ইতিহাস

টীকা লেখ : তেভাগা আন্দোলন

Contents

টীকা লেখ : তেভাগা আন্দোলন

কৃষক আন্দোলনের ইতিহাসে তেভাগা আন্দোলন এক স্মরণীয় অধ্যায় । ফ্লাউড কমিশনের সুপারিশ মেনে উত্তর-পশ্চিম দিনাজপুরের ঠাকুরগাঁও মহকুমার অন্তর্গত আটওয়ারি থানার রামচন্দ্রপুর গ্রামের কৃষকরা উৎপাদিত ফসলের তিন ভাগের দুভাগ নিজেদের অধিকারে রাখার দাবিতে যে আন্দোলন গড়ে তােলে তা তেভাগা আন্দোলন নামে পরিচিত । বিশিষ্ট মার্কসবাদী নেতা মহম্মদ আবদুল্লাহ রসুল – এর মতে বাংলা দেশের কৃষক সভার ইতিহাসে এটাই ছিল তখন পর্যন্ত সবচেয়ে ব্যাপক ও শক্তিশালী আন্দোলন ।

তেভাগা আন্দোলনের কারণ / পটভূমি

ভাগচাষীদের করুণ অবস্থা :

ভাগচাষীরা ছিল মূলত জোতদার বা ধনী ভূস্বামীদের কাছ থেকে ভাড়া নেওয়া জমিতে কর্মরত কৃষক । ফলে কৃষক পরিবারগুলি বেঁচে থাকার জন্য বাধ্য হত জোতদার – জমিদারদের কাছ থেকে ধান কর্জ ( ধার ) নিতে । ফসল তােলার সময় কৃষকদের সুদসহ ওই কর্জ শােধ দিতে হত । ফলে তাদের অবস্থা অত্যন্ত শােচনীয় হয়ে পড়ত , যা থেকে তারা মুক্তি চেয়েছিল । 

জমিদার ও জোতদার দের অত্যাচার :

জমিদাররা বিভিন্ন পূজা পার্বণ ও উৎসব উপলক্ষ্যে বছরের বিভিন্ন সময়ে কৃষক পরিবারের ওপর করের বােঝা চাপাত । জমিদার যে-কোনাে সময়ে ইচ্ছা করলে জমি থেকে কৃষককে উচ্ছেদ করতে পারত । 

বিভিন্ন কৃষক সভার ভূমিকা : 

১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ‘ সারা ভারত কৃষক সভা ’ । তারা দাবি তুলেছিল লাঙল যার জমি তার । ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দের ভারত শাসন আইন অনুযায়ী দুবছর পরে যে নির্বাচন হয় তাতে বাংলায় ফজলুল হকের নেতৃত্বে গঠিত হয় কৃষক প্রজা পার্টির সরকার । এই সরকারের প্রচেষ্টায় বঙ্গীয় প্রজাস্বত্ব আইন সংশােধিত হয় । ঋণের ওপর সুদের ঊর্ধ্বহার বেঁধে দেওয়া হয় , ফলে কৃষকরা উৎসাহী হয়ে ওঠে । 

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও মুদ্রাস্ফীতি : 

১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূচনা ঘটে । ফলে ভারতেও তার ভয়ংকর প্রভাব পড়ে । মুদ্রাস্ফীতি ঘটে , দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পায় , নিত্য প্রয়ােজনীয় জিনিসপত্রের আকাল দেখা দেয় । মানুষের জীবনধারণ অসম্ভব হয়ে ওঠে । 

১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দের দুর্ভিক্ষ : 

১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দের ভয়ংকর দুর্ভিক্ষে ৩০ লক্ষ মানুষ মারা যায় ও ১ কোটি মানুষ নিঃস্ব হয় । মাঝারি , ছােটো ও প্রান্তিক কৃষকরা তাদের জায়গা – জমি বিক্রি করতে বাধ্য হয় । ভাগচাষীরা ভূমিহীন মজুরে রূপান্তরিত হয় । এইসব কারণে তারা বিদ্রোহের রাস্তায় যেতে বাধ্য হয় । 

তেভাগা আন্দোলনের সূচনা

১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দের অক্টোবরে তেভাগা আন্দোলনের সূচনা ঘটে । ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দে খুলনা জেলার মৌভােগে কৃষক সভার যে সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় , তাতে কৃষ্ণবিনােদ রায়ের সভাপতিত্বে যেসব প্রস্তাব নেওয়া হয় , তাতেই প্রথম তেভাগা আন্দোলনের পরিকল্পনা গৃহীত হয় । কাকদ্বীপের ( ২৪ পরগনা ) বুধাখালি থেকে এই আন্দোলনের সূচনা করেন গজেন মালি নামক এক কৃষক নেতা । 

তেভাগা আন্দোলনের আন্দোলনকারীদের দাবি

আন্দোলনকারীরা সমগ্র উত্তরবঙ্গে তাদের সংগ্রামী বাণী পৌঁছে দিয়েছিল । তেভাগার সংগ্রামের প্রধান দাবিগুলি ছিল — 

