ইতিহাস

অসহযোগ আন্দোলনের পটভূমি আলোচনা কর

Contents

অসহযোগ আন্দোলনের পটভূমি আলোচনা কর

Noncooperation movement1922
অসহযোগ আন্দোলন

ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে এক স্বর্ণোজ্জ্বল অধ্যায় হল অসহযােগ আন্দোলন । এই আন্দোলনের সুবাদেই দীর্ঘ পঁয়ত্রিশ বছর পর কংগ্রেস রাজনৈতিক ভিক্ষাবৃত্তি ছেড়ে সরাসরি ব্রিটিশ বিরােধী আন্দোলনে শামিল হয় । এই আন্দোলন ছিল ‘ স্বরাজ ’ অর্জনের লক্ষ্যে এক সর্বভারতীয় গণ অভ্যুত্থান । কংগ্রেসের শীর্ষ নেতা আচার্য জে. বি. কৃপালনি  বলেছেন — অসহযােগ আন্দোলন কংগ্রেস ও জাতীয় ইতিহাসে এক নব যুগের সূচনা করে ( ‘ This opened a new chapter in the history of the Congress and the nation ‘ ) । অহিংস অসহযােগ আন্দোলনের পটভূমি বিশ্লেষণে দেখা যায় — 

স্বায়ত্তশাসন অর্জনে ব্যর্থতা 

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে ব্রিটিশের স্বায়ত্তশাসন দান প্রতিশ্রুতির বিনিময়ে যুদ্ধ তহবিল গঠনের লক্ষ্যে ভারতবাসী ৬ কোটি ২১ লক্ষ পাউন্ড চাঁদা দেয় । প্রায় সাড়ে বারাে লক্ষ ভারতীয় সেনা ইংরেজদের হয়ে বিশ্বযুদ্ধে যােগ দেয় , বিভিন্ন রণাঙ্গনে প্রায় ১০ হাজার ভারতীয় সেনা আত্মবিসর্জন দেয় । যুদ্ধ শেষে ভারতবাসী আশা করেছিল যুদ্ধান্তে তাদের স্বায়ত্তশাসন দেওয়া হবে , কিন্তু যুদ্ধের অবসানে দেওয়া হল ‘ মন্টেগু চেমসফোর্ড শাসন সংস্কার ’ যা ভারতীয়দের কাছে ছিল ‘ তুচ্ছ , বিরক্তিকর ও নৈরাশ্যজনক ’ । এর ফলেই ক্ষুদ্ধ ভারতবাসী এক গণ আন্দোলনের পথ বেছে নিয়েছিল । 

আর্থিক সমস্যা 

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শেষে নিত্যপ্রয়ােজনীয় জিনিস থেকে শুরু করে প্রতিটি পণ্যের দাম বহুগুণ বেড়ে যায় । মুদ্রাস্ফীতি ও দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি সাধারণ ভারতবাসীকে জেরবার করে তােলে । ১৯১১ খ্রিস্টাব্দে একজোড়া ধুতির দাম ছিল যেখানে এক টাকা বারাে আনা , সেখানে ছয় বছর পর তার দাম বেড়ে হয় ছয় টাকা । মােটা চাল , গম , বাজরা , লবণ , কেরােসিন , কাপড় প্রভৃতি নিত্যপ্রয়ােজনীয় জিনিসপত্রের দাম অনেকটাই বেড়ে যাওয়ায় তার সুযােগ নেয় ফাটকাবাজ ও কালােবাজারিরা । খাদ্যদ্রব্যের দাম ৮০ থেকে ১০০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছিল । এই আর্থিক সংকট থেকে মুক্তির লক্ষ্যে ভারতবাসী ব্রিটিশ বিরােধী গণ আন্দোলনের তাগিদ অনুভব করে । 

কুখ্যাত রাওলাট আইন 

ব্রিটিশ সরকার কুখ্যাত রাওলাট আইন পাস ( ১৯১৯ খ্রি. ১৮ মার্চ ) করিয়ে ভারতবাসীর ব্যক্তি স্বাধীনতা ও ন্যায় বিচারের অধিকার কেড়ে নিতে চেয়েছিল । রাওলাট আইনের প্রতিবাদেই গান্ধিজি সত্যাগ্রহের ডাক দেন । যার পরিণতিতে জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের মতাে নিষ্ঠুর ঘটনা ঘটে । এই আইন যে অসহযােগ আন্দোলনের পটভূমি রচনায় সাহায্য করেছিল সে কথা মেনে সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়A Nation in Making ‘ গ্রন্থে বলেছেন রাওলাট আইন ছিল অসহযােগ আন্দোলনের জনক ( ‘ The Rowlatt Act was the parent of the Non – co – operation Movement ‘ ) । 

জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ড 

কুখ্যাত রাওলাট আইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানাের জন্য পাঞ্জাবের অমৃতসর জেলার জালিয়ানওয়ালাবাগ নামক এক উদ্যানে শান্তিপূর্ণ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয় । জেনারেল ডায়ার ও তার নিষ্ঠুর সেনাবাহিনী হঠাৎ সেখানে হাজির হয়ে সমাবেশে উপস্থিত নিরীহ মানুষদের ওপর ১৬০০ রাউন্ড গুলি চালায় । এতে সরকারি হিসেবে ৩৭৯ জন নিহত ও ১২০০ জন আহত হয় । ব্রিটিশের এই ঘৃণ্য কাজের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে রবীন্দ্রনাথ ব্রিটিশের দেওয়া ‘ নাইট ’ উপাধি ঘৃণাভরে ত্যাগ করেন । গান্ধিজি ইয়ং ইন্ডিয়া পত্রিকায় তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে লেখেন — এই শয়তান সরকারের সংশােধন অসম্ভব , একে ধ্বংস করতেই হবে ( ‘ This satanic government cannot be mended , it must be ended ’)।

