গান্ধীজি কেন অসহযোগ আন্দোলন প্রত্যাহার করেন
Contents
গান্ধীজি কেন অসহযোগ আন্দোলন প্রত্যাহার করেন
গান্ধীজি অনেক আশা নিয়ে তাঁর অহিংস সত্যাগ্রহ আর্দশের মাধ্যমে অসহযােগ আন্দোলনের সূচনা ঘটালেও শেষ পর্যন্ত এই আন্দোলন অহিংস থাকেনি । চৌরিচৌরা হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে এই আন্দোলনে হিংসার অনুপ্রবেশ ঘটলে গান্ধীজি আন্দোলন প্রত্যাহার করে নেন ।

চৌরিচৌরা ঘটনা
উত্তরপ্রদেশের গােরক্ষপুর জেলার চৌরিচেরা নামক গ্রামে মদ বিক্রয় ও দ্রব্য- মূল্য বৃদ্ধির প্রতিবাদে একদল স্বেচ্ছাসেবক ধরনা দিতে শুরু করে । পুলিশ স্বেচ্ছাসেবীদের নেতা ভগবান আহীরকে শাস্তি দেয় । এতে ক্ষুদ্ধ হয়ে প্রায় তিন হাজার কৃষকের এক মিছিল থানা ঘেরাও করে । এই সমাবেশে পুলিশ গুলি চালালে উত্তেজিত ও ক্ষিপ্ত জনতা চৌরিচৌরা গ্রামের ( চৌরিচৌরা কোনাে একটি স্থানের নাম নয় , দুটি গ্রামের নাম ) থানাতে আগুন লাগিয়ে দেয় , এতে বাইশ জন পুলিশ পুড়ে মারা যায় ( ১৯২২ খ্রি. ৫ ফেব্রুয়ারি ) । এই ঘটনায় গান্ধীজি অত্যন্ত মর্মাহত হন এবং বারদৌলিতে অনুষ্ঠিত কংগ্রেস অধিবেশনে আন্দোলন বন্ধ করে দেওয়ার প্রস্তাব তােলেন ( ১৯২২ খ্রি. ১২ ফেব্রুয়ারি ) । গান্ধীজির এই প্রস্তাব মেনে নিখিল ভারত কংগ্রেস কমিটি অসহযােগ আন্দোলন প্রত্যাহার করে নেয় ( ২৫ ফেব্রুয়ারি ) ।
অসহযোগ আন্দোলন প্রত্যাহার এর বিভিন্ন প্রতিক্রিয়া
গান্ধীজির অসহযােগ আন্দোলন বন্ধের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে সারা দেশ জুড়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়—
চিত্তরঞ্জন দাশের :
জেলের মধ্যে বন্দি অবস্থায় দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ তার প্রতিক্রিয়ায় জানান— “ সারা জীবনের মতাে সুযােগ হাতছাড়া হয়ে গেল । ”
লাজপত রায়ের :
লালা লাজপত রায় বলেন — আমরা একেবারে ছত্রভঙ্গ হয়ে গেলাম ।
মতিলাল নেহরুর :
মতিলাল নেহরু জানান — একটি স্থানের জনতার পাপের জন্য গান্ধীজি সমগ্র দেশবাসীকে শাস্তি দিলেন ।
সুভাষচন্দ্রের :
সুভাষচন্দ্র তীব্র প্রতিক্রিয়ায় এই সিদ্ধান্তকে জাতীয় বিপর্যয়ের আখ্যা দিয়ে বলেন — জনগণের উৎসাহ যখন চরম সীমায় পৌঁছেছে , ঠিক তখনই পশ্চাদপসরণের সিদ্ধান্ত জাতীয় বিপর্যয় থেকে কম কিছু নয় ( ‘ To sound the order of retreat just when public enthusiasm was reaching the boiling point was nothing short of a national calamity ‘ ) ।
রােমা রােল্যাঁর :
নােবেলজয়ী ভারততত্ত্ববিদ রােমা রােল্যাঁর মতে , একজন ব্যক্তির হাতে দেশের সকল ক্ষমতা তুলে দেওয়ার মধ্যে বিপদ আছে এবং যে সময় আন্দোলন চরমসীমায় উপনীত তখন আন্দোলন প্রত্যাহারের নির্দেশ বিপজ্জনক ছিল ।
গান্ধীজীর অসহযোগ আন্দোলন প্রত্যাহারের কারণ
গান্ধীজি মনে করতেন তিনি আন্দোলন প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে কোনাে ভুল করেননি । এ প্রসঙ্গে তিনি লেখেন — তখন যদি একে স্থগিত না রাখা হত , তাহলে অহিংস আন্দোলন পরিচালনার পরিবর্তে আমরা মূলত হিংসাত্মক আন্দোলনেরই দায়িত্ব নিয়ে ফেলতাম । গান্ধীজির আন্দোলন প্রত্যাহারের সিদ্ধান্তের পক্ষে কয়েকটি যুক্তি ছিল —
হিংসার অনুপ্রবেশ :
