দক্ষিণ আফ্রিকায় মহাত্মা গান্ধীর রাজনৈতিক জীবন
Contents
দক্ষিণ আফ্রিকায় মহাত্মা গান্ধীর রাজনৈতিক জীবন
জাতির জনক মােহনদাস করমচাঁদ গান্ধীর রাজনৈতিক জীবন দুটি পর্বে বিভক্ত । তাঁর রাজনৈতিক জীবনের সুদীর্ঘ ২১ বছর দক্ষিণ আফ্রিকাতেই কাটে । দক্ষিণ আফ্রিকায় গান্ধীজী তাঁর অহিংস সত্যাগ্রহের দ্বারা শ্বেতাঙ্গদের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তােলেন এবং সফল হন । এ প্রসঙ্গে এস. আর. মেহরােত্রা ‘ Towards India’s Freedom and Partitions ‘ গ্রন্থে বলেছেন দক্ষিণ আফ্রিকায় ভারতীয়দের সংগ্রামের ফলে ভারতীয় জাতীয় আন্দোলন উপহার হিসেবে পেয়েছে খােদ গান্ধীজীকে ( ‘ The greatest gift of the Indian Struggle in South Africa to the Indian national movement was Gandhi himself ‘ ) ।

দক্ষিণ আফ্রিকা গমন
গান্ধীজী ইংল্যান্ড থেকে ব্যারিস্টারি পাস করে ভারতে ফিরে আসেন ( ১৮৯১ খ্রি. ) , কিন্তু প্রতিষ্ঠিত ব্যারিস্টার রূপে সুনাম অর্জনে দক্ষিণ আফ্রিকায় গান্ধীজী ব্যর্থ হন । এর দুবছর পর তিনি দাদা আবদুল্লা নামে এক গুজরাতি ব্যবসায়ীর হয়ে মামলা লড়ার জন্য দক্ষিণ আফ্রিকায় যান ( ১৮৯৩ খ্রি. জানুয়ারি ) । সেসময় দক্ষিণ আফ্রিকায় শ্বেতাঙ্গ সরকারের বর্ণ বৈষম্য নীতির শিকার ছিলেন অনাবাসী ভারতীয়রা । গান্ধীজী নিজেও দক্ষিণ আফ্রিকার ডারবান বন্দরে নেমেই বর্ণ বৈষম্যের শিকার হন । বাধ্য হয়ে ঘােড়ার গাড়িতে আরােহণ করতে চাইলে , গাড়ির চালকের হাতেও গান্ধীজী নিগৃহীত হন।
বর্ণবিদ্বেষ দূর করার শপথ
দক্ষিণ আফ্রিকায় গান্ধীজী প্রথমে ট্রেনে ও পরে ঘােড়ার গাড়িতে নিগৃহীত হওয়ায় বর্ণবিদ্বেষ দূর করার শপথ নেন । তিনি এর এক সপ্তাহের মধ্যেই প্রিটোরিয়ায় সকল ভারতীয়দের নিয়ে একটি সভা ডাকেন । জীবনের প্রথম বক্তৃতায় ভারতীয় নাগরিকদের কাছে চারটি আবেদন রাখেন—
1. সত্য কথা বলতে হবে ,
2. পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকতে হবে ,
3. ধর্ম ও জাতিভেদ ভুলতে হবে ,
4. ইংরেজি শিখতে হবে । এরপর একের পর এক সভার মাধ্যমে গান্ধীজী দক্ষিণ আফ্রিকার দীনদুঃখী কালাে মানুষদের কাছের মানুষ হয়ে উঠলেন ।
গান্ধীজীর প্রতিবাদ আন্দোলন
দক্ষিণ আফ্রিকায় গান্ধীজী নাটাল সুপ্রিমকোর্টে ব্যারিস্টার রুপে কাজ শুরু করলেন । এক বছর পর তিনি ছয় মাসের জন্য ভারতে এসে পুনরায় আফ্রিকায় ফিরে গেলেন । এই স্বল্প সময়কালে তিনি দক্ষিণ আফ্রিকার কালাে মানুষদের ওপর শ্বেতাঙ্গদের অত্যাচারের কাহিনি গােটা ভারত জুড়ে প্রচার করেন , ফলে ক্ষিপ্ত শ্বেতাঙ্গ সরকার যে জাহাজে করে গান্ধীজী আসছিলেন সেই জাহাজটিকে ডারবান বন্দরে ঢুকতে দিল না । প্রায় দু – মাস জাহাজটি বন্দর থেকে দূরে দাঁড়িয়েছিল । অবশেষে জাহাজটি তীরে এনে গান্ধীজীকে শারীরিক আক্রমণ করা হল । কিন্তু তাতেও তিনি দমে যাননি ।
