রাওলাট আইন কী
Contents
রাওলাট আইন কী

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে ভারতে রাজদ্রোহিতা ( sedition ) ও বৈপ্লবিক কার্যকলাপের গতিপ্রকৃতি নিরুপণ করা এবং বৈপ্লবিক আন্দোলন দমনের জন্য প্রয়ােজনীয় ব্যবস্থা অবলম্বনের সুপারিশ করা — এই উদ্দেশ্যে ভারত সরকার ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দে সিডিশন কমিটি গঠন করে । ইংল্যান্ডের বিচারপতি সিডনি রাওলাট ছিলেন এই কমিটির সভাপতি । এই কারণে এই কমিটি রাওলাট কমিটি নামেই বেশি পরিচিত । ১৯১৮ খ্রিস্টাব্দের এপ্রিল মাসে রাওলাট কমিটি তার প্রতিবেদন পেশ করে । ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দের ২১ ফেব্রুয়ারি কমিটির সুপারিশগুলি বিল হিসেবে কেন্দ্রীয় আইন সভায় উত্থাপিত হয় এবং ১৮ মার্চ , ১৯১৯ খ্রি. তা আইন হিসেবে পাস হয় । এটিই রাওলাট আইন নামে কুখ্যাত । এই আইনটির আসল নাম ছিল — ‘ দ্য অ্যানার্কিক্যাল অ্যান্ড রেভল্যুশনারি অ্যাক্ট ‘ ( The Anarchical and Revolutionary Act ) ।
রাওলাট আইনের পটভূমি
রাওলাট আইন প্রবর্তনের পটভূমি বিশ্লেষণে দেখা যায় —
মন্ট-ফোর্ড এর প্রতিক্রিয়া :
মন্টেগু চেমসফোর্ড শাসন সংস্কারের প্রতিক্রিয়া হিসেবে ভারতবাসীর মনে ব্রিটিশ বিরােধী তীব্র ক্ষোভ ও হতাশা জন্মায় । ভারতীয়দের এই ব্রিটিশ বিরােধী মনােভাব অচিরেই বিপ্লবমুখী হয়ে উঠতে পারে এই আশঙ্কায় ব্রিটিশ শঙ্কিত হয়ে পড়ে , যার পরিণতি দমনমূলক রাওলাট আইন ।
ভারত প্রতিরক্ষা আইনের সমাপ্তি :
ভারতবাসীর জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে স্তব্ধ করে দেওয়ার লক্ষ্যে ব্রিটিশ সরকার ভারত প্রতিরক্ষা আইন চালু করেছিল । কিন্তু প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়ে যাওয়ার পর এই দমনমূলক আইনটির মেয়াদ শেষ হয়ে আসায় নতুন করে আর-এক দমনপীড়ন মূলক আইন প্রবর্তনের প্রয়ােজন হয়ে পড়ে ।
দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি ও বেকারত্ব :
ভারতে বিশ্বযুদ্ধ জনিত প্রভাবে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি , বেকারত্ব ভারতবাসীকে ক্ষুদ্ধ করে ।
তুরস্ক সমস্যা :
অপর দিকে মুসলমান সম্প্রদায় তুরস্কের প্রতি ব্রিটিশের বেইমানিতে ক্ষোভে ফেটে পড়ে ।
বর্ণবৈষম্য নীতি :
দক্ষিণ আফ্রিকায় কৃষ্ণাঙ্গ ভারতীয়দের ওপর শ্বেতাঙ্গদের বর্ণবৈষম্য নীতি ভারতবাসীকে ব্যথিত করে । এই সংকটজনক পরিস্থিতির মােকাবিলার জন্য ব্রিটিশ সরকার রাওলাট আইন প্রবর্তন করে ।
রাওলাট আইনের উদ্দেশ্য
রাওলাট আইন প্রবর্তনের মূল উদ্দেশ্য ছিল ভারতবাসীর সর্বপ্রকার রাজনৈতিক আন্দোলন দমন করা এবং সর্বপ্রকার বিপ্লবী কর্মপ্রচেষ্টাকে দমন করে ভারতে ব্রিটিশ শাসন চালিয়ে যাওয়া ।
রাওলাট আইনের শর্ত
রাওলাট আইনের বিভিন্ন উল্লেখযােগ্য ধারা বা শর্ত গুলি ছিল এইরকম 一
1. ব্রিটিশ বিরােধী যে কোনাে কাজ দণ্ডনীয় অপরাধ বলে গণ্য হবে ।
2. সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের আগে থেকে কোনাে সতর্ক না করেই বিনাবিচারে গ্রেফতার করা যাবে বা আটকে রাখা যাবে ।
3. কোনাে সন্দেহজনক ব্যক্তির ঘরবাড়ি বিনা গ্রেফতারি পরােয়ানায় তল্লাশি চালানাে যাবে ।
4. কোনােরকম সাক্ষ্য – প্রমাণ ছাড়াই বিচারক বিচারের কাজ করতে পারবেন ।
5. বিচারকরা বিচারে যে রায় দেবেন , অপরাধীরা সেই রায়ের ওপর উচ্চ আদালতে কোনাে আপিল করতে পারবে না ।
6. সংবাদপত্রের স্বাধীনতার ওপর বিভিন্ন নিষেধ আরােপ করা হবে ।
