মাস্টারদা সূর্য সেন স্মরণীয় কেন
Contents
মাস্টারদা সূর্য সেন স্মরণীয় কেন

‘ মৃত্যু কিংবা স্বাধীনতা ’ এই মন্ত্রে বিশ্বাসী ছিলেন চট্টগ্রামের উমাতারা উচ্চ বিদ্যালয়ের গণিত শিক্ষক সূর্যকুমার সেন ( ১৮৯৩-১৯৩৪ খ্রি. ) বা ‘ মাস্টারদা ‘ । একদিকে যখন গান্ধিজির নেতৃত্বে অহিংস গণ আন্দোলন চলছে , তখন ভারতের পূর্বপ্রান্তে চট্টগ্রামে মাস্টারদার নেতৃত্বে সশস্ত্র অভ্যুত্থানের পরিকল্পনা রচিত হয়েছিল । মাস্টারদাই প্রথম তার সহযােগী বিপ্লবীদের নিয়ে গঠন করেন ‘ ভারতীয় অস্থায়ী স্বাধীন সরকার ’ ( ‘ Provisional Independent Government of India ‘ )।
ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মি গঠন
জাতীয় কংগ্রেসের কলকাতা অধিবেশনের শেষে ( ১৯২৮ খ্রি. ) সুভাষচন্দ্রের নেতৃত্বে ২৫০ জন যুবককে নিয়ে গঠিত হয় ‘ স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী ’। বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স ( B.V. ) রূপে এইসব যুবকরা বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে । এদের মধ্যে অন্যতম গণেশ ঘােষ , অনন্ত সিংহ , লােকনাথ বল প্রমুখের সাহায্যে মাস্টারদা গঠন করেন সমরবাহিনী — ‘ ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মি ’। বিভিন্ন ভাবে অস্ত্র , পিস্তল , গুলি , বােমা জোগাড় করা হয় । সংগঠনের খরচ চালানাের জন্য ৫০ হাজার টাকা চাঁদা তােলা হয় । সদস্যদের প্যারেড ও অস্ত্রচালনা শিক্ষা দেওয়ার পাশাপাশি সূর্য সেন দলের এক ইস্তাহারে ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে প্রকাশ্য যুদ্ধ ঘােষণা করেন ( ১৯৩০ খ্রি. ১৮ এপ্রিল ) ।
মাস্টারদা সূর্য সেনের পরিকল্পনা
মাস্টারদা নিজে সশস্ত্র অভ্যুত্থানের ছক রচনা করলেন । সমগ্র পরিকল্পনাটি ছিল এরকম —
1. ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দের ১৮ এপ্রিল রাত্রি ১০ টায় চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন করা হবে ।
2. যুদ্ধের জন্য গঠিত সমর কমিটির সদস্য হবেন — গণেশ ঘােষ , লােকনাথ বল , অনন্ত সিংহ , নির্মল সেন , অম্বিকা চক্রবর্তী , উপেন ভট্টাচার্য , নরেশ রায় , ত্রিগুণা সেন প্রমুখ ।
3. গণেশ ঘােষ ও অনন্ত সিংহের নেতৃত্বে পুলিশের অস্ত্রাগার লুঠ করা হবে ।
4. নির্মল সেন ও লােকনাথ বলের নেতৃত্বে রেলওয়ে আর্মারি ( অস্ত্রাগার ) লুঠ করা হবে ।
5. অম্বিকা চক্রবর্তীর নেতৃত্বে টেলিগ্রাফ ও টেলিফোন এক্সচেঞ্জ আক্রমণ করে যােগাযােগ বিচ্ছিন্ন করা হবে ।
6. নরেশ রায় ও ত্রিগুণা সেনের নেতৃত্বে ইউরােপীয় নাইট ক্লাব আক্রমণ করা হবে ।
চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন
বিভিন্ন ভাগে ভাগ হয়ে চট্টগ্রাম কংগ্রেস অফিস থেকে বেরিয়ে পড়েন বিপ্লবীরা । রাইফেল , পিস্তল , রিভলবার , একটি সুইস বন্দুক ও প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র লুঠপাঠ করে বিপ্লবীরা কাছের জালালাবাদ পাহাড়ে আশ্রয় নেন । বিপ্লবীদের আর একটি দল সমস্ত সরকারি টেলিগ্রাফ ও টেলিফোনের তার কেটে দেয় । রেললাইন উপড়ে ফেলে যােগাযােগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন করা হয় । মাস্টারদা সামরিক কায়দায় ভারতের অস্থায়ী স্বাধীন সরকার প্রতিষ্ঠা করেন ।
জালালাবাদের মুক্তিযুদ্ধ
