খিলাফত আন্দোলন কি
Contents
খিলাফত আন্দোলন কি

ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে খিলাফত আন্দোলন এক বিশেষ অধ্যায় । জাতীয় আন্দোলনকে খিলাফত নামক অক্সিজেন দিয়ে জীবন্ত ও প্রাণবন্ত করে তুলতে চেয়েছিলেন গান্ধীজীসহ জাতীয় নেতৃবর্গ । যদিও খিলাফত আন্দোলনকারীরা ভারতমাতার শৃঙ্খল মােচন অপেক্ষা তুরস্কের খলিফা পদ নিয়ে বেশি চিন্তিত ছিলেন । তবুও এই আন্দোলন হিন্দু – মুসলিম মৈত্রী প্রচেষ্টার এক সুবর্ণ সুযােগ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছিল । জওহরলাল নেহরু মনে করেন — খিলাফত আন্দোলন জাতীয়তাবাদ , রাজনীতি ও ধর্মের অপূর্ব মেলবন্ধন ছিল ।
খিলাফত শব্দের অর্থ
‘ খিলাফত ’ শব্দটি খলিফা ( Calipha ) শব্দের সঙ্গে সংযুক্ত । ‘ খিলাফত ‘ — এই শব্দটির অর্থ হল উত্তরাধিকারী । ৬৩২ খ্রিস্টাব্দে নবি হজরত মহম্মদ মারা যাওয়ার পর মদিনাতে হজরত আবুবকর খলিফা হিসেবে নির্বাচিত হলে খিলাফত আদর্শের সূচনা ঘটে । আব্বাসীয় বংশের পতন ঘটার পর তুর্কিরা রাজনৈতিক ক্ষমতা লাভ করলে তুর্কি সুলতান মুসলমানদের ‘ খলিফা ’ ( ধর্মগুরু ) হিসেবে পরিচিতি পান । তত্ত্বগত দিক থেকে এই খলিফা ছিলেন ইসলাম ধর্মাবলম্বী মানুষদের পার্থিব ও আধ্যাত্মিক নেতা । বিংশ শতকে এই তুরস্কের সুলতান একাধারে ছিলেন অটোমান তুর্কি সাম্রাজ্যের প্রধান এবং সমগ্র মুসলিম জগতের ধর্মগুরু ।
খিলাফত আন্দোলনের কারণ
তুরস্ক ব্যবচ্ছেদ :
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে তুরস্ক জার্মানির পক্ষ নেয় ও ইংল্যান্ডের বিরােধিতা করে । কিন্তু যুদ্ধে জার্মানি হেরে যাওয়ার পর মিত্রশক্তি তুরস্কের ব্যবচ্ছেদ করে ও খলিফা পদ কেড়ে নেয় । এতে বিশ্বের মুসলিম সমাজ ক্ষুদ্ধ হয় ।
ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ :
ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী লয়েড জর্জ ঘােষণা করেন ( ১৯১৮ খ্রি. ৫ জানুয়ারি ) ব্রিটেন , ফ্রান্স তুরস্ক সাম্রাজ্য থেকে এশিয়া মাইনর , থ্রেস ইত্যাদি অঞ্চল বিচ্ছিন্ন করবে না । কিন্তু প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর বেইমান ব্রিটিশ তুর্কী সাম্রাজ্য ব্যবচ্ছেদের পরিকল্পনা ঘােষিত হয় । ফলে ভারতের মুসলিমরা শওকত আলি ও মহম্মদ আলির নেতৃত্বে শুরু করে খিলাফৎ আন্দোলন ।
খিলাফত আন্দোলনের দাবি সমূহ
জাতীয় কংগ্রেস ও মুসলিম লিগের নেতারা দিল্লিতে এক বৈঠকে একজোট হন ( ১৯১৮ খ্রি. ডিসেম্বর ) । তাঁরা 一
1. বিশ্বের মুসলিম রাষ্ট্রগুলির অখণ্ডতা রক্ষার দাবি জানান এবং
