সাইমন কমিশন কী

সাইমন কমিশন কী

ভারতবাসীর শাসনতান্ত্রিক ও সাংবিধানিক সংস্কারের দাবি পূরণের লক্ষ্যে গঠিত হয় , সাইমন কমিশন । রাওলাট আইন ও জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের পর তৃতীয়বারের জন্য ভারতবাসী ক্ষোভে ফেটে পড়ে সাইমন কমিশন গঠনকে কেন্দ্র করে । ব্রিটিশের বিভিন্ন নীতির সমর্থক ন্যাশনাল লিবারেল ফেডারেশন ও এক প্রস্তাব গ্রহণ করে সাইমন কমিশনকে সমালােচনা করে বলে — এই আইন ভারতীয় জনগণের প্রতি ইচ্ছাকৃত অপমান ( ‘ A deliberate insult to the people of India ‘ ) ।

index 8
জন সাইমন

দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জনের নেতৃত্বে স্বরাজ্য দল ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দের মন্ট-ফোর্ড শাসন সংস্কার আইন পুনর্বিবেচনার দাবি তােলে । তাই সাংবিধানিক সংস্কারের লক্ষ্যে খ্যাতনামা ব্রিটিশ আইনজীবী ও উদারপন্থী দলের জন সাইমন ( Liberal Party ) সাংসদ জন সাইমনের নেতৃত্বে ব্রিটিশ পার্লামেন্ট সাত সদস্য বিশিষ্ট ‘ ইন্ডিয়ান স্ট্যাটুটরি কমিশন ’ ( Indian Statutory Commission ) গঠন করে ( ১৯২৭ খ্রি. ) । জন সাইমনের নামানুসারে কমিশনটি সাইমন কমিশন নামে খ্যাত । এর অন্য দুজন সদস্যের মধ্যে দুজন ছিলেন শ্রমিক দলের ( Labour Party ) এবং বাকি চারজন ছিলেন রক্ষণশীল দলের ( Conservative Party ) অন্তর্ভুক্ত।

সাইমন কমিশন গঠনের কারণ 

মন্ট ফোর্ড প্রস্তাব :

মন্টেগু চেমসফোর্ড শাসন সংস্কারের ( ১৯১৯ খ্রি. ) একটি ধারায় প্রস্তাব রাখা হয়েছিল , মন্ট ফোর্ড শাসন সংস্কারের বিভিন্ন ধারাগুলি কতটা কার্যকরী হল , তা অনুসন্ধানের জন্য দশ বছর পর এক কমিশন গঠন করা হবে । সেই প্রস্তাব অনুসারে সাইমন কমিশন গঠিত হয় । 

মন্ট ফোর্ড এর ব্যর্থতা :

মন্টেগু  চেমসফোর্ড সংস্কার আইন প্রবর্তন করে ব্রিটিশ আশা করেছিল , সফলভাবে ভারতবাসীকে জাতীয় আন্দোলন থেকে সরিয়ে আনা যাবে বা ভারতীয়দের ক্ষোভকেও অনেকটা প্রশমিত করা যাবে । কিন্তু তা না হয়ে উলটে ব্রিটিশের বিরুদ্ধে ভারতীয়দের ক্ষোভ চরমে পৌঁছােয় । ফলে ব্রিটিশ সাইমন কমিশন গঠনের প্রয়ােজনীয়তা অনুভব করে । 

নির্বাচনে কংগ্রেসের সাফল্য :

১৯২৬ খ্রিস্টাব্দের নির্বাচনে জাতীয় কংগ্রেস বহু সমস্যা অতিক্রম করে বড়ো ধরনের সাফল্য পেয়েছিল , যা সে সময়কার বড়ােলাট লর্ড আরউইনকে ভীত করে তােলে । 

স্বরাজ্য দলের প্রস্তাব :

দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন ও মতিলাল নেহরুর নেতৃত্বে গড়ে ওঠা স্বরাজ্য দল ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাসে ব্রিটিশ সরকারের কাছে কেন্দ্রীয় আইনসভায় শাসন সংস্কার করার জন্য এক গােলটেবিল বৈঠক ডাকার প্রস্তাব রাখে । 

মুসলিম লীগের দাবি :

মুসলিম লীগ ১৯২৬ খ্রিস্টাব্দে শাসন সংস্কারের জন্য স্বরাজ্য দলের অনুরূপ একটি দাবিপত্র সরকারের কাছে পেশ করে । সাইমন কমিশন গঠনের পেছনে এই ঘটনাটিরও প্রভাব ছিল । 

ব্রিটেনের সাধারণ নির্বাচন : 

ভারত সচিব লর্ড বার্কেনহেড ছিলেন রক্ষণশীল দলের সদস্য । তিনি এটা স্পষ্ট বুঝতে পারেন যে , ১৯২৯ – এর ব্রিটেনে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে তার রক্ষণশীল দল ( Conservative Party ) – কে হারিয়ে শ্রমিক দল ( Labour Party ) জয়লাভ করবে ও শাসকরূপে ব্রিটেনে ক্ষমতায় আসবে । তাঁর পরামর্শে পরাজয় এড়াতে তড়িঘড়ি এই কমিশন গঠন করা হয় । 

সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ : 

হিন্দু – মুসলিম সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ চলাকালীন সাইমন কমিশন গঠন করতে চাওয়া হয়েছিল । কারণ তা হলে কমিশন তার প্রতিবেদনে এই দাঙ্গার চিত্র তুলে ধরতে পারবেন যা ব্রিটিশ সরকারের স্বার্থ রক্ষায় সহায়ক হবে । 

