ইতিহাস

তেলেঙ্গানা কৃষক বিদ্রোহ বা তেলেঙ্গানা কৃষক আন্দোলন

Contents

তেলেঙ্গানা কৃষক বিদ্রোহ বা তেলেঙ্গানা কৃষক আন্দোলন

হায়দ্রাবাদের শাসক নিজাম এবং সেখানকার জোতদার ও জমিদারদের কৃষক নিগ্রহের প্রতিবাদে যে গণসংগ্রাম গড়ে উঠেছিল , তা তেলেঙ্গানা বিপ্লব নামে পরিচিত । স্বাধীনতার প্রাক্কালে ( ১৯৪৬ খ্রি. জুলাই ) শুরু হওয়া এই কৃষক আন্দোলন চলেছিল টানা প্রায় পাঁচ বছর ( ১৯৫১ খ্রি. অক্টোবর ) । ১৬ হাজার বর্গমাইল এলাকা জুড়ে প্রায় তিন হাজার গ্রামের তিরিশ লক্ষ কৃষক এই গেরিলা সংগ্রামে যােগ দিয়ে একে প্রকৃত অর্থেই এক গণবিপ্লবের রূপ দিয়েছিল । সুপ্রকাশ রায়ের  মতে — তেলেঙ্গানার সংগ্রাম ছিল একই সঙ্গে জমি ও গণতন্ত্রের সংগ্রাম কৃষকের আদর্শ সংগ্রাম ।

তেলেঙ্গানা কৃষক আন্দোলনের কারণ বা পটভূমি

নিজামের অত্যাচার : 

তেলেঙ্গানা অঞ্চলের বেশির ভাগ কৃষকেরই নিজস্ব জমি বলতে কিছুই ছিল না । মধ্যযুগীয় সামন্ততান্ত্রিক শােষণের মতােই তাদের ওপর নিজাম ও তার বাহিনী অত্যাচার চালাত । 

জোতদারদের শােষণ :

তেলেঙ্গানার কৃষক শ্রেণী জোতদারদের অন্যায় শোষণের শিকার ছিল । 

দেশমুখ ও জমিদারদের জমি গ্রাস : 

ধনী কৃষকের সংখ্যা ছিল মাত্র ৫ থেকে ৭ ভাগ , যাদের এক-একজনের অধীনে ছিল ৪০-৭৫ বিঘা জমি । তাদের জমির ফসলও দেশমুখ ও জমিদার গােষ্ঠী কেড়ে নিত । 

সেলামি প্রথা :

কৃষক পরিবারগুলি বাসস্থানের জন্য একখানি কুঁড়ে তুলতে চাইলেও জমিদারদের অনুমতি নিতে বাধ্য ছিল । শুধু তাই নয় , এর জন্য তাদের সেলামিও দিতে হত । 

বেগার শ্রম : 

অনেক সময় করভারে জর্জরিত কৃষকদের জোতদার – জমিদারদের জমিতে দিনে ঘণ্টা করে বেগার শ্রমদান করতে হত । 

জমিদারের কর : 

বিভিন্ন পূজা পার্বণ , উৎসব , অনুষ্ঠান উপলক্ষ্যে জমিদাররা কৃষকদের কাছ থেকে অতিরিক্ত কর আদায় করত । 

আন্দোলনের সূত্রপাত

তেলেঙ্গানা বিদ্রোহের সূত্রপাত ঘটেছিল ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দের ৪ জুলাই নালগােণ্ডার জলগাঁও গ্রামে । ওই দিন ডােড্ডি কোমারইয়া নামে এক কমিউনিস্ট কর্মী জমিদার রামচন্দ্র রেড্ডির গুন্ডাবাহিনীর হাতে নিহত হন । ওই কমিউনিস্ট কর্মী এক গরিব কৃষকের এক চিলতে জমি ওই জমিদারের গ্রাস থেকে রক্ষা করার চেষ্টা করেছিলেন — এই ছিল তাঁর অপরাধ । 