2. সমগ্র আরব অঞ্চল ( জাজিরাত-উল-আরব ) তুরস্কের খলিফার হাতে ফিরিয়ে দেওয়ার দাবি জানান । এ ছাড়াও খিলাফৎ কমিটির নেতারা দাবি জানিয়ে বলেন –
( i ) খলিফার সাম্রাজ্য অক্ষুন্ন রাখতে হবে ।
( ii ) পবিত্র মক্কা – মদিনার ওপর বিদেশি রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ বন্ধ রাখতে হবে ।
( iii ) খলিফার পার্থিব ও ধর্মীয় অধিকারে হস্তক্ষেপ করা চলবে না ।
( iv ) মেসােপটেমিয়া , আরব , সিরিয়া ও প্যালেস্টাইনে খলিফার কর্তৃত্ব বজায় রাখতে হবে ।
খিলাফত আন্দোলনের প্রসার
প্রথমে ( ১৯১৩ খ্রি. ) মৌলানা আবদুল বারি , মৌলানা মহম্মদ আলি এবং মৌলানা সওকত আলি ( আলি ভ্রাতৃদ্বয় ) মুসলিম তীর্থস্থানগুলির পবিত্রতা রক্ষার উদ্দেশ্যে গঠন করেন ‘ অঞ্জুমান – ই – খুদ্দাম – ই – কাবা ‘ । একই লক্ষ্যে মৌলানা ওবেদুল্লা সিন্দ্রি দিল্লিতে গঠন করেন ‘ নজরাতুল মারিফ ’ নামক একটি সংগঠন । প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন আলি ভ্রাতৃদ্বয় ‘ দি কমরেড ’ , ‘ হামদারদ ’ সহ বিভিন্ন প্রবন্ধে তুরস্কের প্রতি সহানুভূতি জানান । তুর্কি সুলতান তথা খলিফার হারানাে মর্যাদা পুনরুদ্ধারের লক্ষ্যে বােম্বাইয়ের কয়েকজন মুসলিম ব্যবসায়ী গড়ে তােলেন ‘ মজলিস – ই খিলাফৎ ‘ ( ১৯১৯ খ্রি. ) ।
নিখিল ভারত খিলাফত কমিটি গঠন
লক্ষ্ণৌতে মৌলানা আবদুল বারি ও আলি ভ্রাতৃদ্বয়ের প্রচেষ্টায় এবং মৌলানা আবুল কালাম আজাদ , হাকিম আজমল খাঁর সহযােগিতায় নিখিল ভারত খিলাফত কমিটি গঠিত হয় ( ১৯১৯ খ্রি. ২৪ নভেম্বর ) । এই কমিটির প্রধান কার্যালয় গড়ে ওঠে বােম্বাইয়ে । ফজলুল হকের সভাপতিত্বে এর প্রথম অধিবেশন বসে দিল্লিতে । এই সম্মেলনে বয়কট ও অসহযােগের সিদ্ধান্ত গ্রহণের পাশাপাশি আরব , সিরিয়া , প্যালেস্টাইন ও মেসােপটেমিয়ার ওপর খলিফার আধিপত্যকে অক্ষুন্ন রাখার দাবি তােলা হয় । এ ছাড়াও বলা হয় মুসলিমদের পবিত্র স্থান মক্কা ও মদিনার ওপর বিদেশিদের কোনােরকম হস্তক্ষেপ বরদাস্ত করা হবে না ।
গান্ধীজি ও খিলাফত আন্দোলন
ব্রিটিশ বিরােধী খিলাফত আন্দোলনকে গান্ধীজি হিন্দু-মুসলিম মৈত্রী প্রচেষ্টার এক সুবর্ণ সুযােগরূপে গ্রহণ করেন । এ প্রসঙ্গে তিনি মহম্মদ আলিকে লেখেন — মুসলিম প্রশ্নের ঠিকমতাে সমাধান করা গেলে স্বরাজ লাভ সম্ভব । তিনি খিলাফত কমিটিকে স্বাগত জানিয়ে বলেন — আমরা যদি মুসলিমদের প্রকৃতই ভাই বলে মনে করি , তাহলে তাদের বিপদ উপস্থিত হলে এবং ন্যায় তাদের পক্ষে আছে বুঝতে পারলে তাদের যথাসাধ্য সাহায্য করাই আমার কর্তব্য । সর্বভারতীয় খিলাফত সম্মেলনের