ইতিহাস

ভারতে বৈপ্লবিক জাতীয়তাবাদী আন্দোলন

Contents

ভারতে বৈপ্লবিক জাতীয়তাবাদী আন্দোলন

index 1
রাসবিহারী বসু

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে ভারতীয় জাতীয়তাবাদী রাজনীতিতে গভীর শূন্যতা নেমে আসে । জাতীয় রাজনীতির মূল নিয়ন্ত্রক জাতীয় কংগ্রেস এসময়ে অনেকটাই নিষ্প্রভ ছিল । এ সময়ে ভারতের বিভিন্ন অংশে বিক্ষিপ্ত ভাবে বৈপ্লবিক জাতীয়তাবাদী কার্যকলাপ শুরু হয় । ভারতীয় বিপ্লবীদের অনেকেই এ সময়ে জার্মানিসহ ব্রিটিশের শত্রু দেশগুলির সঙ্গে হাত মিলিয়ে ভারতের স্বাধীনতা অর্জনে সচেষ্ট হয় । 

রাসবিহারীর নেতৃত্বে সশস্ত্র অভ্যুত্থানের প্রচেষ্টা 

পাঞ্জাবের বিপ্লবীদের নিয়ে রাসবিহারী বসু একটি শক্তিশালী গােষ্ঠী গড়ে তােলেন । তাঁর মূল উদ্দেশ্য ছিল — সেনাবাহিনীর মধ্যে বিদ্রোহের আদর্শ প্রচার করে ভারতব্যাপী সশস্ত্র অভ্যুত্থান দ্বারা মাতৃভূমির মুক্তি অর্জন । তাঁর পরিকল্পনামাফিক ‘ গদর ’ দলের বিপ্লবীরা ভারতীয় সেনাবাহিনীর বিভিন্ন ক্যান্টনমেন্টের বেশ কিছু সেনাকে টানতে সক্ষম হন । স্থির হয় ১৯১৫ খ্রিস্টাব্দের ২১ ফেব্রুয়ারি সারা দেশে একসঙ্গে ব্রিটিশ বিরােধী গণ অভ্যুত্থানের সূচনা হবে । কিন্তু এই পরিকল্পনা ব্যর্থ হয় । বহু বিপ্লবীকে গ্রেপ্তার করা হয় । বন্দি বিপ্লবীদের নিয়ে শুরু হয় লাহাের ষড়যন্ত্র মামলারাসবিহারী বসু কলকাতা থেকে পি. এন. ঠাকুর  ছদ্মনামে জাপানের পথে পাড়ি দেন ।

বাংলার বিপ্লব প্রচেষ্টা

বুড়িবালামের যুদ্ধ : 

জার্মান সামরিক বিভাগের সাহায্য নিয়ে বাঘাযতীন এর নেতৃত্বে বাংলার বিপ্লবীরা এক সশস্ত্র অভ্যুত্থান ঘটানাের পরিকল্পনা গ্রহণ করেন । বাঘাযতীন জার্মান কনসালের সঙ্গে যােগাযােগ করে তিনটি অস্ত্র ভরতি জাহাজ ভারতে আনার ব্যবস্থা করেন । ‘ হেনরি এস ’ নামক প্রথম জাহাজটি সুন্দরবনের রায়মঙ্গলে এবং ‘ অ্যানি লারসেন ’ নামক দ্বিতীয় জাহাজটি নােয়াখালির কাছে হাতিয়ায় নিয়ে আসার কথা ছিল । প্রথম জাহাজের অস্ত্র দিয়ে পশ্চিমবঙ্গে এবং দ্বিতীয় জাহাজের অস্ত্র দিয়ে পূর্ববঙ্গে বিপ্লব ঘটানাের পরিকল্পনা ছিল । ‘ ম্যাভেরিক ’ নামক তৃতীয় জাহাজটি ওড়িশার বালেশ্বরে আসার কথা ছিল । যতীন্দ্রনাথ তাঁর সঙ্গী চিত্তপ্রিয় , মনােরঞ্জন , নীরেন ও জ্যোতিষকে নিয়ে বালেশ্বরের উদ্দেশ্যে রওনা দেন । তাঁরা ওড়িশায় কাপ্তিপগা অঞ্চলে বুড়িবালাম নদীর তীরে উপস্থিত হন । বিপ্লবীদের উপস্থিতি জানতে পেরে এক বিশাল পুলিশ বাহিনী সেখানে হাজির হয় । বিপ্লবী ও পুলিশের মধ্যে খণ্ডযুদ্ধ বাধে । বাঘাযতীন ও চিত্তপ্রিয় নিহত হন । নীরেন ও মনােরঞ্জনের ফাঁসি এবং জ্যোতিষের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয় । 