তেলেঙ্গানা কৃষক আন্দোলনের প্রসার

এরপর আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে বরঙ্গল ও খাম্মাম জেলায় । অন্ধ্র মহাসভা ও কমিউনিস্ট পার্টি একজোট হয়ে নিজামের বিরুদ্ধে প্রচার শুরু করে । তারা জমিতে বেগার খাটা , বেআইনি খাজনা , জমি থেকে উচ্ছেদ এবং পুলিশের বিরুদ্ধে কৃষক শ্রেণীকে রুখে দাঁড়াবার আহ্বান জানায় । তাদের ডাকে সাড়া দিয়ে হায়দ্রাবাদের আটটি তেলুগু ভাষাভাষী জেলার ৩০ লক্ষ দরিদ্র কৃষক আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে ।

তেলেঙ্গানা কৃষক আন্দোলনের অংশগ্রহণকারী

খেতমজুর ও দরিদ্র কৃষক শ্রেণী :

খেতমজুর ও দরিদ্র কৃষকরাই ছিল তেলেঙ্গানা আন্দোলনের মূল চালিকা শক্তি । তাদের দৃঢ়তা , নিষ্ঠা , উদ্যোগ আর আত্মত্যাগের জন্যই এই আন্দোলন গণচরিত্র লাভ করেছিল । গেরিলা পদ্ধতিতে তারা ধনুক ও গুলতি , লাঠি , বল্লম ইত্যাদি দিয়ে আক্রমণ করে সংঘর্ষ জারি রেখেছিল । 

মাঝারি কৃষক : 

হাজার হাজার মাঝারি কৃষক এই বিপ্লবে স্বতঃস্ফূর্তভাবে যােগ দেয় । তারা গেরিলা বাহিনী ও গ্রামরক্ষা বাহিনীতে নাম লিখিয়ে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে । মাঝারি কৃষক পরিবারগুলি এই আন্দোলনকারীদের আশ্রয় দিয়ে ও খাদ্য সরবরাহ করে সাহায্য করেছিল । 

ধনী কৃষক : 

ধনী কৃষক শ্রেণী প্রথমদিকে তেলেঙ্গানা আন্দোলনে যােগ দিয়ে আন্দোলনকে শক্তিশালী করে তুলেছিল । কিন্তু সংগ্রাম ক্রমে সশস্ত্র ও বিপ্লবী আকার নিলে এরা আন্দোলন থেকে দূরে সরে যেতে থাকে । 

ছাত্র সম্প্রদায় : 

হায়দ্রাবাদের ছাত্র সম্প্রদায় তেলেঙ্গানা বিপ্লবে অংশ নিয়ে সারা বিশ্বের সামনে এক উজ্জ্বল নিদর্শন তুলে ধরে । তারা প্রমাণ করে যে , সাহস , বীরত্ব , বুদ্ধি , উদ্যোগ ও কর্মে ছাত্ররা কারও থেকে পিছিয়ে নেই । 

তেলেঙ্গানা কৃষক বিদ্রোহ দমন

নিজাম সরকার তেলেঙ্গানা বিপ্লবকে ধ্বংস করতে ব্যর্থ হয়েছিল। নেহরু – প্যাটেলের নির্দেশে সেনাবাহিনীর জেনারেল জয়ন্তনাথ চৌধুরীর নেতৃত্বে ভারতীয় বাহিনী ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দের ১৩ সেপ্টেম্বর হায়দ্রাবাদে প্রবেশ করে । ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দের ২৬ জানুয়ারি হায়দ্রাবাদ আনুষ্ঠানিকভাবে ভারতভুক্ত হলে তেলেঙ্গানা আন্দোলন প্রত্যাহৃত হয় ( ১৯৫১ খ্রি. ) ।

তেলেঙ্গানা কৃষক আন্দোলনের গুরুত্ব বা তাৎপর্য

তেলেঙ্গানা বিপ্লবই প্রথম ভারতের সামন্ততন্ত্রের মূল ঘাঁটি নিজাম শাহিকে ধ্বংস করতে উদ্যত হয়েছিল । তাই এই বিপ্লবকে ভারতের বৃহৎ সশস্ত্র কৃষি বিপ্লব বলা চলে । 

