্যবদ্ধ করার পাশাপাশি এই দলের অন্যান্য আদর্শ ছিল শিক্ষার প্রসার ঘটানাে এবং আত্মত্যাগ ও কর্তব্যপালনের মাধ্যমে জাতীয়তাবােধের জাগরণ ঘটানাে । তিনি এই দলের কাছে তাঁর আদর্শ তুলে ধরে বলেন — সমগ্র ইতালি ও সকল ইতালিবাসীর নামে আন্দোলন করাে , অন্য কোনাে নামে নয় (‘ Never rise in any other name than that of Italy and of all Italy ’) ।
ইয়ং ইউরােপ গঠন :
ইতালির ঐক্য আন্দোলনকে আরও সুদৃঢ় করে তােলার লক্ষ্যে ম্যাৎসিনি গঠন করেন ‘ ইয়ং ইউরােপ ’ নামে এক সংগঠন ( ১৮৩৪ খ্রি. ) । এই সংগঠনের সাহায্যে ম্যাৎসিনি ইতালির যুবকদের স্বাধীনতা আন্দোলনে অনুপ্রাণিত করেন ।
জোসেফ ম্যাৎসিনি এর প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় অবদান
ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের প্রভাবে প্রভাবিত হয়ে ম্যাৎসিনি ইয়ং ইতালি দলকে উদ্বুদ্ধ করে ইতালির ঐক্য আন্দোলনকে সংঘবদ্ধ রূপ দেন । তাঁর সুদক্ষ নেতৃত্বে সমগ্র ইতালিতে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন চরমে পৌঁছােয় । পিডমন্ট – সার্ডিনিয়ার রাজা চার্লস অ্যালবার্ট জাতীয় আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন । ভেনিসে প্রতিষ্ঠিত হয় প্রজাতন্ত্র । রােমে বিদ্রোহের তীব্রতায় পােপ রােম ত্যাগ করতে বাধ্য হন । ম্যাৎসিনির উদ্যোগে রােম ও টাস্কেনিতে প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয় । কিন্তু অচিরেই অস্ট্রিয়া ও ফ্রান্সের মিলিত সেনাবাহিনী ইতালির গণ আন্দোলনের অবসান ঘটায় । পােপ তাঁর হারানাে রাজ্য ফিরে পান । ব্যর্থ হয়ে ম্যাৎসিনি ইংল্যান্ডে চলে যান এবং সেখানেই জীবনের শেষ কটা দিন অতিবাহিত করেন ।
জোসেফ ম্যাৎসিনি এর কৃতিত্ব
ম্যাৎসিনিই যে ইতালির মুক্তি আন্দোলনের আত্মা ছিলেন , একথা কেউই অস্বীকার করতে পারেন না । নিজ আদর্শ ও কর্মপন্থা দ্বারা আঞ্চলিকতাবাদ ও প্রাদেশিকতাবাদে আচ্ছন্ন থাকা ইতালিবাসীকে ‘ এক জাতি , এক প্রাণ ’ মন্ত্রে তিনিই দীক্ষিত করে তােলেন । বিভিন্ন বিভেদ , বিচ্ছিন্নতা থাকা সত্ত্বেও ম্যাৎসিনি ইতালিবাসীকে প্রথম অনুভব করতে শেখান যে তারা এক জাতি , এক সংস্কৃতি , এক দেশের অধিবাসী । তিনি ইয়ং ইতালি দলের মধ্য দিয়ে ইতালিবাসীর স্বপ্নপূরণের চেষ্টা করেন । প্রাদেশিক ও আঞ্চলিক বিভেদ দূর করে তিনিই ইতালিবাসীকে জাতীয় ঐক্যের আদর্শে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন । বােল্টন কিং – এর মতে জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের সঙ্গে ইতালিবাসীর যােগসূত্র স্থাপন ম্যাৎসিনির প্রধান কৃতিত্ব ।
জোসেফ ম্যাৎসিনি এর ব্যর্থতা
কার্বোনারি আন্দোলনের মতাে ইয়ং ইতালি আন্দোলনও ইতালিকে ঐক্যবদ্ধ করতে পারেনি । জ্যাক ড্রজ বলেছেন তিনি দেশপ্রেমিক ছিলেন ; কিন্তু তাঁর রাজনৈতিক প্রতিভা ছিল না । মার্কসবাদীদের মতে — ম্যাৎসিনি সমাজতন্ত্র সম্পর্কে বিরূপ ছিলেন , তাই শ্রমজীবী শ্রেণিই তাঁর আন্দোলন থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল । বাস্তব রাজনীতির পরিবর্তে তিনি আবেগপ্রবণতাকে প্রাধান্য দিয়েছিলেন । তাই ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের ( ১৮৪৮ খ্রি. ) সূত্র ধরে ইতালিতে গণ আন্দোলন উত্তাল হয়ে উঠলেও শেষপর্যন্ত তা ব্যর্থ হয় ।
মূল্যায়ন
স্বাধীনতার জন্য সবার আগে মানসিক প্রস্তুতির প্রয়ােজন — একথা তিনিই প্রথম ইতালিতে প্রচার করেন । জাতীয় মুক্তি আন্দোলনে যুবসম্প্রদায়কে যুক্ত করার কৃতিত্ব তাঁরই । ইয়ং ইতালি দল গঠনের মধ্যে দিয়ে যুবশক্তিকে কাজে লাগানাের নিদর্শন তিনিই সর্বপ্রথম স্থাপন করেন । ইতালিবাসীর জীবনে তিনি ছিলেন নতুন আশার আলােকবর্তিকা । তাই ঐতিহাসিক ই. লিপসন বলেছেন — নব্য – ইতালির স্রষ্টাদের মধ্যে তিনি এক অবিস্মরণীয় স্থানের অধিকারী (‘ Among the makers of modern Italy he holds an imperishable place ’)।