আইন অমান্য আন্দোলনের বৈশিষ্ট্য
Contents
আইন অমান্য আন্দোলনের বৈশিষ্ট্য
গান্ধিজির নেতৃত্বে অহিংস নীতি মেনে পরিচালিত আইন অমান্য আন্দোলন ছিল স্বকীয় বৈশিষ্ট্যে সমুজ্জ্বল । এই আন্দোলনের উল্লেখযােগ্য কয়েকটি বৈশিষ্ট্য হলো —

কর্মসূচির অভিনবত্ব
গান্ধিজি লবণ আইন ভঙ্গ কর্মসূচির মধ্যে দিয়ে আইন অমান্য আন্দোলনের সূচনা ঘটান । আসলে গান্ধিজি আইন অমান্য আন্দোলনের সূচনা ঘটাতে চেয়েছিলেন এমন এক কর্মসূচির মধ্যে দিয়ে যা হবে সর্বজনগ্রাহ্য । এক্ষেত্রে লবণ মানুষের খাদ্যের এমন এক উপাদান , যা ধর্ম , বর্ণ , সম্প্রদায় নির্বিশেষে সকলেরই দরকার । তাই লবণ আইন ভঙ্গের মধ্যে দিয়ে আইন অমান্য আন্দোলনের সূচনা করলে সমাজের সকল ধর্ম , বর্ণ ও সম্প্রদায়ের মানুষ নির্দ্বিধায় এই আন্দোলনে যােগ দেবে । এ ছাড়াও গান্ধিজির দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে লবণের মতাে নিত্য প্রয়ােজনীয় খাদ্য দ্রব্যের উপর ব্রিটিশ যে চড়াহারে কর বসিয়েছিল তা প্রত্যাহারের দাবি নিয়ে আন্দোলনের সূচনা ঘটাতে পারলে ধনী দরিদ্র নির্বিশেষে আপামর ভারতবাসী সকলেই এই আন্দোলনে শামিল হবে ।
সুদৃঢ় গণভিত্তি
আইন অমান্য আন্দোলন গণ জাগরণের ভিত নির্মাণ করেছিল বলা চলে । এই আন্দোলন ঘিরে সারা দেশ জুড়ে ব্যাপক উৎসাহ ও উদ্দীপনা দেখা দেয় । ছাত্র , কৃষক , নারী সমাজ , শ্রমিকশ্রেণি , দেশীয় পুঁজিপতি ও বুদ্ধিজীবী গােষ্ঠীসহ সমাজের বিভিন্ন শ্রেণির মানুষ এই আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হন ও গণভিত্তি নির্মাণ করেন । জাতীয়তাবাদী বা সাম্যবাদী উভয় মতাদর্শের মানুষই এই আন্দোলনে শামিল হন । এই আন্দোলনই সর্বপ্রথম আপামর ভারতবাসীকে স্বাধীনতা লাভের দৃঢ় সংকল্প গ্রহণ করতে ও আপসহীন সংগ্রাম গড়ে তুলতে উদ্বুদ্ধ করে । এই আন্দোলনে অসহযােগ আন্দোলনেরও তিনগুণ বেশি ভারতীয় ( ১ লক্ষ ২০ হাজার জন ) কারারুদ্ধ হন । এ থেকে প্রমাণিত হয় যে , আইন অমান্য আন্দোলন ছিল প্রকৃত অর্থেই এক সর্বভারতীয় গণ আন্দোলন ।
নারী সমাজের ব্যাপক অংশগ্রহণ