চট্টগ্রাম বন্দরে বেতারে খবর শুনে পুলিশ চট্টগ্রামে আসে । পুলিশবাহিনী জালালাবাদ পাহাড় ঘিরে ফেলে ( ১৯৩০ খ্রি. ২০ এপ্রিল ) । বিপ্লবীরা তিনদিন না খেয়ে আত্মগােপন করে থাকেন । ২২ এপ্রিল বিকেল ৫ টার পর পুলিশ আক্রমণ শুরু করলে বিপ্লবীরা গেরিলা যুদ্ধ কৌশল অবলম্বন করে মােকাবিলা শুরু করে । রাত্রি ৮ টা পর্যন্ত প্রায় তিন ঘণ্টা গুলি বিনিময়ের পর পুলিশ বাহিনী পিছু হটতে বাধ্য হয় । বিপ্লবীরা ৬৪ জন ব্রিটিশ সৈন্যকে খতম করে । নরেশ রায় , ত্রিগুণা সেন , পুলিন ঘােষ , জিতেন দাশগুপ্ত , মধু দত্ত , মতি কানুনগাে , বিধু ভট্টাচার্য , প্রভাস বল , শশাঙ্ক দত্ত ও তেরাে বছরের কিশাের হরিগােপাল বল ( টেগরা ) শহিদ হন ।
কর্ণফুলী ও ধলঘাটের যুদ্ধ
ছয়জনের একটি সশস্ত্র বিপ্লবী দল কর্ণফুলী নদীর তীরে আশ্রয় নিলে সেখানেও পুলিশের সঙ্গে তাদের সংঘর্ষ বাধে ( ৬ মে , ১৯৩০ খ্রি. ) । এই সংঘর্ষে প্রাণ বিসর্জন দেন মনােরঞ্জন সেন , স্বদেশ রায় , দেবপ্রসাদ গুপ্ত , রজত সেন । ধলঘাটের পাতিয়া গ্রামে মাস্টারদা ও তাঁর সঙ্গীদের ব্রিটিশ সেনারা ঘিরে ফেললে ( ১৩ জুন , ১৯৩০ খ্রি. ) সংঘর্ষে প্রাণ দেন নির্মল সেন ও অপূর্ব সেন ( ভােলা ) । কল্পনা দত্ত ও প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারকে সঙ্গে নিয়ে মাস্টারদা অন্যত্র চলে যান ।
পাহাড়তলী ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণ
পাহাড়তলী ইউরােপীয় ক্লাব আক্রমণ করার কথা ছিল নরেশ রায় ও ত্রিগুণা সেনের দলের । কিন্তু নির্দিষ্ট দিনে রাত্রি ১০ টার আগেই সাহেব – মেমরা ক্লাব ছেড়ে বাড়ি চলে যাওয়ায় ক্লাব আক্রমণের দিন পিছিয়ে দেওয়া হয় । এরপর জালালাবাদের যুদ্ধে নরেশ রায় ও ত্রিগুণা সেন নিহত হলে এই ভার এসে পড়ে প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের ওপর । মাস্টারদার নির্দেশে প্রীতিলতার নেতৃত্বে বিপ্লবীরা ২৪ সেপ্টেম্বর রাত্রি ১০ টায় ক্লাবঘরে হানা দেন । সে সময়ে শ্বেতাঙ্গ পুরুষ ও মহিলারা উদ্দাম নাচ গানে মেতেছিল । হঠাৎ ঘনঘন বুলেটের শব্দে কেঁপে ওঠে ক্লাবঘর । তিন মিনিটের মধ্যে বিপ্লবীরা ১ জনকে নিহত ও ১২ জনকে আহত করে প্রস্থান করে । সবাই চলে গেলেও প্রীতিলতা পালাননি । তিনি পটাশিয়াম সায়ানাইড মুখে দিয়ে মৃত্যুবরণ করেন ।
সূর্যসেনের ফাঁসি
সূর্য সেন গৈলা গ্রামে পূর্ণ তালুকদারের বাড়িতে শান্তি চক্রবর্তী , কল্পনা দত্ত , মানিক দত্তকে নিয়ে আত্মগােপন করে থাকেন । অবশেষে ১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দের ২ ফেব্রুয়ারি রাতে এক বিশ্বাসঘাতকের চক্রান্তে ব্রিটিশের হাতে ধরা পড়েন । বিচারে ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দের ১৩ জানুয়ারি ভাের পাঁচটায় সূর্য সেন ও তারকেশ্বর দস্তিদারের ফাঁসি হয় । মাস্টারদা বলেন , “ এই প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে হয়তাে আমাদের সবাইকে মরতে হবে । কিন্তু এরূপ মহৎ আদর্শের জন্য আমাদের আত্মত্যাগ বিফলে যাবে না । ”
মূল্যায়ন
ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে মাস্টারদার নেতৃত্বে চট্টগ্রামের বিপ্লবী আন্দোলন এক অতি উল্লেখযােগ্য ঘটনা । ভারতে ‘ বিপ্লববাদের ইতিহাসে অভূতপূর্ব ’ এই অভিযানের দুঃসাহসিকতা শীঘ্রই বাংলার বিপ্লবী সংগঠনগুলিকে নতুন করে অনুপ্রাণিত করে তােলে । অনুশীলন সমিতি ও যুগান্তর দল আবার তৎপর হয়ে ওঠে । নরমপন্থী কংগ্রেসি আন্দোলনের দ্বারা যে ভারতকে দ্রুত স্বাধীন করা যাবে না , বিপ্লবীরা এই সত্যে বিশ্বাসী হয়ে উঠেছিল । বন্দুক ও পিস্তলের আগুন বিপ্লবীদের মনের তেজ বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছিল । ড. রমেশচন্দ্র মজুমদারের মতে , “ ইংরেজের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামের প্রথম ভারতীয় সেনাপতি ছিলেন সূর্যসেন এবং শেষ সেনাপতি ছিলেন সুভাষচন্দ্র বসু । ”