আমেরিকায় অর্থনৈতিক মন্দার কারণ ও ফলাফল
Contents
আমেরিকায় অর্থনৈতিক মন্দার কারণ ও ফলাফল

আমেরিকায় ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দের ভয়াবহ অর্থনৈতিক ধস বা মহামন্দা ছিল সেখানকার অর্থনৈতিক নীতি নির্ধারণের এক জটিল প্রক্রিয়ার ফল । সাধারণভাবে এর জন্য দায়ী ছিল সেখানকার রিপাবলিকান দলের অনুসৃত আর্থিক নীতি । ১৯২১ থেকে ১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত পর পর তিন রিপাবলিকান রাষ্ট্রপতির আমলেই আমেরিকায় আর্থিক মন্দার সূচনা ও প্রসার ঘটে । মার্কিন অর্থনৈতিক মহামন্দার কুপ্রভাব প্রসঙ্গে ঐতিহাসিক ই. এইচ. কার বলেন— “ অর্ধেক ইউরােপ দেউলিয়া হয়ে পড়ল এবং অবশিষ্ট অর্ধেক দেউলিয়া হওয়ার আশঙ্কার মুখােমুখি হল । ”
১৯২৯ খ্রিস্টাব্দে আমেরিকায় অর্থনৈতিক মন্দার কারণ
উৎপাদন ক্ষমতা ও ভােগ প্রবণতার পার্থক্য :
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর থেকেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দ্রুত উত্থান ঘটে । কিন্তু আমেরিকায় বিশের দশকে যে পরিমাণ জাতীয় আয় হয়েছিল জনগণের মধ্যে তার সুষম বণ্টন হয়নি ১৯২৩ সালে আমেরিকার জাতীয় আয়ের পরিমাণ ছিল ৭৪.৩ বিলিয়ন ডলার , ১৯২৯ সালে এই আয় বৃদ্ধি পেয়ে ৮৯ বিলিয়ন ডলারে দাড়ায় । কিন্তু সমাজের ৪২ শতাংশ নীচু তলার মানুষের মােট আয় ছিল উঁচু তলার ০.১ শতাংশ মানুষের রােজগার । ফলে উৎপাদিত ভােগ্য সামগ্রী উচ্চবিত্ত বাদে সাধারণ মানুষের অধরাই থেকে যায় । উৎপাদিত পণ্য নিজের দেশেই ব্যাপকভাবে বিক্রি না হওয়ায় শিল্প মালিকরা উৎপাদন কমিয়ে দেয় , যার পরিণতিতে মন্দা দেখা দেয় ।
মার্কিন পণ্য রপ্তানি হ্রাস :
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিজেদের দেশে উৎপাদিত বিভিন্ন ভােগ্যপণ্য ও শিল্পজাত দ্রব্যগুলি ইউরােপের বিভিন্ন দেশের চাহিদা অনুযায়ী রপ্তানি করত । ইউরােপের বহু দেশ মার্কিন পণ্য আমদানি কমিয়ে দিয়ে নিজেদের দেশে ওইসব পণ্যদ্রব্যের উৎপাদন শুরু করে । আমেরিকার কাছে ঋণগ্রস্ত ইউরােপীয় দেশগুলি নিজেদের কৃষি , শিল্প , বাণিজ্যকে রক্ষার জন্য শুল্ক চাপিয়ে , ভরতুকি দিয়ে বা কোটার ব্যবস্থা করে বৈদেশিক বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করে । ফলে আমেরিকার রপ্তানি বাণিজ্য হ্রাস পায় ।
কৃষকদের দুর্দশা :
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় বিশ্বের বিভিন্ন দেশগুলি কৃষিজ পণ্যের উৎপাদন বাড়ানাের লক্ষ্যে আমেরিকার কাছ থেকে প্রচুর ঋণ নেয় । কিন্তু উৎপাদিত কৃষিজ পণ্য বিক্রি করে তারা সেই ঋণের অর্থ সম্পূর্ণ পরিশােধ করতে ব্যর্থ হয় । এর ওপর প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে একদিকে কৃষিজ পণ্যের চাহিদা কমতে শুরু করে , অপর দিকে কৃষিজ পণ্যের দামও বহুগুণ হ্রাস পেতে থাকে , ফলস্বরূপ কৃষকরা চরম সংকটের মুখােমুখি হয় । কৃষি অর্থনীতি ভেঙে পড়ে ।
