হোমরুল লীগ আন্দোলন কি
Contents
হোমরুল লীগ আন্দোলন কি

জাতীয় আন্দোলনের মূল ধারার পাশাপাশি যে কয়েকটি আন্দোলনের উপধারা জাতীয় আন্দোলনকে পুষ্ট ও গতিশীল করে তুলেছিল তার মধ্যে অন্যতম ছিল হােমরুল লীগ আন্দোলন । একদিকে অ্যানি বেসান্ত এর হোমরুল লীগ , অপর দিকে তিলকের হোমরুল লীগ মিলিতভাবে ভারতবাসীর মনে স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা জাগিয়ে তুলেছিল এবং এক নতুন উদ্দীপনার সৃষ্টি করেছিল । ড. রমেশচন্দ্র মজুমদারের ‘ স্ট্রাগল ফর ফ্রিডম ’ ( Struggle for Freedorm ) – এ উল্লেখ আছে , ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামে হােমরুল আন্দোলন এক নতুন যুগের সূচনা ঘটায় ( ‘ The Home Rule Movement marked the beginning of a new phase in India’s struggle for freedom ‘ ) ।
হোমরুল কথার অর্থ
‘ হােমরুল ’ শব্দটির অর্থ হল স্বায়ত্তশাসন । এর আসল অর্থ পঞ্চায়েত , পৌরসভা , জেলাবাের্ড , প্রাদেশিক শাসন পরিষদ ও কেন্দ্রীয় আইন পরিষদ সকল ক্ষেত্রেই ভারতবাসীর আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করা । বেসান্ত ও তিলক আয়ারল্যান্ডের অনুকরণে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের মধ্যে থেকেই স্বায়ত্তশাসনের অধিকার দাবি করেন । কিন্তু তাঁদের এই দাবি কংগ্রেসের নরমপন্থী নেতৃবৃন্দের পছন্দ না হওয়ায় তারা দুজনে আলাদাভাবে জাতীয় আন্দোলনের মূল ধারা থেকে সরে গিয়ে আলাদা আলাদাভাবে আন্দোলন গড়ে তােলেন । তিলক ঘােষণা করেন — আয়ারল্যান্ডে আইরিশ স্বায়ত্তশাসন বাদীরা যা চায় আমরা ভারতে তাই চাই । আমরা শাসন সংস্কার চাই , ব্রিটিশ শাসনের উচ্ছেদ করতে চাই না ।
হোমরুল লীগ আন্দোলনে অ্যানি বেসান্ত এর ভূমিকা
স্বায়ত্তশাসনের আদর্শ প্রচার :
ভারতে হােমরুল আন্দোলনের সূচনা ঘটান অ্যানি বেসান্ত । তিনি মনে করতেন — ভারতবাসীর সর্বাঙ্গীণ মঙ্গলের জন্য ভারতীয়দের হাতেই প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতা থাকা জরুরি । তাঁর এই মতের স্বপক্ষে জনমত গড়ে তােলার জন্য তিনি নিউ ইন্ডিয়া নামে এক দৈনিক পত্রিকা ও কমনউইল নামে এক সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশ করে স্বায়ত্তশাসনের আদর্শ প্রচার করেন ।
হোমরুল লীগ গঠন :
অ্যানি বেসান্ত স্বায়ত্তশাসন অর্জনের লক্ষ্যে মাদ্রাজের আর্ডিয়ারে হােমরুল লীগ গঠন করেন ( ১৯১৬ খ্রি. সেপ্টেম্বর ) । এর সম্পাদক নিযুক্ত হন জর্জ আর্নডেল । অচিরেই কানপুর , মুম্বাই , বারাণসী , এলাহাবাদসহ বিভিন্ন অঞ্চলে এই লীগের প্রায় ২০০ টি শাখা গড়ে ওঠে । সদস্য সংখ্যা ২৭ হাজার ( ১৯১৭ খ্রি. ) থেকে এক বছরে বেড়ে হয় ৩২ হাজার । এই লীগের কয়েকজন উল্লেখযােগ্য সদস্য ছিলেন জওহরলাল নেহরু , তেজবাহাদুর সপ্রু , সি. পি. রামস্বামী আয়ার ও বি. পি. ওয়াদিয়া প্রমুখ ।
