ইউরোপীয় শক্তি সমবায় বা কনসার্ট অব ইউরোপ
Contents
ইউরোপীয় শক্তি সমবায় বা কনসার্ট অব ইউরোপ
ইংল্যান্ড , অস্ট্রিয়া , রাশিয়া ও প্রাশিয়া — ভিয়েনা সম্মেলনের এই চার বৃহৎ শক্তি ফরাসি বিপ্লবের ভাবধারা যাতে ইউরােপের শান্তি বিঘ্নিত করতে না পারে সেইজন্য নিজেদের মধ্যে একটি চুক্তি সম্পাদন করে । চতুঃশক্তি মৈত্রী নামে পরিচিত এই চুক্তিকে ভিত্তি করে ইউরােপীয় রাষ্ট্রগুলির মধ্যে যে মিলননীতি স্থাপিত হয় , ইতিহাসে তা ইউরােপীয় শক্তি সমবায় বা কনসার্ট অব ইউরােপ ( ১৮১৫ খ্রি. ) নামে খ্যাত । পরে ফ্রান্স এই শক্তি সমবায়ে যােগ দেয় ।

ইউরোপীয় শক্তি সমবায় বা কনসার্ট অব ইউরোপ এর উদ্দেশ্য
- ইউরােপীয় শক্তি সমবায় গঠনের মধ্যে দিয়ে ইউরােপের বিভিন্ন দেশের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনগুলিকে স্তব্ধ করে দেবার চেষ্টা করা হয় ।
- ফরাসি বিপ্লবের অব্যবহিত পরে নেপােলিয়নের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধগুলি ইউরােপ জুড়ে যে অশান্তির পরিবেশ সৃষ্টি করেছিল তা থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য গঠিত হয় কনসার্ট অব ইউরােপ ।
- এই সংগঠন চেয়েছিল ইউরােপীয় রাজবংশগুলিকে যথাযথভাবে টিকিয়ে রাখতে ।
কর্তব্য
শক্তি সমবায়ের কর্তব্য বিশ্লেষণে দেখা যায় —
যুদ্ধ পরিস্থিতিতে হস্তক্ষেপ :
যুদ্ধবাঁধার সম্ভাবনা রয়েছে এমন ক্ষেত্রে যুদ্ধবিরতির জন্য শক্তি সমবায় হস্তক্ষেপ করবে ।
হস্তক্ষেপ না করা :
অন্য রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে শক্তি সমবায় হস্তক্ষেপ করবে না ।
শান্তিরক্ষার্থে :
ক্ষুদ্র রাষ্ট্রগুলির সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে শক্তি সমবায় শান্তিরক্ষকের দায়িত্ব পালন করবে ।
বিভিন্ন অধিবেশন :
প্রথম অধিবেশন :
ইউরােপীয় শক্তি সমবায় মােট দশ বছর ( ১৮১৫-১৮২৫ খ্রি. ) টিকে ছিল । ভিয়েনা কংগ্রেসের তিন বছর বাদে আই ল্য শ্যাপেলে শক্তি সমবায়ের প্রথম অধিবেশন বসে ( ১৮১৮ খ্রি. ) । এই অধিবেশনে ফ্রান্স থেকে বিদেশি সেনাবাহিনী প্রত্যাহার , ফ্রান্সকে শক্তি সমবায়ের সদস্যপদ দান এবং দাসপ্রথা , উত্তর আফ্রিকার বারবেরির জলদস্যু সমস্যা , আন্তর্জাতিক নৌপরিবহন , নিরস্ত্রীকরণ ইত্যাদি সমস্যা নিয়ে আলােচনা করা হয়।
দ্বিতীয় অধিবেশন :
শক্তি সমবায়ের দ্বিতীয় অধিবেশন বসে ট্রপাে শহরে ( ১৮২০ খ্রি. ) । রাশিয়া এই সম্মেলনে এক প্রস্তাব উত্থাপন করে বলে যে , প্রতিষ্ঠিত কোনাে রাষ্ট্রব্যবস্থার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘােষণা হলে তা দমনের জন্য শক্তি সমবায়ের হস্তক্ষেপ করা উচিত । কিন্তু ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স এই প্রস্তাবের বিরােধিতা করে ।
