মন্টেগু চেমসফোর্ড সংস্কার আইন
Contents
মন্টেগু চেমসফোর্ড সংস্কার আইন
মর্লে মিন্টো শাসন সংস্কার ( ১৯০৯ খ্রি. ) ব্যর্থ হলে ব্রিটিশ আর একটি শাসন সংস্কার আইন প্রবর্তনের প্রয়ােজনীয়তা অনুভব করে । এই প্রয়ােজনের তাগিদেই ভারত সচিব এডুইন স্ট্যানলি মন্টেগু ও ভাইসরয় লর্ড চেমসফোর্ড মিলিতভাবে এক আইন পাস করান , যা মন্টেগু চেমসফোর্ড সংস্কার আইন ( ১৯১৯ খ্রি. ) নামে পরিচিত । অধ্যাপক জি. এন. সিং – এর মতে — মন্ট-ফোর্ড আইনে প্রাদেশিক শাসন ব্যবস্থার শর্ত গুলি ছিল স্বায়ত্তশাসন ব্যবস্থার প্রথম ধাপ ( ‘ They constituted the first step on the road to self – government ‘ ) ।
মন্টেগু চেমসফোর্ড সংস্কার আইনের পটভূমি / কারণ
মর্লে-মিন্টো শাসন সংস্কারের ব্যর্থতা :
মর্লে-মিন্টো শাসন সংস্কার ( ১৯০৯ খ্রি. ) ভারতবাসীর আশা পূরণ বা নরমপন্থী , চরমপন্থী কারােরই মন জয় করতে পারেনি । আসলে এই আইন প্রবর্তনের নেপথ্যে ছিল ব্রিটিশ শাসনের প্রতি মুসলিমদের সমর্থন আদায়ের দুরভিসন্ধি ।
স্বায়ত্তশাসন বিষয়ক বিক্ষোভ প্রশমন :
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ অবসানের পর ব্রিটিশ সরকার তার পূর্ব কথা মতাে ভারতবাসীকে স্বায়ত্তশাসনের অধিকার ফিরিয়ে দেয়নি । এর ফলে ভারতবাসীর মনে যে তীব্র ক্ষোভ জন্মেছিল তা প্রশমনের প্রয়ােজন ছিল ।
নরমপন্থী ও চরমপন্থীদের বিবাদের অবসান :
১৯০৭ খ্রিস্টাব্দে কংগ্রেসের সুরাট বিচ্ছেদের পর চরমপন্থীরা জাতীয় কংগ্রেস থেকে দূরেই ছিলেন । নির্বাসন – প্রত্যাগত তিলক অনুধাবন করেন যে , চরমপন্থী ও নরমপন্থীদের মিলন ব্যতীত জাতীয় অগ্রগতি অসম্ভব । তাই ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দের কংগ্রেসের লক্ষ্ণৌ অধিবেশনে চরমপন্থীরা যােগদান করলে জাতীয় কংগ্রেস আবার প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে ।
কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের ঐক্য :
বঙ্গভঙ্গ রদ , তুরস্কের ওপর ইতালির আক্রমণ , বলকান যুদ্ধ এবং প্রথম বিশ্বযুদ্ধে তুরস্কের বিরুদ্ধে ব্রিটিশ সরকারের যুদ্ধযাত্রা ভারতীয় মুসলিমদের ক্ষুব্ধ করে তােলে । এ সময় মুসলিম লীগের নেতৃত্বে পরিবর্তন আসে । তরুণ নেতৃত্ব আলিগড়ের সংকীর্ণ রাজনীতি বিসর্জন দিয়ে জাতীয় কংগ্রেসের সঙ্গে সহযােগিতার নীতি গ্রহণ করে । ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দে জাতীয় কংগ্রেসের লক্ষ্ণৌ অধিবেশনে যােগ দিয়ে লিগ নেতৃত্ব জাতীয় কংগ্রেসের ‘ স্বরাজ ’ এর আদর্শ মেনে নেয় এবং যৌথভাবে জাতীয় আন্দোলন পরিচালনায় সম্মত হয় ।
হোমরুল আন্দোলনের তীব্রতা :
লক্ষ্ণৌ চুক্তি ( ১৯১৬ খ্রি. ) স্বাক্ষরিত হওয়ার পর তিলক ও বেসান্তের নেতৃত্বে আলাদা আলাদা হােমরুল আন্দোলন তীব্রতর হয়ে ওঠে । এই আন্দোলনের তীব্রতায় ব্রিটিশের মনােভাবে পরিবর্তন ঘটে । ভাইসরয় চেমসফোর্ড ভারত সচিবকে টেলিগ্রাম করে জানান — হােমরুল আন্দোলন ভারতবাসীর ওপর গভীর প্রভাব ফেলেছে ।
আন্তর্জাতিক ঘটনাবলির প্রভাব :
রাশিয়ায় ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দের নভেম্বর বিপ্লবে শ্রমিক শ্রেণীর সাফল্য ভারতবাসীকে যেভাবে জাতীয়তাবােধে উদ্বুদ্ধ করে তুলেছিল তাতে ব্রিটিশ সরকার ভয় পেয়ে গিয়েছিল । এ ছাড়া আমেরিকাসহ পাশ্চাত্যের বিভিন্ন দেশ তাদের উপনিবেশগুলিতে স্বাধীনতার অধিকার প্রত্যর্পণের নিশ্চয়তা দিলে ভারতেও ব্রিটিশ বাধ্য হয় একই প্রতিশ্রুতি দিতে ।
মন্টেগু চেমসফোর্ড সংস্কার আইনের গুরুত্ব
ভারতের রাজনীতিতে মন্টেগু চেমসফোর্ড সংস্কার আইনের গুরুত্ব ছিল অসীম ।
শাসন ব্যবস্থার বিভাজন :
এই আইনের দ্বারাই ভারতীয় শাসন ব্যবস্থাকে কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক দু ভাগে ভাগ করা হয় । কেন্দ্রীয় অধীনে যায় সামরিক , পররাষ্ট্র , পরিবহন ( রেল ) , প্রচার ( ডাক ও তার ) ও মুদ্রা ইত্যাদি বিভাগ । আর প্রাদেশিক বিভাগে যায় পুলিশ , বিচার , শিক্ষা , স্বাস্থ্য , সেচ , রাজস্ব , আবগারিসহ বিভিন্ন বিষয় ।
আইনসভার বিভাজনে :
কেন্দ্রীয় আইনসভা গড়ে তােলা হয় দুটি কক্ষ নিয়ে — নিম্নকক্ষ এবং উচ্চকক্ষ ।
দ্বৈত শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তন :
প্রদেশগুলিতে দ্বৈত শাসন ব্যবস্থা চালু হয় ।
মূল্যায়ন
মন্টেগু চেমফোর্ড সংস্কার আইনের দ্বারা এই প্রথম ক্ষমতা হস্তান্তরের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয় । যদিও বাস্তবে ভারতীয়দের হাতে খুব সামান্যই ক্ষমতা দেওয়া হয়েছিল , তাই জাতীয় কংগ্রেস এই আইনকে অপর্যাপ্ত , অসন্তোষজনক এবং নৈরাশ্যজনক আখ্যা দেয় । কুপল্যান্ড ( Coopland ) – এর মতে— এখন থেকে ভারতীয়রা নিজের মতাে করে কথা বলবে এবং শাসনকার্য পরিচালনা করবে ( ‘ Now Indians were to govern , so to speak , on their own …..’ )।