বাংলায় সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলন
Contents
বাংলায় সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলন
অহিংস অসহযােগ আন্দোলন তার লক্ষ্যে পৌঁছােবার আগেই প্রত্যাহূত হয়ে গেলে বাংলা ও উত্তর ভারতে বৈপ্লবিক প্রচেষ্টা আবার সক্রিয় হয়ে ওঠে । তবে এবারের বৈপ্লবিক প্রচেষ্টার সঙ্গে পূর্ববর্তী প্রচেষ্টার কৌশলগত ও চরিত্রগত পার্থক্য ছিল সুস্পষ্ট । ব্যক্তিগত সন্ত্রাসবাদী প্রচেষ্টার পথে না গিয়ে , বিপ্লবীরা সমষ্টিগত ভাবে ব্যাপক সশস্ত্র সংগ্রামের কার্যপদ্ধতি গ্রহণ করেন । এই সময় থেকেই বিপ্লবীরা সমাজতান্ত্রিক ভাবধারায় অনুপ্রাণিত হতে শুরু করেন ।

বৈপ্লবিক কার্যকলাপের পুনরুভ্যুদয়
বাংলার বৈপ্লবিক তৎপরতা পুনরায় শুরু হয় ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দে । অনুশীলন ও যুগান্তর দলের পুনর্জাগরণ হয় । জুলাই মাসের ( ১৯২৩ খ্রি. ) শেষদিকে লাল বাংলা নামে এক প্রচারপত্র গােপনে বিলি করে প্রতিক্রিয়াশীল পুলিশ কর্মচারীদের হত্যার কথা বলা হয় । কলকাতার কুখ্যাত পুলিশ কমিশনার চার্লস টেগার্ট – কে হত্যা করতে গিয়ে ভুলক্রমে তারই মতাে দেখতে আর্নেস্ট ডে নামে এক ইংরেজকে হত্যার দায়ে তরুণ বিপ্লবী গােপীনাথ সাহার ফাঁসি হয় ( ১ মার্চ , ১৯২৪ খ্রি. ) । সূর্য সেন চট্টগ্রামে ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মি নামে একটি সামরিক স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গড়ে তােলেন । ডিসেম্বর মাসে ( ১৯২৮ খ্রি. ) এই বাহিনী চট্টগ্রামের ‘ আসাম বেঙ্গল রেলওয়ে’র অফিস থেকে ৭৭ হাজার টাকা লুঠ করে ।
সরকারি দমননীতি
ক্রমবর্ধমান এই বিপ্লবী কার্যকলাপ দমনের উদ্দেশ্যে ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দের অক্টোবর মাসে সরকার একটি অর্ডিন্যান্সবলে বিনা পরােয়ানায় যে – কোনাে বাড়ি তল্লাশি ও বিনা বিচারে যে – কোনাে ব্যক্তিকে গ্রেফতার করার ক্ষমতা লাভ করে । এই আইনবলে বিশিষ্ট নেতা-সহ বহু ব্যক্তিকে সন্ত্রাসবাদের নামে গ্রেফতার করা হয় । উল্লেখ্য , সুভাষচন্দ্রকেও এই সময় গ্রেফতার করা হয় ।
সরকারি মামলা
দক্ষিণেশ্বর বােমা মামলায় ( ১৯২৫ খ্রি. ) অভিযুক্ত একদল বিপ্লবী কারাগারের মধ্যেই গােয়েন্দা পুলিশের স্পেশাল সুপারিন্টেনডেন্ট রায়বাহাদুর ভূপেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়কে হত্যা করলে অনন্তহরি মিত্র ও প্রমােদরঞ্জন চৌধুরীর প্রাণদণ্ড হয় ( ১৯২৬ খ্রি. ) । এরপর মেছুয়া বাজার বােমার মামলা নামে আর একটি মামলায় বেশ কিছু বিপ্লবীর বিভিন্ন মেয়াদের কারাদণ্ড হয় ।
চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন
এই পর্যায়ে বাংলার বিপ্লবী আন্দোলন তুঙ্গে ওঠে আইন অমান্য আন্দোলন শুরু হওয়ার পর এবং সবচেয়ে ব্যাপক সশস্ত্র অভ্যুত্থানটি ঘটে চট্টগ্রামে ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে । সেখানে ১৮ এপ্রিল ( ১৯৩০ খ্রি. ) রাত ১০ টায় সূর্য সেনের নেতৃত্বে দুটি সরকারি অস্ত্রাগার লুষ্ঠিত হয় ; টেলিফোন – টেলিগ্রাফ অফিসের যন্ত্রপাতি ভেঙে ফেলে ও রেললাইন উপড়ে ফেলে সমস্ত রকম যােগাযােগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয় । এই অভিযানে নির্মল সেন , অনন্ত সিংহ , গণেশ ঘােষ , লােকনাথ বল ও অম্বিকা চক্রবর্তী ছিলেন তাঁর সঙ্গী । তারপর চট্টগ্রামে স্বাধীন ভারতের একটি অস্থায়ী সরকার স্থাপন করে বিপ্লবীরা সূর্য সেনকে তার প্রধান অর্থাৎ রাষ্ট্রপতি বলে ঘােষণা করেন ।
