ইতিহাস

অসহযোগ আন্দোলনের গুরুত্ব

Contents

অসহযোগ আন্দোলনের গুরুত্ব

index 9
অসহযোগ আন্দোলন

অসহযােগ আন্দোলনের সুদূর প্রসারী ফলাফল নিয়ে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই । জওহরলাল  রচিত , ‘ বিশ্ব ইতিহাস ‘ গ্রন্থে লেখা রয়েছে — অসহযােগের মন্ত্র দেশে ছড়িয়ে পড়ল আর এর স্পর্শ লাগামাত্র এতদিন যে হীন দুর্বলতা আমাদেরকে আবদ্ধ করে রেখেছিল সেটা অন্তর্হিত হতে লাগল । সুভাষচন্দ্র  তাঁর ‘ The Indian Struggle ’ গ্রন্থে লেখেন — গান্ধীজি কংগ্রেসকে একটি বৈপ্লবিক প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন ।

প্রথম সর্বব্যাপী এবং সুসংবদ্ধ গণ আন্দোলন

অসহযােগ আন্দোলন ছিল ভারতবর্ষের ইতিহাসে সর্বপ্রথম এক সর্বব্যাপী এবং সুসংবদ্ধ গণ আন্দোলন । সমাজের সকল স্তরের মানুষ এই আন্দোলনে যােগ দেওয়ায় এটি প্রকৃত অর্থেই এক গণ আন্দোলনের চেহারা নেয় । জওহরলাল  তাই বলেছেন — অসহযােগ আন্দোলন ছিল একটি গণ আন্দোলন ( ‘ …non co-operation was a mass movement ‘ ) ।

আন্দোলনের বিপ্লব মুখিনতা

দীর্ঘদিন ধরে চলতে থাকা ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন এই প্রথম নিয়মতান্ত্রিক পথ থেকে সরে এসে বিপ্লবমুখী হয়ে উঠল । প্রখ্যাত সাংবিধানিক ভাষ্যকার কুপল্যান্ড  বলেন — তিলক যা করতে পারেননি , গান্ধিজি তা করতে পেরেছেন । গান্ধীজি জাতীয় সংগ্রামকে বিপ্লবমুখী করে তুলতে সক্ষম হয়েছেন । 

জাতীয় চেতনার উন্মেষ

অসহযােগ আন্দোলন ভারতবাসীর জাতীয় চেতনার উন্মেষ ঘটাতে পেরেছিল । এ প্রসঙ্গে সে – সময়কার মাদ্রাজের গভর্নর উইলিংডন সরকারের স্বরাষ্ট্রসচিবকে লিখেছিলেন — অসহযােগ আন্দোলনের ফলাফল যাই হােক না কেন , তা সাধারণ মানুষের মনে জাতীয় চেতনার বিস্তার করেছে এবং তাদের মানসিক শান্তি বিঘ্নিত করেছে ।

কংগ্রেসের মর্যাদা ও প্রভাব বৃদ্ধি

অসহযােগ আন্দোলন সফল হােক বা না হােক , তা জাতীয় কংগ্রেসের প্রভাব ও মর্যাদাকে বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছিল । এই আন্দোলনের পর থেকেই সুদূর গ্রামাঞ্চলগুলিতেও জাতীয় কংগ্রেসের শাখাপ্রশাখা গড়ে উঠতে শুরু করে । রমেশচন্দ্র মজুমদারের  মতে — এই আন্দোলনের ফলে রাতারাতি কংগ্রেস একটি আলােচনা সভা থেকে বিপ্লবী সংগঠনে পরিণত হয় ।

জাতির নেতা হিসেবে গান্ধীজীর উত্থান

এই আন্দোলনে সফলভাবে নেতৃত্ব দিয়ে গান্ধীজি জাতির নেতা হয়ে ওঠেন । ভারতবাসী তার নেতৃত্ব মেনে নেয় । রবীন্দ্রনাথ গান্ধীজির প্রতি তাঁর অন্তরের শ্রদ্ধা জানিয়ে বলেন — “ তুমি সর্বাশয় , এ কি শূন্য কথা । ”

অন্যান্য আন্দোলনের প্রেরণাদাতা 

অসহযােগ আন্দোলন থেকে পরবর্তী সময়ে বহু ছােটো আকারের আন্দোলন গড়ে ওঠে । যেমন — অকালি আন্দোলন , সুরাটে বারদৌলি তালুকের কৃষকরা কর বন্ধের জন্য যে আন্দোলন করেন সেগুলি অসহযােগ আন্দোলন থেকেই প্রেরণা পেয়ে গড়ে উঠেছিল ।

ভারতবাসীর বোধোদয়

এই আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে কোটি কোটি সাধারণ , অশিক্ষিত গ্রামবাসী বুঝতে পারে ব্রিটিশ শাসনে তাদের প্রকৃত অবস্থা । ড. রমেশচন্দ্র মজুমদারের  মতে — এই আন্দোলন ছিল জনগণের কাছে এক অগ্নিপরীক্ষা ( ‘ The movement served as a baptism of fire ‘ ) ।

অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা 

অর্থনৈতিক প্রভাবের দিক থেকে আন্দোলনের সুফলরূপে খাদি বস্ত্রশিল্প ও অন্যান্য দেশীয় শিল্পের প্রসার ঘটায় দেশের অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা ফিরে আসে । সরকারি তরফেও শুল্কের আদায় বহু পরিমাণে কমে যায় ।

স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা বৃদ্ধি 

এই আন্দোলনের ফলে ভারতবাসীর মনে স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা বহুগুণ বৃদ্ধি পায় । এরপর থেকে গড়ে ওঠা আন্দোলনগুলি প্রকৃত অর্থেই স্বাধীনতা আন্দোলন হয়ে ওঠে । বিদ্রোহী কবি নজরুল তাঁর কবিতায় লেখেন — “ এই শিকল পরে শিকল তােদের করব রে বিকল । ”

সামাজিক উন্নতি 

সামাজিক গুরুত্বের বিচারেও এই আন্দোলন সফল , কেননা এই আন্দোলনে সমাজের সর্বস্তরের মানুষ যােগদান করায় জাতপাতের সামাজিক ভেদরেখা মুছে গিয়ে অনগ্রসর শ্রেণি সমাজের মূল স্রোতে ফিরে আসে । এ. আর. দেশাই  বলেছেন — অসহযােগ আন্দোলনের ফলেই জাতীয় আন্দোলনে শ্রমিক , কৃষক ব্যাপকভাবে যােগ দেয় ।

উপসংহার 

কোনােরকম ফলাফল লাভের আগেই গান্ধীজি এই আন্দোলন প্রত্যাহার করে নেন । তাই সফল না ব্যর্থ এই নিরিখে অসহযােগ আন্দোলনের মূল্যায়ন করা চলে না । রমেশচন্দ্র মজুমদার  তাঁর ‘ Struggle for Freedom ’ গ্রন্থে বলেছেন — সম্ভবত এটি সম্পূর্ণ সফল বা সম্পূর্ণ ব্যর্থ ছিল না , আসল সত্যটি এই দুয়ের মাঝে রয়েছে ( ‘ Perhaps the correct view would be that it was neither a complete successor nor a complete failure and the truth … lies between the two ‘ ) । অধ্যাপক পার্সিভ্যাল স্পিয়ার  তাই বলেছেন — এই আন্দোলনকে ছােটো করে দেখা ঠিক নয় ।

2 thoughts on “অসহযোগ আন্দোলনের গুরুত্ব

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!