রাওলাট আইনের প্রতিক্রিয়া
পত্রপত্রিকায় :
বাংলা , পাঞ্জাব , যুক্তপ্রদেশ এবং দক্ষিণ ভারতের বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় এই আইনের বিরােধিতা করে তীব্র প্রতিবাদ জানানাে হয় ।
আইনসভার সদস্যদের :
কেন্দ্রীয় আইনসভার ভারতীয় সদস্যগণ এই আইনের বিরােধিতা করেন । মধ্যপ্রদেশে জমিদার শ্রেণির প্রতিনিধিগণ এই আইনের প্রতিবাদ জানিয়ে আইনসভা ত্যাগ করেন ।
মহম্মদ আলি জিন্নার :
মহম্মদ আলি জিন্না এই আইনের প্রতিবাদে আইন পরিষদের সদস্যপদ ত্যাগ করেন । জিন্না ক্ষোভ জানিয়ে বলেন— “ ন্যায় বিচারের মূল আদর্শ ধ্বংস করা হয়েছে এবং যে সময়ে রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়ার কোনাে আশঙ্কা নেই , তখনই জনগণের সাংবিধানিক অধিকার কেড়ে নেওয়া হল ”।
গান্ধিজির :
এই ঘৃণ্য ‘ কালা আইন ’ – এর তীব্র প্রতিবাদ করে বড়ােলাট লর্ড চেমসফোর্ডকে তা কার্যকারী না করার অনুরােধ জানান গান্ধিজি । আবেদন প্রত্যাখ্যাত হলে গান্ধিজি এই আইনের বিরুদ্ধে সংগ্রামের জন্য ভারতব্যাপী সত্যাগ্রহ আন্দোলনের ডাক দেন ।
রাওলাট সত্যাগ্রহ
রাওলাট আইনের বিরুদ্ধে গান্ধিজি সমগ্র দেশ জুড়ে ধর্মঘটের ডাক দেন । ১৯১৯ খ্রি. ৬ এপ্রিল দিনটিতে সংগঠিত হয় ভারতের প্রথম সর্বভারতীয় ধর্মঘট পালিত হয় ভারতব্যাপী ব্রিটিশ বিরােধী হরতাল । দিল্লিতে ধর্মঘটিদের ওপর পুলিশ গুলি চালালে ৮ জন মারা যায় ও ১০০ জন আহত হয় । এর প্রতিবাদে ৭ দিন রেল চলাচল ও দিল্লির সকল দোকানপাট বন্ধ থাকে । গান্ধিজি সরকারি নিষেধ অগ্রাহ্য করে দিল্লি অভিমুখে যাত্রা করলে দিল্লির নিকটবর্তী পালওয়াল স্টেশনে গ্রেপ্তার হন । এতে সারা দেশে বিক্ষোভের আগুন ছড়িয়ে পড়ে ।
জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ড
রাওলাট আইনকে কেন্দ্র করে গান্ধিজির আহ্বানে সারাদেশ গণ আন্দোলনে ঝাপিয়ে পড়লে ব্রিটিশ সরকার গুলির বিনিময়ে তাকে স্তব্ধ করে দেওয়ার চেষ্টা করে । ফলে দিল্লি , লাহাের , গুজরানওয়ালা , কাসুর , অমৃতসর প্রভৃতি স্থানে হিংসাত্মক কার্যকলাপ শুরু হয় । পাঞ্জাবের গভর্নর স্যার মাইকেল ও ডায়ার পাঞ্জাবে সামরিক আইন জারি করেন । এরই প্রতিবাদে ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দের ১৩ এপ্রিল বিকেল সাড়ে চারটার সময় অমৃতসর শহরের পূর্বপ্রান্তে জালিয়ানওয়ালাবাগ নামে এক উদ্যানে প্রায় দশ হাজার নিরস্ত্র মানুষ শান্তিপূর্ণ সভায় মিলিত হয় । তাদের কোনােভাবেই সতর্ক না করে ৫০ টি রাইফেল থেকে একনাগাড়ে ১০ মিনিট ধরে গুলি ছুঁড়ে দুহাজারেরও বেশি নরনারীকে হতাহত করা হয় । ব্রিটিশ সরকারের এই পাশবিক আচরণে সারা ভারত সাময়িকভাবে স্তম্ভিত হয়ে যায় , কিন্তু পরক্ষণেই প্রতিবাদে গর্জে ওঠে । বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঘৃণাভরে তাঁর রাজসম্মান নাইট উপাধি বর্জন করেন ।
উপসংহার
গান্ধিজি ‘ ইয়ং ইন্ডিয়া ’ পত্রিকায় লেখেন — এই শয়তান সরকারের সংশােধন অসম্ভব , একে শেষ করতেই হবে । শুধু এদেশেই নয় , খােদ ইংল্যান্ডেই ব্রিটিশ সাংসদ চার্চিল ( দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ) বলেছিলেন . এই ঘটনা অতি অস্বাভাবিক , অতি পাশবিক — স্বীয় বৈশিষ্ট্যে এই ঘটনা একক । ঐতিহাসিক এইচ. এইচ. ডডওয়েলের মতে এক সংকটময় সময়ে কুখ্যাত রাওলাট ভারতবর্ষে সর্বজনীন প্রতিরােধ গড়ে তুলতে সাহায্য করেছিল । (‘At this crisis there came the notorious Rowlatt Acts which evoked universal opposition in India’)।