রুশ বিপ্লবে লেনিনের ভূমিকা আলােচনা করাে

Contents

রুশ বিপ্লবে লেনিনের ভূমিকা আলােচনা করাে

ভ্লাদিমির ইলিচ উলিয়ানভ ( ছদ্মনাম লেনিন ) -এর নেতৃত্বে বলশেভিক দল রাশিয়ায় রুশ বিপ্লব ঘটায় এবং রাশিয়াতে সমাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা করে । জে. এন. ওয়েস্টউড  তাঁর রাশিয়ার ইতিহাসে লিখেছেন — প্রখর রাজনৈতিক জ্ঞানের দ্বারা লেনিন মার্কসীয় তত্ত্বকে রাশিয়ার উপযােগী করে প্রয়ােগ করেন ।

Lenin 1920
ভ্লাদিমির ইলিচ উলিয়ানভ ( লেনিন )

সমাজতান্ত্রিক মতাদর্শের প্রয়োগ

লেনিনের বিপ্লব ছিল প্রলেটেরিয়েটদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের সংগ্রাম । লেনিন চেয়েছিলেন বলশেভিক বিপ্লবকে পূর্ণ সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের রূপ দিতে । এর পাশাপাশি তিনি জমিদার ও পুঁজিপতিদের উচ্ছেদ ঘটানােরও প্রয়াস নেন । লেনিনের কর্মসূচিগুলি রূপায়ণের মধ্যে দিয়েই প্রকৃত রুশ বিপ্লবের সূচনা ঘটে । লেনিন  ঘােষণা করেন — আমরা চাই যত শীঘ্র সম্ভব কৃষকদের হাতে জমি হস্তান্তর ঘটুক ( ‘ We favour an immediate transfer of the land to the peasants ‘ ) । 

বলশেভিক পার্টি গঠন 

রাশিয়ার সমাজতন্ত্রী সমর্থকগণ সােশ্যাল ডেমােক্র্যাটিক লেবার পার্টি গঠন করেছিল ( ১৮৯৫ খ্রি. ) । এই দলের সদস্যরা মতাদর্শগত কারণে দুটি উপদলে ভাগ হয়ে যায় ( ১৯০৩ খ্রি. ) । নরমপন্থী  সদস্যরা মেনশেভিক ( সংখ্যা লঘিষ্ঠ ) মতবাদী ও চরমপন্থী সদস্যরা বলশেভিক ( সংখ্যা গরিষ্ঠ ) মতবাদী নামে পরিচিতি পায় । ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে রাশিয়ায় শ্রমিকদের বিপ্লব – আন্দোলন ব্যর্থ হয়ে গেলে লেনিন বলশেভিকদের মার্কসবাদে দীক্ষিত করেন । পরে ১৯১২ খ্রিস্টাব্দে মেনশেভিকদের সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করে তিনি স্বতন্ত্র বলশেভিক পার্টি গঠন করেন এবং দলের প্রচার কাজের জন্য প্রাভদা নামে মুখপত্রটি প্রকাশ করেন । 

সঠিক সময়ে নেতৃত্বদান

জার শাসনের উচ্ছেদ করে সাংবিধানিক গণতান্ত্রিক দলের প্রিন্স জর্জ লুভভ ( Lvov ) এর নেতৃত্বে রাশিয়ায় একটি অস্থায়ী বুর্জোয়া সরকার গঠিত হয় । এই সরকার রাশিয়াকে একটি প্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্র বলে ঘােষণা করে । অস্থায়ী সরকার কোনােরকম অর্থনৈতিক পুনর্গঠন করতে সক্ষম না হওয়ায় মেনশেভিক দলের নেতা কেরেস্কি দেশের শাসন ক্ষমতা হস্তগত করেন । কেরেস্কি সরকারও কিন্তু বিপ্লবের উদ্দেশ্য সিদ্ধ করতে পারেনি । জাতির এই প্রচণ্ড সংকটকালে লেনিন সুইজারল্যান্ডে নির্বাসন থেকে স্বদেশে ফিরে আসেন ( এপ্রিল ১৯১৭ খ্রি. ) এবং এক অবিসংবাদী নেতারূপে আত্মপ্রকাশ করেন । এইভাবে উপযুক্ত সময়ে উপযুক্ত নেতার আবির্ভাব ঘটায় রাশিয়ার জাতীয় ভাগ্য ঠিক পথে পরিচালিত হয় । লেনিন দৃঢ়কণ্ঠে ঘােষণা করেন যে রাশিয়ার পক্ষে সংসদীয় প্রজাতন্ত্র বা বুর্জোয়া গণতন্ত্রের কোনাে প্রয়ােজন নেই । লেনিনের নেতৃত্বে বলশেভিক দল রুশ বিপ্লবের দ্বিতীয় অধ্যায়ের সূচনা ঘটায় । জুলাই মাসে ( ১৯১৭ খ্রি. ) নতুন করে গণবিক্ষোভ রাজধানীকে মুখর করে তােলে । 