মাস্টারদা ও তার সহযোগীদের বিপ্লব প্রচেষ্টা :

1. মাস্টারদা সূর্য সেন চট্টগ্রামে ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মি গড়ে তােলেন । ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দের ১৮ এপ্রিল মাস্টারদা ও তাঁর সহযােগী অনন্ত সিংহ , নির্মল সেন , গণেশ ঘােষ , লােকনাথ বল প্রমুখ বিপ্লবী চট্টগ্রামের ব্রিটিশ অস্ত্রাগার লুঠ করেন ও চট্টগ্রামে ‘ ভারতের অস্থায়ী স্বাধীন সরকার ’ স্থাপন করেন । 

2. সূর্য সেনের পরিচালনায় ৫৭ জন বিপ্লবী নিকটবর্তী জালালাবাদ পাহাড়ে আশ্রয় গ্রহণ করেন । খবর পেয়ে ব্রিটিশ সেনাবাহিনী তাদের ঘিরে ফেললে শুরু হয় জালালাবাদের মুক্তিযুদ্ধ । এই যুদ্ধে ৬৪ জন ব্রিটিশ সেনা নিহত হয় ও ১১ জন বিপ্লবী শহিদ হন । 

3. জালালাবাদের যুদ্ধের পর ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মির বিপ্লবীরা কর্ণফুলি নদীর তীরে ইংরেজ কর্মচারীদের বাসস্থানগুলি আক্রমণের সংকল্প নেন । এই উদ্দেশ্যে তাঁরা চট্টগ্রামে সমবেত হন । কর্ণফুলি নদীর তীরে ছয়জন সশস্ত্র বিপ্লবী ব্রিটিশ পুলিশের বিরুদ্ধে সরাসরি যুদ্ধে লিপ্ত হন ও তাতে চারজন বিপ্লবী নিহত হন । মাস্টারদার নির্দেশে প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের নেতৃত্বে বিপ্লবীরা ইউরােপিয়ান ক্লাব আক্রমণ করেন । এতে একজন সাহেব নিহত ও বহু শ্বেতাঙ্গ আহত হয় । প্রীতিলতা পটাশিয়াম সায়ানাইড খেয়ে আত্মাহুতি দেন ।

বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স এর কার্যকলাপ :

ঢাকায় বিপ্লবী হেমচন্দ্র ঘােষের নেতৃত্বে বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স ( বি. ভি. ) দল বিপ্লবী আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা নেয় । এই দলের সদস্য বিনয় বসু বাংলা পুলিশের ইন্সপেক্টর জেনারেল লােম্যানকে গুলি করে হত্যা করেন । পরে বিনয় বসু , বাদল গুপ্ত ও দীনেশ গুপ্তের সঙ্গে মিলিত হয়ে রাইটার্স বিল্ডিং আক্রমণ করেন ( ১৯৩০ খ্রি. ৮ ডিসেম্বর ) । তাঁদের মিলিত আক্রমণে কারাবিভাগের অধিকর্তা সিম্পসন নিহত হন এবং একাধিক উচ্চপদস্থ আমলা আহত হন । লালবাজার থেকে আসা বিশাল পুলিশবাহিনীর সঙ্গে তাঁদের অলিন্দ যুদ্ধ বাঁধে । বাদল ও বিনয় আত্মহত্যা করেন , দীনেশের ফাঁসি হয় । এরপর বি. ভি. – র সদস্য বিমল দাশগুপ্ত ও জ্যোতিজীবন ঘােষ মেদিনীপুরের জেলাশাসক পেডিকে ( ১৯০১ খ্রি. ) , প্রদ্যোত ভট্টাচার্য জেলাশাসক ডগলাসকে ( ১৯৩২ খ্রি. ) , অনাথ পাঁজা ও মৃগেন দত্ত জেলাশাসক বার্জকে হত্যা করেন ( ১৯৩৩ খ্রি. ) । 

বাংলায় অন্যান্য বিপ্লব প্রচেষ্টা : 