তৃতীয় , চতুর্থ ও পঞ্চম অধিবেশন :
লাইপেকে তৃতীয় ( ১৮২১ খ্রি. ) ও ভেবােনায় শক্তি সমবায়ের চতুর্থ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় । তৃতীয় সম্মেলনে অস্ট্রিয়াকে নেপলস ও পিডমন্টের বিদ্রোহ দমনের অধিকার দেওয়া হয় । আর চতুর্থ অধিবেশনে স্পেনের ওপর হস্তক্ষেপের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় । ১৮২৫ খ্রিস্টাব্দে সেন্ট পিটার্সবার্গে শক্তি সমবায়ের পঞ্চম অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয় । এই শেষ অধিবেশনটিতে গ্রিসের স্বাধীনতা নিয়ে আলােচনা হয়েছিল ।
ইউরোপীয় শক্তি সমবায় বা কনসার্ট অব ইউরোপ এর ব্যর্থতার কারণ
ইউরােপীয় শক্তি সমবায় ব্যর্থ হয়েছিল কয়েকটি কারণে —
মতাদর্শগত বিরােধ :
বিভিন্ন সদস্য রাষ্ট্রগুলির মধ্যে মতাদর্শগত বিরােধ শক্তি সমবায়ের পতনের অন্যতম কারণ ছিল । ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স গণতান্ত্রিক আদর্শে বিশ্বাসী হলেও অস্ট্রিয়া , প্রাশিয়া ও রাশিয়া ছিল রক্ষণশীল স্বৈরতন্ত্রে বিশ্বাসী ।
স্বতন্ত্র জাতীয় স্বার্থ :
আলাদা আলাদা জাতীয় স্বার্থ শক্তি সমবায়ের উদ্দেশ্যকে সফল হতে দেয়নি । প্রাশিয়ার স্বার্থ ছিল বলকানকেন্দ্রিক , ফ্রান্সের স্বার্থ ছিল স্পেনভিত্তিক , অস্ট্রিয়ার স্বার্থ ছিল জার্মানি ও ইতালিকেন্দ্রিক ।
পারস্পরিক সন্দেহ ও অবিশ্বাস :
পারস্পরিক সন্দেহ ও অবিশ্বাস এই সংগঠনটির পতনকে ত্বরান্বিত করেছিল বলা চলে ।
লক্ষ্যের বিভিন্নতা :
ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স সীমিতভাবে হলেও উদারনৈতিক আন্দোলন ও সামাজিক পরিবর্তনের পক্ষপাতী ছিল , কিন্তু রক্ষণশীল স্বৈরতান্ত্রিক তিন দেশ চেয়েছিল প্রগতিশীল উদারনৈতিক ও গণতান্ত্রিক আদর্শের বিরােধিতার মাধ্যমে শক্তি সমবায়কে পরিচালিত করতে ।
ইংল্যান্ডের বিরােধিতা :
ইংল্যান্ড স্পেনে , ফ্রান্সের হস্তক্ষেপের বিরােধিতা করে । কিন্তু তা অগ্রাহ্য হওয়ায় সে শক্তি সমবায়ের চতুর্থ অধিবেশন ভেরােনা বৈঠক থেকে সরে দাঁড়ায় ।
মূল্যায়ন :
ইউরােপীয় শক্তি সংঘ শেষপর্যন্ত ব্যর্থ হলেও এর কৃতিত্বকে সম্পূর্ণরূপে অস্বীকার করা যায় না । এই সংগঠনটি ব্যক্তিগত বৈঠক ও পারস্পরিক আস্থা অর্জনে যেভাবে সচেষ্ট ছিল তা অবশ্যই প্রসংশনীয় । আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক সমস্যার সমাধানে যৌথ প্রচেষ্টাকে কাজে লাগানাের সদিচ্ছার প্রতিফলন দেখা যায় এর কাজের মধ্যে । এর মাধ্যমেই পরবর্তী শতাব্দীর আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে ইউরােপীয় শক্তি সমবায় তার গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব রেখে গেছে ।