হোমরুল লীগ আন্দোলনে বালগঙ্গাধর তিলক এর ভূমিকা
স্বায়ত্তশাসনের আদর্শ প্রচার :
হােমরুল আন্দোলনকে জনপ্রিয় করে তােলার লক্ষ্যে তিলক দেশের নানাস্থানে জনসভার আয়ােজন করেন । এইসব জনসভায় তিলক স্বায়ত্তশাসনের স্বপক্ষে জনমত গড়ে তােলার চেষ্টা করেন । তিলক ঘােষণা করেছিলেন — স্বরাজ আমার জন্মগত অধিকার , তা আমাকে পেতেই হবে ( ‘ Swaraj is my birth right and will have it ‘ ) । তিলকের এই উক্তি সারা দেশ জুড়ে ব্যাপক উৎসাহ ও উদ্দীপনার সৃষ্টি করে । তিলক ‘ মারাঠা ’ ও ‘ কেশরী ’ পত্রিকার মধ্য দিয়ে তাঁর আদর্শ ও উদ্দেশ্য প্রচার করেন ।
হােমরুল লীগ গঠন :
বেলগাঁওতে অনুষ্ঠিত বােম্বাই প্রাদেশিক সভায় তিলক গঠন করেন ইন্ডিয়ান হােমরুল লীগ ( ১৯১৬ খ্রি. ২৮ এপ্রিল ) । এই লীগের সভাপতি হিসেবে জোসেফ ব্যাপটিস্তা ও সম্পাদক হিসেবে এন. সি. কেলকার নিযুক্ত হন । তিলক বলেন — দমন পীড়ন বিদ্রোহের আগুন জ্বালাতে সাহায্য করবে । হােমরুল এখন ছড়িয়ে পড়বে দাবানলের মতাে ।
হোমরুল লীগের কার্যাবলী
একই লক্ষ্য পূরণের জন্য দুটি হােমরুল লীগ গড়ে উঠলেও দুটির মধ্যে কোনাে বিবাদ বাধেনি । কেননা তিলকের হােমরুল লীগ মহারাষ্ট্র ( মুম্বাই বাদে ) , মধ্যপ্রদেশ , বেরার ও কর্ণাটকে তার বিভিন্ন শাখা প্রসারিত করে কাজ শুরু করে , অপর দিকে বেসান্ত এম. সুব্রহ্মনিয়াম আয়ারকে সঙ্গে নিয়ে মাদ্রাজ , উত্তরপ্রদেশ , গুজরাত , সিন্ধু প্রদেশে তার কার্যাবলি বজায় রাখেন । সুবাগ্মী শ্রীমতী বেসান্ত তাঁর ক্ষুরধার বক্তৃতা ও সংগঠন প্রতিভার দ্বারা হােমরুল আন্দোলনকে জনপ্রিয় করে তেলেন । তিলক মারাঠিতে ছটি এবং ইংরেজিতে দুটি ইস্তাহার প্রকাশের পাশাপাশি বেশকিছু পুস্তক ইংরেজিতে প্রকাশ করেন । জনমত গঠনের জন্য তাঁরা শুধুমাত্র বক্তৃতা এবং পুস্তকের প্রচার করেননি বিভিন্ন আলােচনা চক্র , সমাজ সেবামূলক কাজ , অস্পৃশ্যতা দূরীকরণের মতাে সমাজ সংস্কারমূলক কাজও পরিচালনা করেন ।
হোমরুল লীগ আন্দোলনের প্রসার
