জুলাই বিপ্লবের কারণ

জুলাই বিপ্লবের কারণ

১৮৩০ খ্রিস্টাব্দের জুলাই বিপ্লব ছিল ফ্রান্স তথা ইউরােপের ইতিহাসে এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা । ভিয়েনা সম্মেলনের পরবর্তী সময়কালে যে প্রতিক্রিয়াশীল নীতি গৃহীত হয়েছিল এবং গণতন্ত্র ও জাতীয়তাবাদ দমনের জন্য যে প্রচেষ্টা নেওয়া হয়েছিল তার বিরুদ্ধে ফ্রান্সে এক সফল প্রতিবাদ ছিল জুলাই বিপ্লব । ঐতিহাসিক ই. লিপসনের  মতে – ১৮৩০ খ্রিস্টাব্দের বিপ্লব ছিল ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দের বিপ্লবের পরিপূরক (‘ The Revolution of 1830 was the complement of the Revolution of 1789 ’) ।

index 5
১৮৩০ খ্রিস্টাব্দের জুলাই বিপ্লব

স্বৈরাচারী বুরবোঁ রাজবংশের পুনঃপ্রতিষ্ঠা

ভিয়েনা ব্যবস্থায় গৃহীত ন্যায্য অধিকার নীতি অনুযায়ী ফ্রান্সের সিংহাসনে বুরবোঁ রাজবংশের পুনঃপ্রতিষ্ঠা ঘটে । রাজা অষ্টাদশ লুই সিংহাসনে বসলে ( ১৮১৪-২৪ খ্রি. ) ফ্রান্স থেকে নির্বাসিত যাজক ও অভিজাতরা পুনরায় ফ্রান্সে ফিরে এসে স্বৈরাচারী রাজতন্ত্রের সাহায্য নিয়ে তাদের হারানাে সম্পত্তি ও অধিকার ফিরে পাওয়ার জন্য সচেষ্ট হয়ে ওঠে । এতে ফ্রান্সের অধিবাসীরা ক্ষুদ্ধ হয়ে ওঠে । প্রজাতন্ত্রীদের নেতৃত্বে তারা সংঘবদ্ধ হয় । ফলে পুনরায় বিপ্লবের পরিস্থিতি তৈরি হয় ।

অষ্টাদশ লুই – এর সমন্বয়ী নীতি

বুরবোঁ রাজা অষ্টাদশ লুই মধ্যপন্থীদের উদারনীতির দ্বারা শাসন পরিচালনার সিদ্ধান্ত নেন । এক্ষেত্রে তাঁর উদ্দেশ্য ছিল রাজতন্ত্রের সঙ্গে বিপ্লবী যুগের পরিবর্তনগুলির মেলবন্ধন ঘটিয়ে এক সমন্বয়ী নীতি গ্রহণ করা । তিনি বলেন — জনবিরােধী নীতি গ্রহণ করে আমি আর যাযাবর জীবনে ফিরে যেতে চাই না । ফ্রান্সবাসীর জন্য এক সাংবিধানিক সনদ জারির মাধ্যমে ঘােষিত হয়—

  1. আইনের দৃষ্টিতে সকলেই সমান ।
  2. অবাধ গ্রেপ্তার বা বিনা বিচারে আটকের আইন বাতিল করা হবে ।
  3. প্রজাদের ওপর কর চাপানাের সময় প্রতিনিধি সভার অনুমতি নিতে হবে ।
  4. বার্ষিক ৩০০ ফ্রাঙ্ক করদাতারাই ভােটাধিকার পাবে ।
  5. সম্পত্তি ও ধর্মীয় স্বাধীনতার অধিকার স্বীকৃতি পাবে ।
  6. প্রজারা স্বাধীনভাবে মতামত প্রকাশ্যের অধিকার পাবে ।

এই নীতিগুলি মাত্র তিন বছর ( ১৮১৫-১৮১৮ খ্রি. ) কার্যকর ছিল । এরপর থেকেই অষ্টাদশ লুই স্বৈরাচারী হয়ে উঠলে বিপ্লবের পটভূমি রচিত হয় ।

শ্বেত সন্ত্রাস

উগ্র রাজতন্ত্রীরা নির্বাচনে জিতে আইনসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে । তারা অষ্টাদশ লুই এর সমন্বয়ী নীতির তীব্র বিরােধিতা শুরু করে এবং শ্বেত সন্ত্রাসের মাধ্যমে বিপ্লবী ভাবাদর্শে আস্থাশীল উদারপন্থীদের বিরুদ্ধে ত্রাস সৃষ্টি করে । উগ্রপন্থী আলটারা নেপােলিয়নের সমর্থক মার্শাল লে -সহ কয়েকশাে বিপ্লবী সমর্থককে হত্যা করলে ফরাসিবাসী ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠে । ঐতিহাসিক জ্যাক ড্রুজের  মতে — অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে সমগ্র ফ্রান্স শ্বেত সন্ত্রাসের কাছে মাথা নত করে ( The whole of France bowed down , under the terror ) ।