চৌরিচৌরার ঘটনার পর গান্ধীজি স্পষ্টই বুঝতে পারেন যে — অহিংস আন্দোলন ক্রমশ হিংসাত্মক রূপ ধারণ করছে । ইতিপূর্বে বােম্বাই ( ১৯২১ খ্রি. ১৭ নভেম্বর ) ও মাদ্রাজে ( ১৯২২ খ্রি. ১৩ জানুয়ারি ) সামান্য হিংসাত্মক ঘটনা ঘটলেও চৌরিচৌরার পর তিনি আর স্থির থাকতে পারেননি । তিনি লেখেন — মাদ্রাজ আমাকে সতর্ক করে দেয় , কিন্তু আমি গুরুত্ব দিইনি । চৌরিচৌরা ঘটনার মাধ্যমে ঈশ্বর আমার কাছে স্পষ্ট নির্দেশ দেন ।
ব্রিটিশ সশস্ত্র আক্রমণের আশঙ্কা :
এই অহিংস আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীরা ছিল সম্পূর্ণরূপে নিরস্ত্র । গান্ধীজি আশঙ্কা করেন এদের ওপর সশস্ত্র ব্রিটিশের আক্রমণ ঘটলে আন্দোলন রক্তাক্ত হয়ে উঠবে ।
কৃষক শ্রেণীর জমি বাজেয়াপ্তের আশঙ্কা :
আন্দোলনে কৃষকশ্রেণি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল । ব্রিটিশ যদি কৃষক সম্প্রদায়ের জমিজমা বাজেয়াপ্ত করে নেয় , তাহলে ভবিষ্যতে গণ আন্দোলন থেকে কৃষকরা মুখ ফিরিয়ে নেবে , এই আশঙ্কাও গান্ধীজির মনে জেগেছিল ।
পড়াশোনার ধারাবাহিকতায় ব্যাঘাত :
আন্দোলন চলাকালীন ছাত্র ছাত্রীরা স্কুল কলেজ বয়কট করায় দীর্ঘদিন স্কুল কলেজ বন্ধ থাকে । পড়াশােনার ধারাবাহিকতা দারুণভাবে ব্যাহত হয় । শিক্ষা ব্যবস্থা সম্পূর্ণরূপে বেহাল হয়ে পড়ে । অভিভাবকবৃন্দ ক্ষুদ্ধ হন । এই আন্দোলনের প্রতি শিক্ষিত সমাজ বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়ার আগে তাই গান্ধীজি আন্দোলন প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নেন । এ প্রসঙ্গে তিনি জওহরলাল নেহরুকে লেখেন — ‘ The unconciously drifted from the right path ’ ।
ব্রিটিশ দমননীতির তীব্রতা :
আন্দোলন ক্রমশ দীর্ঘমেয়াদি হয়ে উঠলেও সরকারি তরফে কোনােরকম আপস মীমাংসার আভাস মেলেনি , উলটে আন্দোলনকারীদের ওপর ব্রিটিশের দমননীতি ক্রমশ তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছিল । এমতাবস্থায় আত্মসমর্পণ করা বা পিছু হটা সম্ভব ছিল না । চৌরিচৌরা ঘটনা আন্দোলন প্রত্যাহারের সুযােগ এনে দেয় । তাই সুনীতিকুমার ঘােষ ‘ India and the Raj ‘ গ্রন্থে লিখেছেন বহুদিন ধরেই গান্ধীজি ব্রিটিশ সরকারের সঙ্গে সমঝােতার রাস্তা খুঁজছিলেন । ‘ চৌরিচৌরা ঘটনা ’ তাঁর সামনে আন্দোলন প্রত্যাহারের সুযােগ এনে দেয় ।
জীবিকা সমস্যা :
মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়ভুক্ত বিভিন্ন পেশার মানুষ দীর্ঘদিন ধরে এই আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত থাকায় অনেকেই জীবিকা হারায় বা পেশাগত ক্ষেত্রে সমস্যার সৃষ্টি হয় । তাই আন্দোলন প্রত্যাহারের সিদ্ধান্তের পশ্চাতে এদের জন্য ভাবনাও কাজ করেছিল । এ প্রসঙ্গে সমালােচনার সুরে রজনী পামদত্ত তাঁর ‘ India Today ‘ গ্রন্থে লিখেছেন — হিংসা বা অহিংসার প্রশ্ন নয় , বিত্তশালী মানুষের শ্রেণিস্বার্থের প্রশ্নই ১৯২২ – এর জাতীয় সংগ্রামকে শেষ করে দিয়েছিল ( ‘ Not , the questions of ‘ violence ‘ or ‘ Non – violence ’ , but the question of class interest in opposition to mass movement , was the breaking point of the national struggle of 1922 ‘ ) ।
মূল্যায়ন
অসহযােগ আন্দোলনের পটভূমি যেভাবে গড়ে উঠেছিল , তার ওপর দাঁড়িয়ে ভারতবাসী স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখতেই পারত । কিন্তু গান্ধীজির আকস্মিক আন্দোলন প্রত্যাহারের সিদ্ধান্তের ফলে সেই স্বপ্ন সাময়িকভাবে অধরাই থেকে যায় । তাই লুই ফিশার বলেছেন — গান্ধীজির একটি কথাতেই সারা ভারত বিদ্রোহে ফেটে পড়তে পারত , কিন্তু তাঁর সেই কথাটি আর বলা হল না ।