শেয়ার বাজার ধস :
তাড়াতাড়ি ধনী হওয়ার লােভে চড়া দামে শেয়ার কিনে মার্কিনিরা ইতিমধ্যেই প্রচুর অর্থ বিনিয়ােগ করেছিল । কিন্তু বিংশ শতকের দুই – এর দশকে শিল্পজাত পণ্যসামগ্রীর চাহিদা কমলে স্বাভাবিকভাবেই ভারী ও মাঝারি শিল্পের উৎপাদন কমানাে হয় , যার পরােক্ষ প্রভাবে শেয়ারের দাম কমতে থাকে । ফলে মার্কিন অর্থনীতি জোর ধাক্কা খায় । ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দের ২৪ অক্টোবর কালাে বৃহস্পতিবার নামক পরিচিত দিনটিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওয়ার্ল্ড স্ট্রিট – এর শেয়ার বাজারে ধস নামে ।
স্বর্ণ সংকট :
বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন যুদ্ধে যােগদানকারী দেশগুলির অর্থনীতি বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে । যুদ্ধ খরচ জোগানাের জন্য বহু ইউরােপীয় দেশ আমেরিকা থেকে আর্থিক ঋণ নিতে বাধ্য হয় । এ ছাড়াও ইউরােপের বিভিন্ন দেশ সােনার বিনিময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে তাদের প্রয়ােজনীয় পণ্যসামগ্রী কিনত । এভাবে বিভিন্ন দেশের সােনা মার্কিন স্বর্ণ ভাণ্ডারে জমা হয় । যুদ্ধ শেষে বিভিন্ন দেশ নিজেদের সােনাসহ মূল্যবান ধাতু রক্ষা করার জন্য শুল্ক প্রাচীর তুলে আমদানি বন্ধ করে দিলে মার্কিন অর্থনীতিতে মহামন্দা দেখা দেয় ।
অত্যাধিক শুল্ক হার :
নিজের দেশের শিল্পপণ্যগুলি বিক্রয়ের লক্ষ্যে এবং বিভিন্ন শিল্প ব্যবস্থাগুলিকে রক্ষার লক্ষ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিদেশি পণ্যের আমদানির ওপর অত্যধিক হারে শুল্ক চাপায় । এর দেখাদেখি অন্যান্য ইউরােপীয় রাষ্ট্রগুলিও তাদের দেশে আমদানিকৃত মার্কিন পণ্যসামগ্রীর ওপর উচ্চহারে আমদানি শুল্ক বসায় । এর ফল স্বরূপ আন্তর্জাতিক বাজারে মার্কিন পণ্য সামগ্রীর বিক্রি ভীষণ ভাবে কমে যায় , ফলে মার্কিন অর্থনীতিতে মহামন্দা নেমে আসে ।
১৯২৯ খ্রিস্টাব্দে আমেরিকায় অর্থনৈতিক মন্দার ফলাফল
আমেরিকায় আর্থিক মহামন্দার ফলে ইউরােপের আর্থিক , সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও বিপর্যয় নেমে আসে ।
শেয়ার ক্রেতাদের বিপর্যয় :
মানুষ ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে শেয়ার কিনেছিল , এখন কেনা দামের চেয়ে কম মূল্যে শেয়ার বিক্রি করতে বাধ্য হওয়ায় , ব্যাংকের ঋণ শােধ করা অসম্ভব হয়ে পড়ে ।
ব্যাংকিং ব্যবস্থায় ধস :
বহু ব্যাংক নিজেরাই বাজারে তেজিভাবের সুযােগে বিভিন্ন কোম্পানির শেয়ারে টাকা বিনিয়ােগ করেছিল । আমেরিকায় আর্থিক মহামন্দা দেখা দিলে ( ১৯২৯ খ্রি. ) পরবর্তী তিন বছরের মধ্যে প্রায় ৫৭০ টি ব্যাংক বন্ধ হয়ে যায় এবং প্রায় ৩ হাজার ৫০০ টি ব্যাংক তাদের আর্থিক লেনদেন বন্ধ রাখে । এর কারণ শেয়ার বাজারে লগ্নিকৃত অর্থ তাদের হাতছাড়া হয় ।