দশম চার্লসের ভূমিকা

অষ্টাদশ লুই – এর মৃত্যু ( ১৮২৪ খ্রি. ) – র পর তাঁর ভাই ডিউক অব আর্টয়েসদশম চার্লস ’ উপাধি নিয়ে ফ্রান্সের সিংহাসনে বসেন । রাজতন্ত্র ও পুরাতনতন্ত্রের উগ্র সমর্থক হিসেবে তিনি অষ্টাদশ লুই – এর মধ্যপন্থা নীতিকে বর্জন করেন এবং যাজক ও অভিজাতদের বশবর্তী হয়ে স্বৈরশাসন কায়েম করেন । নির্বাসিত জেসুইটদের পুনরায় ফ্রান্সে নিয়ে এসে উচ্চ রাজপদগুলিতে বসান । ধর্ম ও শিক্ষাক্ষেত্রে যাজকদের অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয় । তাই ওয়েলিংটন বলেছেন — এটা ছিল ধর্মযাজকদের দ্বারা ধর্মযাজকদের মাধ্যমে ধর্মযাজকদের জন্য সরকার (‘ It was a government by the priests , through the priests and for the priests ’)।

বিভিন্ন গােষ্ঠীসংঘর্ষ

ফ্রান্সের সংবিধানকে কেন্দ্র করে এক সম্পূর্ণ আলাদা মতাদর্শের উদ্ভব ঘটে । এ সময়ে ফ্রান্সের বিভিন্ন গােষ্ঠী , যেমন — উগ্র রাজতন্ত্রী গােষ্ঠী , সাংবিধানিক গােষ্ঠী , উদারপন্থী গােষ্ঠী , চরমপন্থী গােষ্ঠী একে অপরের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে । যাজক ও অভিজাতদের নিয়ে গঠিত উগ্র রাজতন্ত্রী দল বিপ্লব – পূর্বের রাজনৈতিক অবস্থা ফিরিয়ে আনতে সচেষ্ট হয়ে ওঠে । সংবিধানপন্থী দল সনদ মেনে এবং রাজতন্ত্রের মাধ্যমে জনগণের শাসনতান্ত্রিক উন্নতির দাবি জানান । উদারপন্থীরা নাগরিকদের স্বাধীনতার সুযােগ বৃদ্ধির দিকে লক্ষ রেখে সংবিধান পালটানাের দাবি জানান , চরমপন্থীরা গণপ্রজাতন্ত্র স্থাপনের জন্য সচেষ্ট হয়ে ওঠেন ।

জুলাই অর্ডিন্যান্স

দশম চার্লস চেয়েছিলেন অষ্টাদশ লুইয়ের মধ্যপন্থা নীতির পরিবর্তে পুরাতনতন্ত্রকে অনুসরণ করতে , তাই তিনি মন্ত্রীসভা থেকে ভিলিলকে সরিয়ে পলিগন্যাককে আনেন । পলিগন্যাক চারটি প্রতিক্রিয়াশীল অর্ডিন্যান্স জারি করেন ( ১৮৩০ খ্রি. ২৬ জুলাই ) । এর মাধ্যমে তিনি —

  1. আইনসভা ভেঙে দেন ।
  2. সংবাদপত্রের স্বাধীনতা কেড়ে নেন ।
  3. ভােটাধিকার সংকুচিত করেন ।
  4. অল্পকিছু নাগরিককে ভােটাধিকার দিয়ে নির্বাচনের দিন ঘােষণা করেন ।

জুলাই বিপ্লবের সূচনা

পলিগন্যাক অর্ডিন্যান্স জারি করা মাত্রই উদারপন্থী অ্যাডলফ থিয়ার্সের নেতৃত্বে প্যারিসের সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে ছাত্র , শিক্ষক , শ্রমিক , কৃষকসহ সকলেই প্যারিসের রাজপথে প্রতিরােধ গড়ে তােলে । বিদ্রোহীদের সঙ্গে যােগ দেয় পূর্বেকার জাতীয় রক্ষীবাহিনী । রাজা দশম চার্লস বিদ্রোহীদের দমনের লক্ষ্যে সেনাপতি মায়মন্টের নেতৃত্বে এক বিশাল সেনাবাহিনী পাঠান , কিন্তু সেনাবাহিনী বিদ্রোহ দমনে ব্যর্থ হলে বিদ্রোহীরা প্যারিসের দখল নেয় । তারা দশম চার্লসকে সিংহাসনচ্যুত করে অর্লিয়েন্স বংশীয় লুই ফিলিপকে ফ্রান্সের রাজা হিসেবে ঘােষণা করে । গৌরবময় তিনটি দিনের ( ২৭-২৯ জুলাই ) মধ্যে জুলাই বিপ্লব সম্পন্ন হয় । গর্ডন ক্রেইগের  মতে — দশম চার্লস যেভাবে স্বৈরাচারী ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেন জুলাই বিপ্লব তা ধ্বংস করে (‘ The July Revolution destroyed the system of absolutism that Charles X had been seeking to consolidate ’) ।

Leave a Reply

Your email address will not be published.

x
error: Content is protected !!