আইন অমান্য আন্দোলনেই সর্বপ্রথম মহিলাদের ব্যাপক অংশগ্রহণ লক্ষ করা যায় । গান্ধিজি ইয়ং ইন্ডিয়া পত্রিকা মারফত নারী সমাজকে আইন অমান্য আন্দোলনে যােগদানের আহ্বান জানালে দলে দলে মহিলারা এই আন্দোলনে শামিল হন । কমলা নেহরু , সরােজিনী নাইডু , বাসন্তী দেবী , সরলাবালা দেবী , রাজকুমারী অমৃত কাউর প্রমুখ নারী সামনের সারিতে থেকে এ আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন । এই প্রথম নারী সমাজ ঘরের কোণ থেকে বেরিয়ে এসে জাতীয় আন্দোলনের শরিক হয় । ঐতিহাসিক ড. সুমিত সরকার যুক্তপ্রদেশ পুলিশের একজন বড়ােকর্তা জেনারেল উড এর মন্তব্য উল্লেখ করে লিখেছেন , “ ভারতীয় নারী স্বাধীনতা অর্জনের ক্ষেত্রে আইন অমান্য আন্দোলন অবশ্যই একটি অগ্রণী পদক্ষেপ হিসেবে চিহ্নিত হবে । ”
আঞ্চলিক বৈচিত্র্য
আইন অমান্য আন্দোলনের গতি প্রকৃতি বিভিন্ন অঞ্চলে সমান ছিল না । এই আন্দোলনের প্রাণকেন্দ্র ছিল বােম্বাই মেট্রোপলিটন অঞ্চলটুকু । এ ছাড়াও মহারাষ্ট্র , কর্ণাটক , পাঞ্জাব এবং কেন্দ্রীয় প্রদেশে বিক্ষিপ্ত ভাবে এই আন্দোলন পরিচালিত হয় । গুজরাতের খেদা , বরদৌলি ; পাঞ্জাবের হিস্যা ও রােহটক , তামিলনাড়ুর মাদুরা এবং ওড়িশার কটক , বালাসাের ইত্যাদি অঞ্চলগুলিতে কমবেশি আন্দোলনের তীব্রতা লক্ষ করা যায় । বিহারের ছােটোনাগপুরের উপজাতি অধ্যুষিত অঞ্চল এবং হাজারিবাগ অঞ্চল ; আর যুক্তপ্রদেশের কানপুর ও বেনারস এই আন্দোলনে উত্তাল হয়ে ওঠে । সারা দেশ জুড়ে সমানভাবে সর্বত্র আইন অমান্য আন্দোলনের তীব্রতা দেখা যায়নি ।
গোলটেবিল বৈঠক
দেশজুড়ে আইন অমান্য আন্দোলনের তীব্রতায় ব্রিটিশ ভীত হয়ে পড়ে । সরকারি উদ্যোগে ভারতের বিভিন্ন দলের নেতৃবৃন্দকে নিয়ে লন্ডনে প্রথম গােলটেবিল বৈঠক ডাকা হয় ( ১২ নভেম্বর থেকে ১৯ জানুয়ারি , ১৯৩০-৩১ খ্রি. ) । কিন্তু প্রস্তাবিত বৈঠকের আগেই জাতীয় কংগ্রেস স্বায়ত্ত শাসনের দাবি জানালে কংগ্রেসকে বাদ দিয়েই ব্রিটিশ প্রথম গােলটেবিল বৈঠকের আয়ােজন করে । কিন্তু দেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দল কংগ্রেসের অনুপস্থিতির দরুন প্রথম গােলটেবিল বৈঠক ব্যর্থ হয় । প্রথম গােলটেবিল বৈঠকের বিভিন্ন প্রস্তাবগুলি কার্যকর করার জন্য গান্ধিজি সহ কংগ্রেসের শীর্ষ নেতাদের মুক্তি দেওয়া হয় । গান্ধিজির সঙ্গে বড়ােলাট লর্ড আরউইনের আলােচনা শুরু হয় , স্বাক্ষরিত হয় গান্ধী আরউইন চুক্তি । এরপর জাতীয় কংগ্রেস দ্বিতীয় গােলটেবিল বৈঠকে যােগ দেয় কিন্তু গান্ধিজি শূন্য হাতে ফিরে আসেন ।