এক বিশেষ অধিবেশনে গান্ধীজি সভাপতির পদ গ্রহণ করেন এবং খিলাফত দাবির প্রতি সমর্থন জানান । গান্ধীজি প্রচণ্ডভাবেই চেয়েছিলেন হিন্দু – মুসলিম ঐক্যকে কাজে লাগিয়ে জাতীয় আন্দোলনকে গতিশীল করে তুলতে । গান্ধীজি চেয়েছিলেন অসহযােগ আন্দোলনের সাথে খিলাফত আন্দোলনকে যুক্ত করতে । তাই তিনি বলেন —হিন্দু – মুসলিম ঐক্যের এমন সুযােগ একশাে বছরেও আর আসবে না ।
জাতীয় কংগ্রেসের সমর্থন
কলকাতায় জাতীয় কংগ্রেসের বিশেষ অধিবেশনে ( ১৯২০ খ্রি. সেপ্টেম্বর ) জাতীয় কংগ্রেস খিলাফত প্রশ্নকে সমর্থন জানায় । অধিবেশনে এক প্রস্তাব গ্রহণ করে বলা হয় , খিলাফত প্রশ্নে যতদিন কোনাে মীমাংসা না হচ্ছে এবং পাঞ্জাবের প্রতি যতদিন না অন্যায়ের প্রতিকার করা হচ্ছে , ততদিন ভারত শান্ত হবে না । জাতীয় কংগ্রেসের শীর্ষ নেতৃবৃন্দ খিলাফত আন্দোলনের প্রতি সমর্থন জানিয়ে হিন্দু – মুসলিম ঐক্য দৃঢ় করার চেষ্টা করেন ।
খিলাফত আন্দোলনের ব্যর্থতার কারণ
খিলাফত আন্দোলন শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়েছিল , কারণ —
হিংসার অনুপ্রবেশ :
এই আন্দোলন শেষপর্যন্ত অহিংস ছিল না , মালাবারের মােপালা বিদ্রোহের মতাে হিংসাত্মক ঘটনা ঘটেছিল ।
স্বরাজের দাবির উপেক্ষা :
বেশিরভাগ মুসলমান নেতৃবর্গ খিলাফত প্রশ্নের সমাধান নিয়েই বেশি ব্যগ্র ছিলেন , তাদের কাছে স্বরাজের দাবি উপেক্ষিত ছিল ।
খলিফার জনপ্রিয়তার অভাব :
খলিফা তথা মুসলিম জগতের ধর্মগুরু নিজের দেশেই ততটা জনপ্রিয় ছিলেন না , এ ব্যাপার ভারতের খিলাফত নেতৃবর্গ জানতেন না । এ চরম সত্য উন্মােচিত হয় যখন দেখা যায় কামাল পাশার নেতৃত্বে তুরস্কে খলিফাতন্ত্রের অবসান ঘটে এবং ভারতে মুসলমান সম্প্রদায় এর কোনাে প্রতিবাদ করেন না ।
বিচ্ছিন্নতাবাদ ও সাম্প্রদায়িক চরিত্র :
এক শ্রেণির উলেমা , মােল্লা মৌলবাদী প্রচারের মাধ্যমে বিচ্ছিন্নতাবাদ ও সাম্প্রদায়িক বিভেদে মদত দেওয়ায় এই আন্দোলন তার চরিত্র হারায় , হিন্দু – মুসলিম ঐক্য বিনষ্ট হয় ।
মূল্যায়ন
ভ্যাটিকান সিটিতে পােপের ওপর অন্যায় করা হলে সারা বিশ্বের ক্যাথােলিক খ্রিস্টানদের ধর্মবিশ্বাসে যেমন আঘাত লাগে , তেমন তুরস্কের খলিফার অপমানে ভারতের মুসলমানরাও অপমানিত বােধ করেছিল , এতে অন্যায় কিছু নেই । কিন্তু অন্যায় যেটা তা হল স্বদেশ ভূমির মুক্তি চিন্তাকে পাশ কাটিয়ে শুধুমাত্র খলিফার মুক্তিচিন্তায় বিভাের থাকা । তাই জুডিথ ব্রাউন সমালােচনার সুরে লিখেছেন — গান্ধি যে কৌশল দ্বারা ব্যাপক মুসলিম সমর্থন লাভ করেন তা পরে বৃহৎ বুমেরাং হয়ে ফিরে আসে ।