অসহযোগ আন্দোলন ব্যর্থতার কারণ

অসহযোগ আন্দোলন ব্যর্থতার কারণ

index 5
অসহযোগ আন্দোলন

অসহযােগ আন্দোলনের সূচনা ( ১৯২০ খ্রি. ১ আগস্ট ) থেকে সমাপ্তিকালের ( ১৯২২ খ্রি. ২৫ ফেব্রুয়ারি ) মধ্যে আন্দোলনের ঘােষিত উদ্দেশ্যগুলি পূরণ হয়নি । খিলাফত সমস্যা ব্রিটিশ সরকার মীমাংসা করার আগেই তার প্রয়ােজনীয়তা ফুরােয় । জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের নায়করা কেউ শাস্তিও পাননি । আর এক বছরের মধ্যে স্বরাজ অর্জন ( Swaraj within a year ) — অধরাই থেকে যায় । সুভাষচন্দ্র বসু  ‘ দ্য ইন্ডিয়ান স্ট্রাগল ’ ( The Indian Struggle ) গ্রন্থে বলেছেন — এক বছরের মধ্যে স্বরাজ আনার প্রতিশ্রুতি শুধুমাত্র অবিজ্ঞচিতই নয় , তা ছিল শিশুসুলভ কল্পনামাত্র । 

একক নেতৃত্বের দুর্বলতা

মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীর একক নেতৃত্বের ওপর নির্ভর করে অসহযােগ আন্দোলনের সূচনা ও সমাপ্তি ঘটেছিল । গান্ধীজি সমকালীন ভারতীয় রাজনীতির শেষকথা হলেও তাঁর সব সিদ্ধান্ত সঠিক ছিল না । এ প্রসঙ্গে ভারত তত্ত্ববিদ রোমা রোঁলা  বলেছেন — একজন ব্যক্তির হাতে দেশের সকল ক্ষমতা তুলে দেওয়ার মধ্যে বিপদ আছে এবং যে সময় আন্দোলন চরমসীমায় উপনীত তখন আন্দোলন প্রত্যাহারের নির্দেশ বিপজ্জনক ছিল । সুভাষচন্দ্র এ প্রসঙ্গে আরও স্পষ্ট করে বলেছেন — একজন ব্যক্তির হাতে প্রচুর ক্ষমতা ও দায়িত্ব থাকার জন্যই অসহযােগ আন্দোলন ব্যর্থ হয়েছিল । 

তীব্র দমননীতি

ব্রিটিশ সরকার গান্ধীজি ছাড়াও দেশের শীর্ষ নেতাদের গ্রেফতার করে । সভা – সমিতি , মিছিল , মিটিং , পিকেটিং ( অবস্থান ধর্মঘট ) নিষিদ্ধ ঘােষণা করে । লাঠি চালিয়ে , এমনকি গুলি করে আন্দোলন স্তব্ধ করে দেওয়ার চেষ্টা করে । বড়ােলাট লর্ড রিডিং – এর তীব্র দমননীতির জন্য আন্দোলন দানা বাঁধতে পারেনি । 

আন্দোলনকারীদের আলাদা আলাদা স্বার্থ

ভারতের বিভিন্ন জায়গার শ্রেণিবিভক্ত সমাজের এক – একটি শ্রেণি আলাদা আলাদা স্বার্থ চরিতার্থের জন্য আন্দোলনে যােগ দেয় । কৃষকরা চেয়েছিল জমিদার ও মহাজনদের বিরুদ্ধে জমে থাকা অভিযােগগুলির সুরাহা করতে , শ্রমিকরা চেয়েছিল মালিকপক্ষের বিরুদ্ধে নিজেদের অবস্থানকে মজবুত করতে । বণিকশ্রেণির মূল লক্ষ্য ছিল , আরও বেশি করে মুনাফা অর্জনের সুযােগ সৃষ্টি করা ।

স্বরাজ সম্পর্কে অস্পষ্ট ধারণা 

গান্ধীজি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে অসহযােগ আন্দোলন সঠিকভাবে রূপায়িত করা গেলে এক বছরের মধ্যে স্বরাজ আসবে । কিন্তু প্রকৃত অর্থে স্বরাজ আসেনি । আসলে বিশাল দেশ ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে বিভিন্ন মানসিকতাসম্পন্ন মানুষ স্বরাজ সম্পর্কে কোনাে স্পষ্ট ধারণা না নিয়েই এই আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছিল । আন্দোলনকারীদের অনেকেই চরকা সত্যাগ্রহের আদর্শ ইত্যাদির অর্থ বুঝত না । তাদের এই অস্পষ্ট স্বরাজের ধারণাকে নেহরু ‘ অস্পষ্ট আনন্দ ’ ( Delightfully Vague ) বলে উল্লেখ করেছেন । 