দক্ষিণ আফ্রিকায় রাজনৈতিক জীবন
প্রথম পর্যায় :
দক্ষিণ আফ্রিকায় বসবাসকারী ভারতীয়দের জন্য গান্ধীজীর নেতৃত্বে শুরু হয় রাজনৈতিক সংগ্রামের প্রথম পর্ব ( ১৮৯৪-১৯০৬ খ্রি. ) ।
প্রবাসী ভারতীয়দের ঐক্যবদ্ধ করেন : গান্ধীজী প্রথমেই প্রবাসী ভারতীয়দের ঐক্যবদ্ধ করে তাদের দাবিগুলিকে দক্ষিণ আফ্রিকার শ্বেতাঙ্গ সরকারের সামনে তুলে ধরার চেষ্টা করেন । এই লক্ষ্যে তিনি ভারতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠা করেন ও ‘ ইন্ডিয়ান ওপিনিয়ান ’ নামে এক পত্রিকা প্রকাশ করেন ।
শ্বেতাঙ্গ সরকারের বিরােধিতা : গান্ধীজীর অদম্য জেদের কাছে হার মেনে শ্বেতাঙ্গ সরকার ভারতীয়দের সমান ভােটাধিকার দিতে বাধ্য হয় । কিন্তু কিছু দিনের মধ্যেই ভােটাধিকার তুলে দিয়ে ভারতীয়দের ওপর তিন পাউন্ড কর চাপানাে হয় । গান্ধীজী এর বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ করলেন ।
দ্বিতীয় পর্যায় :
রেজিস্ট্রেশনের বিরােধিতা : বুঁয়র যুদ্ধ ( ১৮৯৮ খ্রি. ) ও জুলু বিদ্রোহের সময় ( ১৯০৬ খ্রি. ) দক্ষিণ আফ্রিকার প্রিটোরিয়া সরকারের প্রতি গান্ধীজী কঠোর ছিলেন না । কিন্তু যখন প্রতিটি ভারতীয়কে আঙুলের ছাপসহ বাধ্যতামূলকভাবে রেজিস্ট্রেশন সার্টিফিকেট রাখতে হবে বলে ঘােষণা করা হল সেদিন থেকেই গান্ধীজী দক্ষিণ আফ্রিকায় শ্বেতাঙ্গ সরকারের প্রতি ক্ষুব্ধ হন । এ ছাড়া ট্রান্সভালে ভারতীয়দের প্রবেশ নিষিদ্ধ হলে গান্ধীজী আন্দোলন গড়ে তােলেন । শ্বেতাঙ্গ সরকার গান্ধীজীকে জেলে পাঠায় এবং জেলের মধ্যে তাঁকে অন্যান্য কয়েদিদের মতােই পাথর ভাঙতে বাধ্য করা হয় ।
বিবাহ পদ্ধতির বিরােধিতা : দক্ষিণ আফ্রিকায় খ্রিস্টীয় পদ্ধতি ছাড়া অন্য কোনাে পদ্ধতিতে বিবাহ অবৈধ ছিল । গান্ধীজী এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে মহিলাদের নিয়ে সত্যাগ্রহ আন্দোলন গড়ে তােলেন ।
খনি শ্রমিকদের স্বার্থরক্ষা : গান্ধীজী দক্ষিণ আফ্রিকার নিউক্যাসেলে শ্বেতাঙ্গ সরকারের বিরুদ্ধে খনি শ্রমিকদের সংগঠিত করে ধর্মঘট ডাকেন । অবশেষে আন্দোলনের চাপে সরকার ‘ ইন্ডিয়ান রিলিফ আইন ’ ( ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দ ) পাস করালে দক্ষিণ আফ্রিকায় সত্যাগ্রহ আন্দোলনের অবসান ঘটে ।
গান্ধীজীর আন্দোলনের তাৎপর্য
