ইতিহাস

খিলাফত আন্দোলনের অগ্রগতি ও সীমাবদ্ধতা

Contents

খিলাফত আন্দোলনের অগ্রগতি ও সীমাবদ্ধতা

ভারতীয় রাজনীতিতে ১৯২০ খ্রিস্টাব্দ এক অনন্য বৈশিষ্ট্যে স্মরণীয় হয়ে আছে । ওই বছরই মহাত্মা গান্ধির নেতৃত্বে অহিংস অসহযােগ আন্দোলন নামে প্রথম সর্বভারতীয় গণ আন্দোলনটির সূত্রপাত ঘটে । ঠিক এই সময় প্রথম বিশ্বযুদ্ধে পরাজিত তুরস্কের সুলতান অর্থাৎ খলিফার ( ইসলামের সর্বোচ্চ ধর্মগুরু ) পূর্বগৌরব ও পদমর্যাদা অক্ষুন্ন রাখতে ভারতীয় মুসলিমরা শুরু করেন খিলাফত আন্দোলনড. বিপান চন্দ্র  তাঁর ‘ আধুনিক ভারত ’ গ্রন্থে বলেছেন — খিলাফত আন্দোলন ভারতীয় জাতীয় আন্দোলনে এক নতুন স্রোতধারা নিয়ে আসে ( ‘ A new stream came into Khilafat movement ‘ ) ।

1594022409 khilafat
খিলাফত আন্দোলন

খিলাফত আন্দোলনের অগ্রগতি বা প্রসার

ছাত্রছাত্রীদের মাধ্যমে : 

১৯২১ ও ১৯২২ এই দুটি বছরে ভারতের প্রায় সর্বত্র অভূতপূর্ব গণজাগরণ ঘটল । বােম্বাই ছাড়াও আলিগড় , পাটনা , কলকাতা ও লখনৌতে এই আন্দোলনের রেশ ছড়িয়ে পড়ে । কংগ্রেস ও খিলাফত কমিটির মিলিত আহ্বানে সাড়া দিয়ে হাজার হাজার ছাত্র সরকারি স্কুল কলেজ বর্জন করে নবপ্রতিষ্ঠিত জাতীয় বিদ্যালয়সমূহে ভরতি হল । ওই সময় প্রতিষ্ঠিত হল আলিগড়ের জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়া ; পরে এই প্রতিষ্ঠান দিল্লিতে স্থানান্তরিত হয় । 

খিলাফত কমিটির নেতৃত্বে : 

১৯২১ – এর জুলাই মাসে সর্বভারতীয় খিলাফত কমিটির এক প্রস্তাবে বলা হয় যে , ব্রিটিশ ফৌজে ভারতীয় মুসলমানদের যােগদান করা অধর্ম হবে । সেপ্টেম্বর মাসে করাচিতে অনুষ্ঠিত খিলাফত সম্মেলনে আলি ভ্রাতৃদ্বয় আবার মুসলমান সৈন্যদের ব্রিটিশ ফৌজ বর্জনের আহ্বান জানান । মৌলানা সওকৎ আলিমৌলানা মহম্মদ আলির নেতৃত্বে নিখিল ভারত খিলাফত সম্মেলন সিদ্ধান্ত নেয় , ভারতীয় মুসলিমরা ব্রিটিশ সরকারের সঙ্গে কোনাে ব্যাপারেই আর সহযােগিতা করবে না । মহম্মদ আলি দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে ঘােষণা করেন যে , যদি ডিসেম্বর মাসের মধ্যে খিলাফত প্রশ্নের উপযুক্ত মীমাংসা না হয় তাহলে কংগ্রেসের আগামী আমেদাবাদ অধিবেশনেই স্বাধীন ভারতীয় সাধারণতন্ত্র ঘােষণা করা হবে । এই ধরনের বক্তৃতার জন্য আলি ভ্রাতৃদ্বয় এবং আরও চারজন খিলাফতি নেতাকে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধে গ্রেফতার করে দুবছরের জন্য সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয় । ( নভেম্বর , ১৯২১ খ্রি. ) । দেশের সর্বত্র কংগ্রেসি ও খিলাফতি স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীগুলিকে বেআইনি ঘােষণা করা হয় । 

কংগ্রেসের নেতৃত্বে :

এই সময় আমেদাবাদের কংগ্রেস অধিবেশনে খিলাফতি – নেতা মৌলানা হজরৎ মােহানিস্বরাজ ’ – এর সংজ্ঞা দেন — বিদেশি শাসন থেকে মুক্তি ও পূর্ণ স্বাধীনতা । সেই সঙ্গে তিনি সশস্ত্র আন্দোলনের পক্ষে মত প্রকাশ করেন । সেই অপরাধে তাঁর তিন বছর কারাদণ্ড হয় । খিলাফত – অসহযােগের সঙ্গে জড়িত বহু কংগ্রেস কর্মীও গ্রেফতার হন । তা সত্ত্বেও খিলাফত আন্দোলনের গতি অব্যাহত থাকে ।