বিপ্লবী কর্মসূচি প্রণয়ন — এপ্রিল থিসিস

রাশিয়ায় বুর্জোয়া প্রজাতান্ত্রিক সরকার জনগণের আশা – আকাঙ্ক্ষা পূরণে ব্যর্থ হয় । এই পটভূমিকায় লেনিন তাঁর বিখ্যাত ‘ এপ্রিল থিসিস ’ ( এপ্রিল , ১৯১৭ খ্রি. ) ঘােষণা করেন । এই ঘােষণায় লেনিন বলেন — 

1. সব ক্ষমতা সােভিয়েতকে দিতে হবে , 

2. সর্বহারার একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠা করতে এবং 

3. জমি অধিগ্রহণ করলেও জমিদারদের কোনাে ক্ষতিপূরণ নয় । লেনিন ঘােষণা করলেন — বলশেভিকগণ ক্ষমতা পেলে শ্রমিককে দেবে রুটি , কৃষককে জমি আর সেনাদলকে দেবে শান্তি । 

বলশেভিকদের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি

রাশিয়ার প্রতিটি শহরে সােভিয়েতগুলিতে বলশেভিক গােষ্ঠী অতি দ্রুত সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভের সঙ্গে সঙ্গে জনগণের মুখপাত্র হয়ে দাঁড়ায় । বলশেভিকরা লেনিনের নেতৃত্বে জনপ্রিয় হয়ে উঠতে থাকলে কেরেনস্কি সরকার কঠোরভাবে তাদের দমনের চেষ্টা করে । লেনিন ফিনল্যান্ডে আত্মগােপন করেন । কিন্তু অল্পকালের মধ্যেই মেনশেভিক সেনানায়ক কর্নিলভ – এর সঙ্গে কেরেস্কির মনােমালিন্য শুরু হওয়ায় বলশেভিকদের প্রাধান্যলাভের পথ আবার প্রশস্ত হয় । 

ক্ষমতা দখল 

অক্টোবর মাসে লেনিন রাশিয়ায় ফিরে এসে আবার বলশেভিকদের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন । ফলে নতুন করে শুরু হয় লেনিন পরিচালিত বলশেভিকদের সঙ্গে মেনশেভিকদের ক্ষমতার লড়াই । লেনিনের অন্যতম সহযােগী ট্রটস্কি বলশেভিক স্বেচ্ছাসেবক লালফৌজের সাহায্যে কেরেস্কি সরকারের উচ্ছেদ ঘটান ( ৭ নভেম্বর বা পুরাতন বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী ২৫ অক্টোবর ) । ওই দিন সকাল দশটায় পেট্রোগ্রাডে এক সম্মেলনে লেনিন দৃপ্তকণ্ঠে ‘ অস্থায়ী সরকারের ’ স্থলে স্থায়ী সােভিয়েত সরকার – এর প্রতিষ্ঠা ঘােষণা করেন । ফলে লেনিনের নেতৃত্বে বলশেভিক প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম সফল হয় । ১৯১৮ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারি মাসে বলশেভিক দল কমিউনিস্ট পার্টি নামে পরিচিত হয় । 

মূল্যায়ন 

লেনিনের বলিষ্ঠ ও সুযােগ্য নেতৃত্বে এক মহান বিপ্লবের মধ্যে দিয়ে বলশেভিক দল রাশিয়ায় সর্বহারার একনায়কত্ব ( Dictatorship of the Proletariat ) প্রতিষ্ঠা করে । এইভাবেই মার্কস – এঙ্গেলস্ – এর দর্শন লেনিনকৃত ভাষ্যের মাধ্যমে পৃথিবীর বুকে তার বাস্তব রূপ পরিগ্রহ করল । রাশিয়া লাভ করল এক নতুন জীবন । আর লেনিন হয়ে উঠলেন বিশ্বের শােষিত নিপীড়িত মানুষের মুক্তির দিশারি ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!