আমানতকারীরা সর্বস্বান্ত :
আতঙ্কগ্রস্ত হাজার হাজার আমানতকারী ব্যাংকে তাদের জমানাে টাকা তুলে নিতে গেলে টাকার অভাবে ব্যাংকগুলি বহু আমানতকারীদের অর্থ ফেরত দিতে ব্যর্থ হয় । আমেরিকার ব্যাংক ব্যবস্থা ভেঙে পড়লে সেখানকার আমানতকারী সাধারণ মানুষ সর্বস্বান্ত হয়ে যায় ।
কৃষি সংকট বৃদ্ধি :
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বিংশ শতকের দুই – এর দশক থেকে কৃষিতে সংকট শুরু হয়েছিল । এর ওপর সারা দেশজুড়ে আর্থিক ধস বা মহামন্দা দেখা দিলে কৃষিক্ষেত্রে সংকট আরও বাড়ে । কৃষিজাত পণ্যের দাম কমে যাওয়ায় লক্ষ লক্ষ কৃষক অসহায় হয়ে পড়ে ।
বেকার সমস্যা :
আমেরিকায় অর্থনৈতিক মহামন্দা তীব্র বেকার সমস্যার সৃষ্টি করে । বেকার সমস্যা সমাধানের জন্য যে কমিটি গঠন করা হয় , তার এক পরিসংখ্যানে দেখা যায় ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দের ১০ লক্ষ বেকার ১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দে বেড়ে হয় দেড় কোটি ।
ব্যাবসা বাণিজ্যের ক্ষতি :
আমেরিকা জুড়ে আর্থিক মহামন্দা ব্যাবসা বাণিজ্যে চরম ক্ষতিসাধন করে । বৈদেশিক বাণিজ্য সম্পূর্ণরূপে ভেঙে পড়ে । বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলি তাদের উদ্বৃত্ত মূলধন শেয়ার বাজারে বিনিয়ােগ করেছিল কিন্তু শেয়ার মূল্য কেনা দামের থেকেও কমে যাওয়ায় ব্যাবসা বাণিজ্যের ক্ষতি হয় ।
শিল্প প্রতিষ্ঠানে বিপর্যয় :
আমেরিকার আর্থিক মহামন্দার প্রভাবে শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলির বিপর্যয় দেখা দেয় । বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জড়িত মালিক পক্ষ , শ্রমিক পক্ষ এবং মধ্যবর্তী ব্যবসায়ীরা চরম সংকটের মুখােমুখি হয় । উৎপাদিত শিল্পপণ্য অবিক্রিত থেকে যাওয়ায় শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলি একে একে বন্ধ হয়ে গেলে মালিক পক্ষ সর্বস্বান্ত হয় । শ্রমিকরা জীবিকা হারায় ।
উপসংহার
ভার্সাই চুক্তিতে পরাজিত জার্মানির কাছ থেকে ইউরােপীয় রাষ্ট্রগুলির যে অর্থ ক্ষতিপূরণ বাবদ পাওয়ার কথা , জার্মানি সেই অর্থ যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে ঋণ নিয়েই বিজয়ী রাষ্ট্রগুলিকে শােধ দিচ্ছিল । আবার মিত্রপক্ষের ওইসব রাষ্ট্র ক্ষতিপূরণ বাবদ পাওয়া ওই টাকা যুদ্ধ চলাকালে আমেরিকার কাছ থেকে নেওয়া ঋণ বাবদ পরিশােধ করত । কিন্তু আমেরিকার ওই মহামন্দার কারণে তার পক্ষে জার্মানিকে আর ঋণ দেওয়া সম্ভব হল না । ফলে আমেরিকাকে কেন্দ্র করে যে আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক বৃত্তটি গড়ে উঠেছিল , তা ভেঙে পড়ার উপক্রম হল । এরই পরিণতি হিসেবে দেখা দেয় বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দা ( World Economic Depression ) ।