তিলক ও বেসান্তের প্রচেষ্টায় হােমরুল আন্দোলন দ্রুত দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়তে থাকে । আন্দোলনে ছাত্র – যুব , সরকারি কর্মচারীসহ গ্রামের মানুষরাও অংশ নেয় । এলাহাবাদে জওহরলাল , লক্ষ্ণৌতে চৌধুরী খলিফুজ্জামান , কলকাতায় জিতেন্দ্রলাল বন্দ্যোপাধ্যায় , মাদ্রাজে সত্যমূর্তি , গুজরাতে ইন্দ্রলাল যাজ্ঞিক প্রমুখ তরুণদের সক্রিয় নেতৃত্বে আন্দোলন চরমে পৌঁছােয় । এই আন্দোলনের সময়েই গান্ধিজি জাতীয় রাজনীতির মূলধারার সঙ্গে যুক্ত হন । বিভিন্ন জায়গায় দুই লীগের সদস্যরা যে যার নিজস্ব কর্ম পদ্ধতি বজায় রাখায় আন্দোলন পরিচালনায় কোনাে অসুবিধা হয়নি । এ প্রসঙ্গে বেসান্ত নিজেই বলেছিলেন — তাঁর ( তিলকের ) কিছু অনুগামী আমাকে পছন্দ করবেন না , আবার আমারও কিছু অনুগামী তাঁকে ( তিলককে ) পছন্দ করবেন না । যদিও আমাদের মধ্যে কোনাে বিবাদ নেই । বেসান্তের লীগে ২০০ টি শাখার মধ্যে শুধুমাত্র মাদ্রাজেই ছিল ১৩২ টি শাখা । তিলক চেয়েছিলেন মহারাষ্ট্রসহ পশ্চিম ভারতে তাঁর রাজনৈতিক প্রভাব ধরে রাখতে । তিলক এ সময়েই ‘ লােকমান্য ’ উপাধিতে ভূষিত হন । রমেশচন্দ্র মজুমদার বলেছেন— “ তিনি ( তিলক ) ‘ লােকমান্য ’ উপাধিতে ভূষিত হন এবং প্রায় দেবতায় পরিণত হন ” ( He earned the epithet ‘ Lokamanya ‘ and was almost worshipped as a god ) ।
অ্যানি বেসান্ত ও বালগঙ্গাধর তিলক কে গ্রেফতার
ব্রিটিশ সরকার শ্রীমতী বেসান্ত , বি. পি. ওয়াদিয়া ও জর্জ অরুণ ডালেকে গ্রেফতার করলে ( ১৯১৭ খ্রি. ১৫ জুন ) আন্দোলন অগ্নিগর্ভ হয়ে ওঠে । এই গ্রেফতারের প্রতিবাদে স্যার সুব্রহ্মনিয়াম আয়ার ব্রিটিশের দেওয়া নাইট উপাধি ত্যাগ করেন । এরপর তিলককেও গ্রেফতার করা হলে ( ১৯১৭ খ্রি. ২৩ জুলাই ) হােমরুল আন্দোলন তীব্র রূপ ধারণ করে । আন্দোলনের তীব্রতায় ব্রিটিশ বাধ্য হয়ে হােমরুল পন্থীদের মুক্তি দেয় ।
হোমরুল আন্দোলনের সমাপ্তি
গান্ধিজির পরিচালনায় অসহযােগ সত্যাগ্রহ শুরু হলে হােমরুল আন্দোলন ক্রমশই ম্রিয়মান হয়ে পড়ে । হােমরুল পন্থীরা অনেকেই গান্ধিজির অসহযােগ আন্দোলনে যােগ দেন । তিলকের মৃত্যুর পর হােমরুল আন্দোলন অসহযােগ আন্দোলনের মূলধারার সঙ্গে মিশে যায় । জুডিথ ব্রাউনের মতে , গান্ধিজির মুখ্য অনুচর ছিল হােমরুল পন্থীরা ।
হোমরুল লীগ আন্দোলনের গুরুত্ব
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রভাবে ভারতের রাজনীতিতে সাময়িকভাবে যে শূন্যতার সৃষ্টি হয়েছিল , তার অনেকটাই পূরণ করে দিতে পেরেছিল হােমরুল লীগ আন্দোলন ।
গণজাগরণে :
হােমরুল আন্দোলন সারা দেশজুড়ে গণজাগরণ ঘটায় ।
স্বশাসনের দাবি পেশে :
হােমরুল আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে স্বশাসনের দাবি আরও জোরদার হয় ।
চরমপন্থীদের পুনঃপ্রতিষ্ঠায় :
হােমরুল আন্দোলনের মাধ্যমে জাতীয় কংগ্রেসে চরমপন্থীদের পুনঃপ্রতিষ্ঠা ঘটে ।
Very Nice post.