সাইমন কমিশন বিরোধী আন্দোলন

সাইমন কমিশন বর্জন এর শপথ :

ভারতবাসী দায়িত্বশীল সরকার গঠনের উপযুক্ত হয়েছে কি না তা তদারকির ভার দেওয়া হয় ব্রিটিশদের নিয়ে গঠিত এই কমিশনের উপর । ভারতবাসী নিজেদের ভালাে মন্দ নির্ধারণের অধিকার থেকে বঞ্চিত হওয়ায় ক্ষোভে ফেটে পড়ে । এই ক্ষোভ জাতীয় আন্দোলনকে পুনরায় গতিশীল করে তােলে । কংগ্রেস , মুসলিম লীগ এবং বামপন্থীসহ সমস্ত রাজনৈতিক দল সাইমন কমিশনকে সামাজিক ও রাজনৈতিক সর্বতােভাবে বর্জন করার শপথ গ্রহণ করে । সৃষ্টি হয় এক নতুন শ্লোগান – সাইমন ফিরে যাও ( Go back Simon ) । 

বোম্বাইতে আন্দোলন : 

১৯২৮ খ্রিস্টাব্দের ৩ ফেব্রুয়ারি জন সাইমন সদলবলে বােম্বাই বন্দরে এসে পৌঁছেলে জনতা বিক্ষোভে ফেটে পড়ে । ওইদিন সারা ভারতে হরতাল পালিত হয় । হাতে কালাে পতাকা ও ‘ Go back Simon ‘ লেখা প্রচারপত্রসহ সর্বত্র বিক্ষোভ মিছিল অনুষ্ঠিত হয় । অসংখ্য জনসভার মধ্যে বােম্বাইয়ের চৌপাটীর বালিয়াড়ির সমাবেশটি ছিল সবচেয়ে বড়াে । 

লালা লাজপত এর নেতৃত্বে লাহোরে আন্দোলন :

৩০ অক্টোবর লাহােরে সাইমন বিরােধী শােভাযাত্রার ওপর পুলিশ লাঠি চালায় । মিছিলের পুরােভাগে বৃদ্ধ জননেতা লাজপত রায় ছিলেন । তিনি পুলিশের লাঠির আঘাতে গুরুতরভাবে আহত হন এবং কয়েকদিন পরে ( ১৭ নভেম্বর ) তাঁর মৃত্যু হয় ।

যুক্ত প্রদেশে প্রহৃত নেতৃবৃন্দ :

যুক্তপ্রদেশে ( বর্তমান উত্তরপ্রদেশ ) মতিলাল নেহরুর পুত্র জওহরলাল ছাড়াও গােবিন্দ বল্লভ পন্থ প্রমুখ নেতা শােভাযাত্রা পরিচালনার সময় পুলিশের হাতে প্রহৃত হন । 

কলকাতায় অরন্ধন ও ধর্মঘট পালন : 

সাইমন কমিশন ভারতের যেখানেই গিয়েছে , সেখানেই প্রবল বিক্ষোভের সম্মুখীন হয়েছে । কলকাতায় যেদিন সাইমন সদলবলে উপস্থিত হন , সেদিন অরন্ধন ও ধর্মঘট পালিত হয় । সাইমন কমিশন বিরােধী বিক্ষোভের পুরােভাগে এগিয়ে এসে সেদিন দেশের ছাত্র ও যুবসমাজ এক বিশিষ্ট ভূমিকা গ্রহণ করেছিল । 

নেহরু কমিটির ওপর খসড়া শাসনতন্ত্র এর দায়িত্ব :

ভারতীয় নেতৃবৃন্দ সামাজিক , রাজনৈতিক , শাসনতান্ত্রিক দিক থেকে অপমানজনক এই কমিশনকে বয়কট করার সিদ্ধান্ত নেন । এরই পরিপ্রেক্ষিতে দিল্লিতে এক সর্বদলীয় সম্মেলনে প্রাক্তন স্বরাজ্যদলের নেতা মতিলাল নেহরুর নেতৃত্বে একটি কমিটির ওপর ভারতের নতুন শাসনতন্ত্র রচনার জন্য মূল নীতিগুলির খসড়া তৈরি করার দায়িত্ব দেওয়া হয় । স্থির হয় , দেশের ভবিষ্যৎ সংবিধান রচনা করবেন দেশের নেতৃবৃন্দই ; কোনাে বিদেশি কমিশন নয় । এইভাবে সাইমন কমিশনকে সমস্ত দিক থেকেই অবজ্ঞা ও বর্জন করা হয় । 

উপসংহার 

জাতীর অন্ধকারাচ্ছন্ন দিনে সাইমন কমিশন বিরােধী আন্দোলন এক আলাের দিশা দেখায় । কংগ্রেসসহ সকল রাজনৈতিক দল সাইমন কমিশন বিরােধী আন্দোলনে যােগ দিয়ে ভারতীয় জাতীয় আন্দোলনকে আরও গতিশীল করে তােলে । তবুও এটা ঠিক যে , ভারতীয়দের এই প্রবল বিরােধিতা সত্ত্বেও কমিশন কিন্তু তার কাজ চালিয়ে যায় । আর এই কমিশনের সুপারিশের ওপর ভিত্তি করেই ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দে ভারত শাসন আইনের অনেকটাই রচিত হয় ।

Leave a Reply

Your email address will not be published.

x
error: Content is protected !!