কৃষকদের ঐক্যবদ্ধ শক্তির প্রকাশ : 

ভারতীয় সমাজের প্রধান চালিকা শক্তি কৃষক ও শ্রমিক শ্রেণীর কাছে শাসকশ্রেণীর রক্তচক্ষু কতটা অসহায় তা প্রমাণ করেছিল রক্তাক্ত তেলেঙ্গানা । 

সমাজের সকল স্তরে ঐক্য প্রতিষ্ঠা : 

তেলেঙ্গানা বিপ্লবের সবথেকে উল্লেখযােগ্য বৈশিষ্ট্য ছিল , এতে সমাজের সব স্তরের কৃষকদের ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল । 

কৃষক শ্রেণীর মুক্তি : 

তেলেঙ্গানার বিদ্রোহ স্বাধীন কৃষক বিদ্রোহ রূপে কৃষক শ্রেণীর মুক্তির সূচনা করেছিল । 

নিজাম শাসনের অবসান : 

১৯৪৬-৪৭ খ্রিস্টাব্দে নিজাম স্বাধীন হায়দ্রাবাদ রাজ্য গঠনের উদ্যোগ নিলে তেলেঙ্গানাবাসীর প্রতিরােধে প্রায় আড়াই হাজার গ্রামে নিজাম শাসনের অবসান ঘটে । অধ্যাপক সুনীল সেন  লিখেছেন— “ তেলেঙ্গানা আন্দোলনের বিজয় স্বীকার্য । নিজামের শাসনের অবসান হল । পুরােনাে স্বৈরতন্ত্র ধ্বংস হল । হায়দ্রাবাদ ভারত ইউনিয়নে যােগ দিল ” । 

তেলেঙ্গানা কৃষক আন্দোলনের ফলাফল

কৃষক স্বার্থ রক্ষার আইন : 

অন্ধ্র প্রাদেশিক সরকারের উদ্যোগে কৃষক সমস্যা সমাধানের জন্য দুটি আইন প্রণীত হয় যথা — 

( i ) জায়গিরদারি উচ্ছেদ আইন , 

( ii ) হায়দ্রাবাদ প্রজাস্বত্ব আইন । 

ভাষাভিত্তিক রাজ্য গঠন : 

তেলেঙ্গানা আন্দোলনের সুফল হিসেবে পরবর্তীকালে ভাষাভিত্তিক রাজ্য গঠনের পথ প্রশস্ত হয় । গঠিত হয় স্বতন্ত্র অন্ধ্র রাজ্য ( ১৯৫২ খ্রি. ) । 

মূল্যায়ন 

রক্তাক্ত ‘ তেলেঙ্গানা বিপ্লব ’ আজ পর্যন্ত ভারতের কৃষক ইতিহাসে বিশেষত বৈপ্লবিক গণসংগ্রামের ইতিহাসে এক স্মরণীয় নাম । এখান থেকেই ভারতের গণতান্ত্রিক বিপ্লবের পথচলা শুরু । তাই রক্তাক্ত তেলেঙ্গানা সংগ্রাম ভারতের জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাসে চিরস্মরণীয় ধ্রুবতারার মতাে , যা ম্লান হবে না কোনােদিন । সুপ্রকাশ রায়ের  মতে— “ তেলেঙ্গানার এই সংগ্রামই ভারতের জনগণতন্ত্র স্থাপনের প্রথম প্রয়াস । ”

One thought on “তেলেঙ্গানা কৃষক বিদ্রোহ বা তেলেঙ্গানা কৃষক আন্দোলন

  • সুশ্যামল কান্তি

    দিনে কত ঘন্টা করে বেগার শ্রম করতে বা দিতে হতো তা লেখা হয়নি। ওটুকু দরকার ছিল।

    আর এই তথ্যসমৃদ্ধ রচনার জন্য ধন্যবাদ।

    Reply

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!