জনশক্তি ও সংঘ শক্তির অভাব

ঐক্যবদ্ধ জনশক্তি ও অটুট সংঘশক্তির অভাব অসহযােগ আন্দোলনকে ব্যর্থ করে । এ প্রসঙ্গে জওহরলাল বলেন — আন্দোলনকে দীর্ঘদিন ধরে রাখার জন্য যে জনশক্তির প্রয়ােজন ছিল বা ব্রিটিশ বিরােধী রােষকে কাজে লাগানাের জন্য যে সংঘশক্তির দরকার ছিল তা সে সময়ে পাওয়া যায়নি । এ ছাড়া যুবসমাজও গ্রামােন্নয়ন এবং চরকা সম্পর্কে উৎসাহ হারিয়ে ফেলতে থাকে । সি. এফ. অ্যান্ড্রুজ গান্ধিজিকে জানিয়েছিলেন — যুবকদের মধ্যে খুব কমই উৎসাহ নিয়ে গ্রামােন্নয়নের কাজ করছে । চরকা বেশিদিন তাদের আকর্ষণ করতে পারবে না ।

খিলাফতের সঙ্গে অসহযোগ আন্দোলনের মিলন

খিলাফত আন্দোলনের সঙ্গে অসহযােগের মিলন ঘটানাে গান্ধীজির রাজনৈতিক জীবনের এক চরম ভুল সিদ্ধান্ত ছিল । কামাল পাশা তুরস্কে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে ( ১৯২২ খ্রি. ) খলিফা পদ তুলে দেওয়ায় ভারতে খিলাফত আন্দোলনের অপমৃত্যু ঘটে । ফলে মুসলমানরা অসহযােগ আন্দোলন থেকে দূরে সরে যায় । রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর খিলাফতের সঙ্গে অসহযোগকে মেশানাের জন্য গান্ধীজির সমালােচনা করে বলেন , জোড়াতালি দেওয়া এই রাজনীতি কখনাে স্বরাজ আনতে পারবে না ।  

মধ্যবিত্ত শ্রেণীর উদাসীনতা

মধ্যবিত্তশ্রেণিভুক্ত অনেকে প্রথম থেকেই এই আন্দোলনের প্রতি উদাসীন ছিলেন । কিছু সংখ্যক আইনজীবী , শিক্ষক , ডাক্তার যাঁরা এই আন্দোলনে যােগ দিয়েছিলেন তাঁরাও দীর্ঘদিন কর্মজগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন থাকায় পুনরায় কাজে যােগ দেওয়ার জন্য উদগ্রীব হয়ে ওঠেন । তাই বি. এন. পান্ডে বলেছেন — সামগ্রিকভাবে মধ্যবিত্তশ্রেণির পূর্ণ সমর্থন না পাওয়ার ফলে এই আন্দোলন ব্যর্থ হয় । 

ব্রিটিশ সঞ্চিত অর্থ

আন্দোলন চলাকালীন সর্বত্র সমানভাবে কৃষকশ্রেণির কাছ থেকে ব্রিটিশ কর আদায় করতে পারেনি , তবুও সঞ্চিত অর্থ থাকায় ব্রিটিশ তা কাজে লাগিয়ে আন্দোলন দমনের খরচ চালায় । 

গঠন মূলক কার্যাবলীর অভাব

কোনাে একটি গণ আন্দোলনকে নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য কেবলমাত্র নৈতিক ও রাজনৈতিক প্রশিক্ষণই যথেষ্ট নয় । এর জন্য মানুষের প্রাথমিক সমস্যাগুলির ওপরও গুরুত্ব দেওয়া উচিত । অর্থাৎ গঠন মূলক কার্যাবলীকে হাতিয়ার করে দীর্ঘ প্রস্তুতির দ্বারা অহিংস আন্দোলন সফলতার স্বাদ পেতে পারে । অসহযােগ আন্দোলনের মধ্যে যার অভাব দেখা যায় ।

Leave a Reply

Your email address will not be published.

x
error: Content is protected !!