খিলাফত সমস্যা

গান্ধিজি চেয়েছিলেন খিলাফত সমস্যাকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা আন্দোলনকে জাতীয় আন্দোলনের মূলধারার সঙ্গে মিশিয়ে দিতে । এতে একদিকে যেমন ব্রিটিশ বিরােধী জাতীয় আন্দোলন শক্তিশালী ও তীব্র হয়ে উঠবে , অপরদিকে তেমন ব্রিটিশ সরকারের হিন্দু – মুসলিম বিভেদের প্রচেষ্টা ব্যর্থ হবে । তাই তিনি কংগ্রেসের সাংগঠনিক শক্তি ও ইসলামের আবেগকে মিশিয়ে এক সর্বভারতীয় গণ আন্দোলন গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন । গান্ধিজি  মনে করতেন — খিলাফৎ ও অসহযােগের মিলনে ব্রিটিশ প্রশাসনকে জোর ধাক্কা দেওয়া সম্ভব হবে । তিনি বলেছিলেন — হিন্দু – মুসলিম ঐক্যের এমন সুযােগ একশাে বছরেও আর আসবে না । 

শ্রমিকদের দুর্দশা 

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ব্যাপক ভাবে শিল্প কারখানাগুলিতে শ্রমিক ছাঁটাই শুরু হয় । এমনিতেই শ্রমিকদের কম মজুরি , বাসস্থানের অভাব , কাজের সময়সীমা , কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা ইত্যাদি ব্যাপারে ক্ষোভ ছিল । এর ওপর শ্রমিক ছাঁটাই শুরু হলে তারা ধর্মঘট করে । সুমিত সরকারের  মতে — অসহযােগ চলাকালীন মােট ৪০০ টি শ্রমিক ধর্মঘট হয় । জীবন ধারণের জন্য প্রয়ােজনীয় খাদ্যের দাম শতকরা ১০০ ভাগ বাড়লেও শ্রমিকদের মজুরি শতকরা ১৫ ভাগের বেশি বাড়েনি । 

কৃষকদের দুরবস্থা 

যুদ্ধজনিত কারণে ভারতীয় অর্থনীতি দুর্বল হয়ে পড়লে , তাকে চাঙ্গা করার লক্ষ্যে ব্রিটিশ ভূমি রাজস্বের হার বাড়ায় । ভূমি রাজস্বের এই হার বৃদ্ধির জন্য সব থেকে বেশি মাশুল দিতে হয় কৃষক সম্প্রদায়কে । কৃষিজাত পণ্যের দাম না বাড়ায় কৃষকরা তাদের উৎপাদিত ফসল বিক্রয় করে লাভ পেত না । অনেক ক্ষেত্রে কৃষকদের অত্যন্ত কম দামে মহাজনদের কাছে কৃষিজাত দ্রব্য বিক্রয় করতে হত , কিন্তু বেশি দাম দিয়ে নিত্য প্রয়ােজনীয় দ্রব্য কিনতে হত । লুই ফিশার  তাঁর ‘ The Life of Mahatma Gandhi ‘ গ্রন্থে লেখেন রাজনৈতিক নেতা থেকে শুরু করে চাষিরা পর্যন্ত যুদ্ধে ভারতীয়দের রক্তপাতের ক্ষতিপূরণ দাবি করেছিলেন । 

দেশীয় শিল্প উদ্যোগে বাধা

প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অর্থ সংকট তীব্র হওয়ায় আমজনতার পক্ষে শিল্পজাত পণ্য কেনার ক্ষমতা কমে যায় । এ সময় নানা কারণে দেশীয় শিল্পক্ষেত্রগুলিতে মন্দা দেখা দেয় । যুদ্ধের পর থেকেই ব্রিটিশ সরকার দেশীয় শিল্পোদ্যোগকে ধ্বংস করার জন্য সচেষ্ট হয়ে ওঠে । দেখা যায় তৎকালীন ভারত-সচিব মর্লে  মাদ্রাজে অ্যালুমিনিয়াম শিল্পোদ্যোগকে আটকানাের গােপন নির্দেশ দেন বা ভদ্রাবতী লৌহ প্রকল্প ও কৃষ্ণসার সাগর বাঁধ নির্মাণ পরিকল্পনা রুপায়ণে নিয়ােজিত বিশ্বেশ্বরাইয়া ( মহীশূরের দেওয়ান ) -কে পদচ্যুত করা হয় ।

সমকালীন আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি 

সমকালীন আন্তর্জাতিক আঙিনায় রুশ বিপ্লব , আয়ার্ল্যান্ডে মাইকেল কলিন্সের নেতৃত্বে গেরিলা যুদ্ধ , ডি. ডেলেরার সিনফিন আন্দোলন , জগলুল পাশার নেতৃত্বে মিশরে তীব্র ব্রিটিশ বিরােধী আন্দোলন , তুরস্কে কামাল পাশার নেতৃত্বে গণসংগ্রাম ভারতের কংগ্রেসি শীর্ষ নেতৃবৃন্দকে উদ্বুদ্ধ করে । মন্টেগু চেমসফোর্ড রিপাের্টে বলা হয় রুশ বিপ্লব স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে এক বিজয়রূপেই চিহ্নিত হয়েছিল — এটি ভারতের রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষায় অনেক ক্ষেত্রে প্রেরণা জুগিয়েছিল ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!