দক্ষিণ আফ্রিকায় গান্ধীজীর রাজনৈতিক জীবন ছিল অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ।
প্রবাসী ভারতীয়দের ঐক্যবদ্ধ করা :
জাতি , ধর্ম , বর্ণ , ধনী , দরিদ্র নির্বিশেষে সকল শ্রেণির প্রবাসী ভারতীয়কে গান্ধীজী একজোট করতে পেরেছিলেন ।
ভবিষ্যৎ রাজনীতির আদর্শ :
দক্ষিণ আফ্রিকায় যেভাবে গান্ধীজী ঐক্য গড়ে তুলে আন্দোলনকে শক্তিশালী করেছিলেন , পরবর্তীকালে সেই নীতিই ভারতীয় জাতীয় রাজনীতিতে প্রয়ােগ করেছিলেন । দক্ষিণ আফ্রিকার রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা তাঁর ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক জীবনের পাথেয় হয় ।
সত্যাগ্রহ নীতির প্রতিষ্ঠা :
গান্ধীজী অনুভব করেন যে , অহিংসা ও শান্তিপূর্ণ পদ্ধতিতে আন্দোলন গড়ে তুললে তা একদিন সফল হতে বাধ্য । বিশ্ববাসীর সামনে গান্ধীজী সত্যাগ্রহ নীতির আদর্শ তুলে ধরেন । বিশ্ব রাজনীতিতে তাঁর সত্যাগ্রহ নীতি এক নতুন পথ ও মত হিসেবে স্বীকৃতি পায় ।
আন্তর্জাতিক খ্যাতি লাভ :
দক্ষিণ আফ্রিকায় তাঁর সত্যাগ্রহী আদর্শ জয়লাভ করায় একদিকে যেমন তিনি নেতা হিসেবে আন্তর্জাতিক খ্যাতি লাভ করেন , অন্যদিকে একজন সুদক্ষ সংগঠক , প্রচারক ও নেতারূপে ভারত তথা বিশ্বব্যাপী পরিচিতি লাভ করেন।
ভারতের শীর্ষ নেতৃপদ লাভ :
দক্ষিণ আফ্রিকায় গান্ধীজীর রাজনৈতিক জীবন , নেতা গান্ধীজীর প্লাটফর্ম ছিল বলা চলে । ভারতে ফিরে খুব অল্প সময়েই তিনি জাতীয় আন্দোলনের শীর্ষস্থানীয় নেতার আসন লাভ করেন ।
কৃষ্ণাঙ্গ নেতা হিসেবে সফলতা :
এই প্রথম কোনাে কৃষ্ণাঙ্গ নেতা সত্যাগ্রহ ও অহিংস নীতিতে বর্বর শ্বেতাঙ্গ সরকারের বর্ণবৈষম্য নীতির বিরুদ্ধে আন্দোলন করে সফল হন ।
মূল্যায়ন
দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে ভারতে ফিরে এসে গান্ধীজী ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রথম সারিতে চলে আসেন , তিনিই প্রথম নেতা যিনি বিদেশের রাজনৈতিক অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে ভারতে এসে সহজেই সর্বভারতীয় নেতারূপে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করার সুযােগ পান । ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী গান্ধীজী ১৯১৫ খ্রিস্টাব্দে স্বদেশে ফিরে আসেন ও জাতীয় রাজনীতিতে যােগ দেন । এ প্রসঙ্গে ঐতিহাসিক জুডিথ ব্রাউন বলেছেন — প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সবচেয়ে বড়াে অবদান হল ভারতের রাজনীতিতে গান্ধীজীর যোগদান ( ‘ The first world war transformed Gandhi into a political leader in his native India ‘ )।