1. উৎপন্ন ধানের তিনভাগের দুইভাগে নিজ অধিকার স্থাপন । 

2. ধার করা ধানের ওপর সুদ প্রথার অবলুপ্তি । 

3. রশিদ ছাড়া কোনাে ধান দেওয়া হবে না বলে স্থির করা । 

4. আবাদ যােগ্য পতিত জমিতে আবাদের ব্যবস্থা করা ।  

তেভাগা আন্দোলনের বিস্তার

দিনাজপুরে : দিনাজপুর জেলার ঠাকুরগাঁও মহকুমার আটোয়ারী থানার রামচন্দ্রপুর গ্রামে তেভাগা আন্দোলনের ধানকাটার সূচনা হয় । ধীরে ধীরে তা ছড়িয়ে পড়ে দিনাজপুর জেলার ২২ টি থানায় । 

জলপাইগুড়িতে : জলপাইগুড়ি জেলার বােদা , পচাগড় , দেবিগন্থ , সুন্দর দিঘি প্রভৃতি অঞ্চলে তেভাগা আন্দোলন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে ।  

ময়মনসিংহে : এই জেলার কিশােরগঞ্জ মহকুমার করিমগঞ্জ , নীলগঞ্জ প্রভৃতি মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলগুলিতে এই আন্দোলন চরমে পৌঁছােয় । 

মেদিনীপুরে : মেদিনীপুর জেলার তমলুক , কেশপুর , দাসপুর , চন্দ্রকোনা , পাঁশকুড়া , নন্দীগ্রাম , মহিষাদলে তেভাগা কৃষি সংগ্রাম বিস্তারলাভ করে । 

তেভাগা আন্দোলনের নেতৃত্ব

প্রাক্ স্বাধীনতাকালে বাংলার এই অসাধারণ কৃষক বিদ্রোহের লাগামটি ধরা ছিল কমিউনিস্ট পার্টির হাতে । তেভাগা আন্দোলনের নেতাদের মধ্যে ㅡ

1. দিনাজপুরের অগ্রণী নেতৃবৃন্দ ছিলেন সুনীল সেন , চারুমণি মজুমদার , সুদীপা সেন প্রমুখ । 

2. জলপাইগুড়িতে বুড়ি মা নামে এক রাজবংশী বৃদ্ধ বিধবা , চারু মজুমদার , সমর গাঙ্গুলী , মণি সিং প্রমুখ । 

3. ময়মনসিংহে নেতৃত্ব দিতে এগিয়ে আসেন সুরেন্দ্রনাথ , রাসমনি প্রমুখ । 

4. মেদিনীপুরে তেভাগার নেতৃত্বের মধ্যে অন্যতম ছিলেন বিমলা মণ্ডল । 

তেভাগা আন্দোলনে সরকারের দমন নীতি

ময়মনসিংহ জেলার ম্যাজিস্ট্রেট কুখ্যাত ব্যাস্টিন সাহেব আন্দোলনকে রক্ত- বন্যায় ডুবিয়ে দেওয়ার জন্য নিরীহ ও নিরস্ত্র কৃষকদের ওপর সশস্ত্র পুলিশ ও মিলিটারি লেলিয়ে দেন । উন্মত্ত পুলিশ ও মিলিটারিদের হাতে প্রচুর আদিবাসী কৃষক নিহত ও আহত হয় । ঘরবাড়ি ভেঙে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া হয় । সমস্ত জেলাগুলিকে বন্দিশিবিরে পরিণত করা হয় । বিখ্যাত কমিউনিস্ট নেতা সােমনাথ লাহিড়ি পুলিশি অত্যাচার সম্পর্কে গান্ধী , নেহরু , জিন্না ও প্যাটেলের কাছে এক তারবার্তা পাঠান এবং তাঁদের সাহায্য প্রত্যাশা করেন । 

তেভাগা আন্দোলনের ফলাফল

আইন পাস : 

তেভাগা আন্দোলনের তীব্রতায় সরকার বাধ্য হয়ে বঙ্গীয় বর্গাদার সামরিক নিয়ন্ত্রণ বিল আইনসভায় পাস করানাের সিদ্ধান্ত নেয় । 

ভাগচাষীদের উচ্ছেদ রােধ : 

নতুন এই বিল পাসের দ্বারা জমি থেকে ভাগচাষিদের উচ্ছেদ বন্ধ করা হয় । 

ফসলে অধিকার লাভ : 

নতুন বিলে উৎপাদিত ফসলের ওপর চাষিদের দুই-তৃতীয়াংশ অধিকার লাভকে স্বীকৃতি জানানাে হয় । 

মূল্যায়ন 

বিভিন্ন ত্রুটি বিচ্যুতি সত্ত্বেও কৃষক আন্দোলনের ইতিহাসে তেভাগা এক অবিস্মরণীয় কৃষক আন্দোলনের নাম । আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামে আত্মবলিদানকারী শতসহস্র শহিদের নামের সঙ্গে চির অম্লান জ্যোতিতে ভাস্বর থাকবে তেভাগার কৃষক পরিবারের শহিদেরা । আশু দত্তের  প্রবন্ধে লেখা হয়েছে , “ সেদিন বাংলার দিকে দিকে তেভাগার দাবিতে এবং ‘ টংক প্রথা ’ ( ধানে খাজনা দেওয়া ) উচ্ছেদের জন্য কৃষক অভ্যুত্থানের সেই অবিস্মরণীয় আগুনঝরা দিনগুলাের কথা বাংলার মেহনতি , সংগ্রামী মানুষ কোনােদিন ভুলবে না । ”

2 thoughts on “টীকা লেখ : তেভাগা আন্দোলন

  • তাইজুল হক্

    সুন্দর ভাবে আলোচিত হয়েছে।

    Reply
  • Piyush dey

    This is very easy to learn hahahaha hehehee huu

    Reply

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!