খিলাফত আন্দোলনের অবসান

খিলাফত ও কংগ্রেসের এই যুগ্ম আন্দোলনের মাধ্যমে হিন্দু – মুসলমানের মধ্যে যে সংহতি গড়ে উঠেছিল তা কিন্তু দীর্ঘস্থায়ী হয়নি । মুস্তাফা কামাল পাশার নেতৃত্বে তুরস্কে সুলতানি – খলিফাতন্ত্রের বিলুপ্তি ঘটলে ভারতে খিলাফৎ আন্দোলন অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ে । অন্যদিকে চৌরিচৌরার ঘটনায় অসহযােগ আন্দোলন বন্ধ হয়ে গেলে জাতীয় আন্দোলনের গতিও স্তিমিত হয়ে পড়ে ।

খিলাফত আন্দোলনের সীমাবদ্ধতা

কোনাে কোনাে ঐতিহাসিক খিলাফত আন্দোলনের সীমাবদ্ধতার উল্লেখ করেছেন । 

ধর্মকেন্দ্রিক :

তুরস্কের খলিফার স্বার্থরক্ষার উদ্দেশ্যে মুসলিম সম্প্রদায়ের নেতৃত্বে ও সমর্থনে গড়ে উঠেছিল খিলাফত আন্দোলন । ধর্মকেন্দ্রিক একটি আন্দোলনের সঙ্গে জাতীয় আন্দোলনের সংযুক্তির সিদ্ধান্ত সঠিক হয়নি । 

পৃথক জাতির অস্তিত্ব স্বীকার : 

মুসলিম নেতৃবর্গের দ্বারা পরিচালিত মুসলিমদের স্বার্থরক্ষার উদ্দেশ্যে গড়ে ওঠা খিলাফত আন্দোলনে জাতীয় কংগ্রেসের সমর্থন আসলে পৃথক জাতির অস্তিত্বকে স্বীকার করে নেওয়ারই নামান্তর । রমেশচন্দ্র মজুমদারের  মতে , খিলাফত আন্দোলনকে সমর্থন দ্বারা গান্ধিজি পরােক্ষভাবে মুসলমানদের পৃথক জাতি বলে মেনে নেন । 

ভারতের স্বাধীনতা প্রশ্নে অবহেলা : 

ভারতীয় মুসলমানরা ভারতে বসবাস করেও ভারতের স্বাধীনতার প্রশ্নকে পাশ কাটিয়ে তুরস্কের খলিফার পদ ফিরিয়ে দেওয়াকে অধিক গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন । তাদের এই ভাবনা দেশদ্রোহিতারই সামিল । আর তাতে মদত দিয়েছিলেন গান্ধিজিসহ দেশের শীর্ষ নেতৃবৃন্দ । তাই সি. এফ. অ্যান্ড্রুজের  মতে — তুরস্ক সাম্রাজ্যের স্বার্থে তােলা খিলাফত দাবি ভারতবর্ষের স্বাধীনতার বিষয়টিকে গুরুত্বহীন করে তুলেছে । 

সর্বজনগ্রাহ্য তার অভাব :

আপামর ভারতবাসীর খিলাফত সম্বন্ধে স্পষ্ট ধারণার অভাব ছিল । তাই জওহরলাল  বলেছেন — গ্রাম এলাকায় অধিকাংশ লােক খিলাফতের অর্থ বুঝতেন না (‘ … the word ‘ Khilafat ‘ bore a strange meaning in most of the rural areas’ )।

মূল্যায়ন 

খিলাফত আন্দোলন ভারতের জাতীয় আন্দোলনকে কতটা সমৃদ্ধ করেছিল তা নিয়ে মতভেদ আছে । এই আন্দোলনের হাত ধরে হিন্দু – মুসলিম ঐক্য সাময়িকভাবে গড়ে উঠলেও পরবর্তী সময়ে ধর্মনিরপেক্ষতা বিনষ্ট হয়েছিল । চরমপন্থী আন্দোলনের মতােই খিলাফত আন্দোলনও মিথ্যা জাত্যভিমানের জন্ম দিয়েছিল । এ প্রসঙ্গে অধ্যাপক অমলেশ ত্রিপাঠী বলেছেন — চরমপন্থী আন্দোলন থেকে হিন্দুদের মধ্যে যে মিথ্যা জাতি , বর্ণ , ধর্মসহ জাত্যভিমান জন্মেছিল , খিলাফত আন্দোলন যেন মুসলিম মুকুরে তারই প্রতিবিম্ব ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!