চট্টগ্রাম পুলিশের ডেপুটি সুপারিনটেন্ডেন্ট আসানুল্লাকে গুলি করে হত্যা করেন ( ১৯৩১ খ্রি. ৩০ আগস্ট ) হরিপদ ভট্টাচার্য । অষ্টম শ্রেণির দুই ছাত্রী শান্তি ঘােষ ও সুনীতি চৌধুরি কুমিল্লার জেলা – ম্যাজিস্ট্রেট স্টিভেন্সকে গুলি করে হত্যা করে ( ১৯৩১ খ্রি. ১৪ ডিসেম্বর ) । সুভাষচন্দ্রের বাল্য শিক্ষক বেণিমাধব দাসের কনিষ্ঠা কন্যা বীণা দাস কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে গভর্নর স্ট্যানলি জ্যাকসনকে গুলি করেন । কিন্তু তিনি লক্ষ্যভ্রষ্ট হন এবং নয় বছর সশ্রম কারাদণ্ডের শাস্তি পান । 

হিন্দুস্তান রিপাবলিকান অ্যাসোসিয়েশন এর প্রচেষ্টা :

বাংলার বিপ্লবী যােগেশচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এবং উত্তরপ্রদেশের বিপ্লবী শচীন্দ্রনাথ সান্যালের উদ্যোগে উত্তরপ্রদেশে প্রতিষ্ঠিত হয় হিন্দুস্থান রিপাবলিকান অ্যাসােসিয়েশন ( ১৯২৩ খ্রি. ) । বিহারে ফণীন্দ্রনাথ ঘােষ ও পাঞ্জাবে সুখদেব এই দলের মূল কার্যভার গ্রহণ করেন । বিপ্লবের কাজে অর্থ জোগাড়ের লক্ষ্যে এই দল লক্ষ্ণৌ রেলস্টেশনের কাছে কাকোরি স্টেশনে রেলডাকাতি করে ( ১৯২৫ খ্রি. ৯ আগস্ট ) । এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ৪৪ জন বিপ্লবীকে গ্রেপ্তার করা হয় । শুরু হয় কাকোরি ষড়যন্ত্র মামলা । মামলার রায়ে বেশ কিছু নেতার প্রাণদণ্ড এবং কারাদণ্ড হয় । 

হিন্দুস্তান সোস্যালিস্ট রিপাবলিকান অ্যাসোসিয়েশন এর প্রচেষ্টা

স্যান্ডার্স হত্যা :

হিন্দুস্থান রিপাবলিকান অ্যাসােসিয়েশনের পরিণতিতে ভেঙে না পড়ে চন্দ্রশেখর আজাদ তাঁর সহযােগী বিপ্লবীদের নিয়ে গঠন করেন হিন্দুস্থান সােস্যালিস্ট রিপাবলিকান অ্যাসােসিয়েশন ( ১৯২৮ খ্রি. ৮ সেপ্টেম্বর ) । ভগৎ সিং এই বিপ্লবী দলটির নামকরণ করেন । সমাজতান্ত্রিক আদর্শে প্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠন করাই ছিল এই দলের মূল উদ্দেশ্য । লালা লাজপত রায়ের মৃত্যুর প্রতিশােধ নেওয়ার জন্য ভগৎ সিং সহকারী পুলিশ সুপারিনটেন্ডেন্ট মিস্টার স্যার্ন্ডাসকে গুলি করে হত্যা করেন ( ১৯২৮ খ্রি. ১৭ ডিসেম্বর ) । 

কেন্দ্রীয় আইন সভায় বোমা নিক্ষেপ :

শিল্প বিরােধ বিল ও জননিরাপত্তা বিল নিয়ে কেন্দ্রীয় আইন সভায় আলােচনা চলাকালীন ভগৎ সিং ও বটুকেশ্বর দত্ত দর্শকের আসন থেকে দুটি বােমা ছােড়েন ( ১৯২৯ খ্রি. ৮ এপ্রিল ) । এরপর তাঁরা স্বেচ্ছায় ধরা দেন । এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে শুরু হয় লাহাের ষড়যন্ত্র মামলা । মামলা চলাকালীন বিচারাধীন বন্দিদের ওপর পুলিশি নির্যাতনের প্রতিবাদে যতীন দাস একটানা ৬৪ দিন অনশন চালিয়ে লাহাের জেলে প্রাণত্যাগ করেন । লাহাের ষড়যন্ত্র মামলার রায়ে ভগৎ সিং , সুখদেব , রাজগুরুর ফাঁসি হয় । 

উপসংহার 

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় বিপ্লবীদের দমনের লক্ষ্যে যে ভারত রক্ষা আইন প্রবর্তিত হয় , যুদ্ধ শেষে সেই আইনে ধৃত সব বন্দিকে মুক্তি দেওয়া হয় । এইসব বিপ্লবীরা অসহযােগ আন্দোলনে যােগ দেয় । কিন্তু অসহযােগ আন্দোলন ব্যর্থ হলে নতুন উদ্যমে তারা বিপ্লবী কার্যকলাপ শুরু করে ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!