জালালাবাদের যুদ্ধ
অবস্থার গুরুত্ব উপলব্ধি করে সূর্য সেন ৫৭ জন বিপ্লবী নিয়ে শহর ছেড়ে নিকটবর্তী জালালাবাদ পাহাড়ে আশ্রয় গ্রহণ করেন । ১৯৩০ খ্রি. ২২ এপ্রিল ব্রিটিশ সৈন্য জালালাবাদ পাহাড় ঘিরে ফেলে । শেষপর্যন্ত সন্ধ্যা ৫ টা থেকে রাত ৮ টা পর্যন্ত তিন ঘণ্টা অবিরাম যুদ্ধের পর ব্রিটিশ সৈন্য পশ্চাদপসরণ করতে বাধ্য হয়। যুদ্ধে সরকার পক্ষের ৬৪ জন সৈন্য নিহত হয় । অন্যদিকে ১১ জন তরুণ বিপ্লবী শহিদ হন । এঁদের মধ্যে টেগরা বলের বয়স ছিল মাত্র ১৩ বছর ।
অন্যান্য যুদ্ধ ও সূর্য সেনের মৃত্যু
২৪ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বিপ্লবীরা গেরিলা পদ্ধতিতে পর পর কর্ণফুলি নদীর যুদ্ধ , ধলঘাটের যুদ্ধ , পাহাড়তলির সাহেবদের ক্লাব আক্রমণের মধ্যে দিয়ে তাদের সংগ্রাম চালিয়ে যায় । শেষ পর্যন্ত ১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দের ২ ফেব্রুয়ারি এক বিশ্বাসঘাতকের চক্রান্তে সূর্য সেন গ্রেফতার হন । পরের বছর ১৩ জানুয়ারি এই মহান বিপ্লবীর ফাঁসি হয় ( ১৯৩৪ খ্রি. ) ।
ঢাকা – কলকাতা – মেদিনীপুর বিপ্লবী সংঘর্ষ
ঢাকায় :
ঢাকায় বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স – এর সদস্য বিনয়কৃষ্ণ বসু নামে ডাক্তারি পাঠরত এক ছাত্র মিটফোর্ড হাসপাতাল পরিদর্শনে আসা বাংলা পুলিশের গােয়েন্দা বিভাগের প্রধান লােম্যান ও ঢাকার পুলিশ সুপার হডসনকে আক্রমণ করেন ( আগস্ট , ১৯৩০ খ্রি. ) । এই ঘটনায় লােম্যান নিহত হন , তবে হডসন গুরুতর আহত হলেও প্রাণে বেঁচে এরপর বিনয় পালিয়ে আসেন কলকাতায় ।
কলকাতায় :
১৯৩০ খ্রিস্টাব্দের ৮ ডিসেম্বর বিনয় আর দুই বিপ্লবী সহযােগী বাদল ( সুধীর ) গুপ্ত ও দীনেশ গুপ্ত কলকাতায় মহাকরণে অভিযান চালিয়ে কারাবিভাগের প্রধান সিম্পসনকে গুলি করে হত্যা করেন । এই সময় বিপ্লবীদের গুলিতে একাধিক উচ্চপদস্থ আমলা আহত হন । এরপরই শুরু হয় বিশাল পুলিশ বাহিনীর সঙ্গে ওই তিন বিপ্লবীর বিখ্যাত অলিন্দ যুদ্ধ । যুদ্ধ শেষে বাদল বিষপানে আত্মহত্যা করেন এবং নিজেদের গুলিতে গুরুতর আহত অবস্থায় বিনয় ও দীনেশকে হাসপাতালে ভরতি করা হয় । হাসপাতালে বিনয় মারা যান । আর দীনেশ সুস্থ হয়ে উঠলে তাঁকে ফাঁসি দেওয়া হয় । এই সময় ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে ছাত্রী বীণা দাস বাংলার গভর্নর স্ট্যানলি জ্যাকসনকে লক্ষ করে গুলি ছােড়েন । তবে তিনি প্রাণে বেঁচে যান । বিচারে বীণার ৯ বছর সশ্রম কারাদণ্ড হয় ।
মেদিনীপুরে :
মেদিনীপুরে বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স – এর সদস্য জ্যোতি জীবন ঘােষ ও বিমল দাশগুপ্তের গুলিতে পেডি ( ১৯৩১ খ্রি. ) ; প্রদ্যোৎ ভট্টাচার্যের গুলিতে ডগলাস এবং অনাথবন্ধু পাঁজা ও মৃগেন দত্তের গুলিতে বার্জ নামে তিনজন জেলাশাসক নিহত হন । এইসব ঘটনার মধ্য দিয়ে বিপ্লবীরা অসাধারণ সাহস ও অপূর্ব দৃঢ়তার পরিচয় দিয়েছিলেন ।
উপসংহার
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে বাংলার বিপ্লবীরা এইভাবে তাদের দুঃসাহসিক কার্যকলাপ চালিয়ে যান । অসংখ্য চাঞ্চল্যকর ঘটনার মধ্যে দিয়ে একদিকে যেমন বেশ কিছু উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মচারী নিহত হন , অন্যদিকে তেমন বাংলার বহু যুবক যুবতি বিনা বিচারে দীর্ঘকালের জন্য বন্দি , আন্দামানে নির্বাসিত কিংবা প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত হন ।